নিখোঁজ থেকে উদ্ধার: এক ব্যাংক কর্মকর্তার মানসিক বিপর্যয়ের গল্প
বাংলাদেশ ব্যাংকের উপ-পরিচালক সৈয়দ নাঈম রহমানকে নিয়ে কয়েকদিনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার অবসান ঘটেছে। তিন দিন নিখোঁজ থাকার পর মঙ্গলবার মাদারীপুরের একটি হোটেল থেকে তাকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। নাঈম রহমান স্বেচ্ছায় আত্মগোপনে গিয়েছিলেন বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। তার পরিবার, সহকর্মী ও পুরো ব্যাংক সম্প্রদায় এই ঘটনাকে ঘিরে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল।
অফিস থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ
রোববার দুপুরে নাঈম রহমান রাজধানীর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকেই তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। তিনি অফিসে নিজের ব্যাগ ও আইডি কার্ড রেখে বেরিয়ে যান। দুপুর ১২টা ৫৩ মিনিটে এক সহকর্মীকে পাঠানো শেষ এসএমএসটি তার নিখোঁজ হওয়ার আগে শেষ যোগাযোগ ছিল।
সে বার্তায় তিনি লিখেছিলেন,
“আমার আর্থিক অবস্থার জন্য আমি মানসিকভাবে পুরোপুরি ভেঙে পড়েছি। অফিসেও কয়েকজনের কাছ থেকে ধার নিয়েছি, কিন্তু এখন দিতে পারছি না। মুখ দেখানোর মতো অবস্থা নেই…”
এই কয়েকটি লাইনই তার ভেতরের অস্থিরতা ও মানসিক চাপে ভুগতে থাকা এক কর্মকর্তার বাস্তব চিত্র তুলে ধরে।

মায়ের জিডি ও সামাজিক উদ্বেগ
ছেলের কোনো খোঁজ না পেয়ে নাঈমের মা সাজ্জাদা রহমান, জলি মিরপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। সেই জিডিতে তিনি উল্লেখ করেন, নাঈম ৯ নভেম্বর সকাল ১০টার দিকে উত্তর পীরেরবাগের বাসা থেকে অফিসে যাওয়ার পর আর ফিরে আসেনি।
তারপর থেকেই পরিবার ও সহকর্মীরা সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দিয়ে খোঁজ করতে থাকেন। নাঈমের নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে।
ট্র্যাকিংয়ে পুলিশের সাফল্য
জিডির পর পুলিশ তার মোবাইল নম্বর ট্র্যাকিং শুরু করে। এভাবেই তারা জানতে পারে, নাঈম মাদারীপুরের একটি হোটেলে অবস্থান করছেন। মঙ্গলবার দুপুরে তার অবস্থান শনাক্ত হলে রাতে তাকে উদ্ধার করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক অফিসার্স ওয়েলফেয়ার কাউন্সিলের সভাপতি মাসুম বিল্লাহ ফেসবুক পোস্টে নাঈমকে উদ্ধারের খবর জানান এবং পুলিশ ও প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানান।
তিনি বলেন, “নাঈমকে পাওয়া গেছে। কেন, কীভাবে সেখানে গিয়েছিলেন সেটা পরে জানা যাবে।”
অর্থকষ্টে আত্মগোপন
উদ্ধারের পর প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা গেছে, আর্থিক সংকটই ছিল নাঈমের মানসিক বিপর্যয়ের মূল কারণ। তিনি কিছু সহকর্মীর কাছ থেকে ধার নিয়েছিলেন, কিন্তু পরিশোধ করতে না পারায় নিজেকে লজ্জিত ও অসহায় মনে করছিলেন।
তার পাঠানো বার্তায় আরও ছিল আবেগপূর্ণ অনুরোধ—
“পারলে আমার ছোট বোনটার জন্য একটা চাকরি জোগাড় করে দিবেন। না হলে আমার পরিবার চলতে পারবে না… আমার স্ত্রী ও সন্তান ভালো থাকবে ইনশাআল্লাহ, কিন্তু মা আর ছোট বোন আমাকে ছাড়া অসহায় হয়ে যাবে।”

উদ্ধারের পর তদন্ত ও সহানুভূতির আহ্বান
নাঈম রহমানকে বর্তমানে পুলিশের হেফাজতে এনে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। তার মানসিক অবস্থাও পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। প্রশাসন জানিয়েছে, তিনি নিরাপদ আছেন এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
ঘটনাটি কর্মজীবীদের মানসিক চাপ ও আর্থিক অনিশ্চয়তার দিকেও নতুন করে নজর দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সরকারি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করতে হবে।
নাঈম রহমানের এই ঘটনা কেবল একজন কর্মকর্তার নিখোঁজ হওয়া নয়, বরং সমাজে ক্রমবর্ধমান মানসিক চাপ, অর্থকষ্ট ও আত্মসম্মানবোধের জটিল সংঘাতের প্রতিফলন। তার উদ্ধার পরিবার ও সহকর্মীদের জন্য স্বস্তির হলেও, ঘটনাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রেখে গেছে—
অর্থকষ্টে বা মানসিক বিপর্যয়ে কেউ যেন এমন সিদ্ধান্ত নিতে না বাধ্য হয়, সেজন্য আমরা কতটা প্রস্তুত?
#মানসিকস্বাস্থ্য #বাংলাদেশব্যাংক #সৈয়েদনাঈমরহমান #সারাক্ষণরিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















