মিডিয়া যখন রেড ফোর্টের গাড়ি বিস্ফোরণ নিয়ে নানা দিক আলোচনা করছিল, সরকার তখন অত্যন্ত সতর্ক ছিল—তৎক্ষণাৎ একে সন্ত্রাসী হামলা বলে চিহ্নিত করেনি। তদন্তকারীরা ঘটনাটি খতিয়ে দেখার পর দুই দিন পরে এটিকে সন্ত্রাসী হামলা বলে নিশ্চিত করা হয়। এখন কিছু মৌলিক তথ্য প্রকাশ্যে এসেছে। কাশ্মীর থেকে একটি মডিউলকে নজরে রাখা হচ্ছিল, এবং বিস্ফোরক সামগ্রী সাহারানপুর ও ফরিদাবাদ হয়ে রাজধানীর দিকে আসছিল বলে স্পষ্ট হয়েছে।
নতুন তথ্য বলছে, এই দুটি ঘটনাই আসলে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত—একই মডিউল যুক্ত ছিল। পাকিস্তানের কোনও সরাসরি যোগসূত্র এখনও পাওয়া যায়নি, তবে চরমপন্থার শক্ত প্রভাব রয়েছে—যার উৎস ও উদ্দেশ্য পরিষ্কার নয়। এটি পরিস্থিতিকে আরও বিপজ্জনক করে তুলছে। যেন ভূগর্ভে লুকিয়ে চলা ভাইরাস।
তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবর মাসে শ্রীনগরের নওগাঁও এলাকায় জইশ-ই-মোহাম্মদের নাম-যুক্ত কিছু পোস্টার দেখা যায়, যেখানে জনগণকে পুলিশকে সহযোগিতা না করার আহ্বান করা হয়। এক সতর্ক পুলিশ সুপার অভিযুক্ত ব্যক্তিকে শনাক্ত করেন—তিনি আদিল আহমেদ রাথর নামে এক চিকিৎসক, যিনি আনন্তনাগের সরকারি মেডিক্যাল কলেজের (জিএমসি) সিনিয়র রেসিডেন্ট ছিলেন।
জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশ যখন জিএমসিতে তদন্ত চালিয়ে অস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধার করে, তখন উত্তরপ্রদেশ পুলিশকে সতর্ক করা হয়। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সাহারানপুরে অবস্থানরত রাথরকে গ্রেপ্তার করা হয়। তদন্তের সূত্রে এরপর ফরিদাবাদে পৌঁছানো যায় এবং গ্রেপ্তার হয় পুলওয়ামার বাসিন্দা মুজ্জামিল গনাই—ফরিদাবাদের আল-ফালাহ হাসপাতালের একজন চিকিৎসক। নভেম্বরের শুরুতেই এই গ্রেপ্তার হয়। উদ্ধার হয় প্রায় ২,৯০০ কিলোগ্রাম বোমা তৈরির উপাদান, যার মধ্যে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটও ছিল।

নভেম্বর ১০-এ জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশ যখন কঠোর সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান চালায়, একই সন্ধ্যায় দিল্লিতে গাড়িটি বিস্ফোরিত হয়। প্রথমদিকে এটিকে সিএনজি সিলিন্ডার বিস্ফোরণ বলা হলেও পরে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের চিহ্ন মিললে বিষয়টি সন্দেহজনক হয়ে ওঠে। সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়ে আরেক চিকিৎসক—উমর উন-নাবি—যিনি ফরিদাবাদের একই হাসপাতালের কর্মী। ফরেনসিক বিশ্লেষণেও এই তথ্য নিশ্চিত হয়েছে।
এতে তদন্তের প্রথম অধ্যায় প্রায় সম্পূর্ণ হয়। পরে আরও গ্রেপ্তার হয়—শোপিয়ানের এক র্যাডিকাল ইমাম, লখনউয়ের আল-ফালাহ হাসপাতালের এক নারী চিকিৎসকসহ আরও অনেকে। আরও গ্রেপ্তার হবে বলেও ধারণা। কিন্তু মূল বিষয় হলো—এই নেটওয়ার্কটি কয়েকটি রাজ্যজুড়ে ছড়িয়ে ছিল এবং পুরো কাঠামো এখনও উন্মোচিত হয়নি।
এখন সন্দেহ হচ্ছে—আসলে কি একটি কার-বোমা চালানোর উদ্দেশ্যই ছিল? কয়েকশো গজ আরও এগোলে চালক শ্রী গৌরী শঙ্কর মন্দিরের কাছে পৌঁছাতে পারত—যেখানে বহু মানুষের প্রাণহানির সম্ভাবনা ছিল, এবং এতে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি হতে পারত—যা সন্ত্রাসীদের অন্যতম লক্ষ্য। অথবা রাজধানীর অন্য কোনও লক্ষ্যবস্তুতে হামলা পরিকল্পিত ছিল। একটি অনুমান হলো, অন্যান্য সদস্যরা গ্রেপ্তার হতে শুরু করায় চালক আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।
এটিও সম্ভব। তবে সব তথ্য অনুযায়ী, পরিকল্পনাটি কমপক্ষে দুই বছর ধরে চলছিল—অর্থাৎ যথেষ্ট শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল।
এ ছাড়া, এই তথ্য প্রমাণ করে যে মডিউলটি “অপারেশন সিন্দুর” শুরুর বহু আগেই সক্রিয় ছিল। তাই এটিকে জইশ বা লস্কর ঘাঁটিতে ভারতীয় বিমান হামলার প্রতিশোধ বলা যায় না।
সব তথ্য অনুযায়ী, এটি ছিল নীরব ও বিস্তৃত একটি স্লিপার সেল নেটওয়ার্ক—সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত মানুষদের নিয়ে, যারা সবাই কাশ্মীরি নয়, এবং সুযোগের অপেক্ষায় ছিল।
এই বাস্তবতা বুঝতে হলে স্পেন ও ইতালিতে পাকিস্তানি নাগরিকদের বিশাল একটি সেল ভাঙার কথা মনে করতে হয়। বহু বছর ধরে তারা গোপনে মানুষকে চরমপন্থায় প্ররোচিত করছিল। কেউ টেরই পায়নি। গ্রেপ্তার করতে আরও দুই বছর লেগেছে। এখানেও অধ্যায় এত তাড়াতাড়ি শেষ হবে না।
পরবর্তী অধ্যায়, স্বভাবতই, পাকিস্তানকে কেন্দ্র করে। পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ২৭তম সাংবিধানিক সংশোধনী এনে নিজের হাতে অসীম ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করেছেন, যার ফলে সেনাবাহিনী সবার ঊর্ধ্বে উঠে গেছে। এর ফলে দেশে হতাশা ও ভীতির পরিবেশ দেখা দিয়েছে। সেনাবাহিনীর ভেতর থেকেও বিরোধিতার ইঙ্গিত মিলছে, রাজনৈতিক দলগুলোও উদ্বিগ্ন।
খুব দ্রুতই আসিম মুনির ক্ষেপণাস্ত্রের নিয়ন্ত্রণও একচেটিয়া হাতে পেতে চলেছেন—যা যুদ্ধের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়াতে পারে। এই মডিউলটি ধরা না পড়লে কী ঘটতে পারত—তা অনুমান করাও কঠিন।

নভেম্বর ১১-এ, দিল্লি বিস্ফোরণের কয়েক ঘণ্টা পরে, ইসলামাবাদের কেন্দ্রে একটি গাড়ি বোমা বিস্ফোরিত হয়। পাকিস্তানি তালেবান এর দায় স্বীকার করে। ইসলামাবাদ সঙ্গে সঙ্গে দিল্লিকে দায়ী করে। ভারত, নিজের তদন্তে মনোযোগী থেকে, অভিযোগ-প্রত্যুত্তরে যায়নি।
এদিকে, ভারতকেও নিজের ভেতরে নজর দিতে হবে—যে পরিবেশ তরুণ, উচ্চাকাঙ্ক্ষী চিকিৎসকদের চরমপন্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। একটি বিষয় স্বীকার করা দরকার—সন্ত্রাসবাদ শূন্য থেকে জন্মায় না। এটি বিদ্যমান বিভাজনের ওপর দাঁড়ায়। পাকিস্তান এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
ভারতের উচিত দেশে ছড়িয়ে পড়া ধর্মীয় ঘৃণা, বিদ্বেষমূলক বক্তব্য এবং ভুল তথ্যের জোয়ার রুখে দাঁড়ানো। গণমাধ্যমেরও দেখাতে হবে—উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই এই সহিংসতার শিকার হচ্ছেন।
বিদেশে থাকা ভারতীয় দূতাবাসগুলোরও উচিত তথ্য শেয়ারিং বাড়ানো—কারণ বিষয়টি অত্যন্ত আন্তর্দেশীয় ও বৈশ্বিক। তুরস্কে জঙ্গি নেতাদের ‘হ্যান্ডলার’-এর সঙ্গে বৈঠকের রিপোর্ট পাওয়া গেছে—তাই আঙ্কারাকে সতর্ক করাটাও যুক্তিযুক্ত হতে পারে।
সমাজকে বুঝতে হবে—এটি শুধুই “কাশ্মীর সমস্যা” নয়—এটি সমগ্র ভারতের সমস্যা। বিপদ যেমন সর্বত্র, সমাধানও তেমনই সর্বত্র। একত্রে থাকা ছাড়া উপায় নেই।
বহু শত্রু চায় এই ভূখণ্ডকে বিভক্ত ও ক্ষতবিক্ষত করতে। তারা চায় ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে। দিল্লির দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতি বহু রাজধানীতে অস্বস্তি তৈরি করেছে।
লেখক পরিচিতি
তারা কার্থা – সাবেক পরিচালক, ভারতের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল সেক্রেটারিয়েট।
তারা কার্থা 



















