সার্বিয়ার রাস্তায় চীনা পুলিশ সদস্যদের দেখে এক চীনা পর্যটক আনন্দে বলে উঠেছিলেন—তিনি নাকি সবচেয়ে বন্ধুসুলভ লোকজনের দেখা পেয়েছেন। এই প্রচার–ধর্মী গল্পটি চীনের বৈশ্বিক নিরাপত্তা দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে মিলে যায়, যেখানে বেইজিং দাবি করে তারা বিশ্বশান্তি বজায় রাখতে চায় এবং বিদেশি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে না। ২০২২ সালে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যে ‘গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভ’ (জিএসআই) চালু করেন, সেটাই এই ভাবনার ভিত্তি। কিন্তু বাস্তবতা হলো—চীন এখন বিদেশি সরকারগুলোর সঙ্গে পুলিশ প্রশিক্ষণ, নজরদারি প্রযুক্তি এবং অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণমূলক নিরাপত্তা ব্যবস্থার বিস্তৃত সহযোগিতা গড়ে তুলছে। এটি শুধু অপরাধ দমন নয়, বরং সরকারকে ক্ষমতায় টিকে থাকতে সাহায্য করে। আর এই কারণে বহু দেশ এই ব্যবস্থার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে।
জিএসআই: বৈশ্বিক প্রভাব গঠনের নতুন নেটওয়ার্ক
শি জিনপিংয়ের জিএসআই মূলত নতুন আন্তর্জাতিক প্রভাব–বৃত্ত গড়ে তোলার প্রচেষ্টা। এর মাধ্যমে একটি ছোট আঞ্চলিক পুলিশ সম্মেলনকে সম্প্রসারিত করে বিশ্বের সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা–সহযোগিতা মঞ্চে রূপ দেওয়া হয়েছে—গ্লোবাল পাবলিক সিকিউরিটি কো-অপারেশন ফোরাম। এতে ১২০টির বেশি দেশের প্রতিনিধি অংশ নেন এবং চীনের আধুনিক পুলিশ প্রযুক্তি, যেমন রোবোটিক কুকুর, দেখে অভিভূত হন। হালনাগাদ “গ্লোবাল পাবলিক সিকিউরিটি ইনডেক্স” প্রকাশ করে চীন নিজেকে নিরাপত্তার শীর্ষমডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এতে বিভিন্ন দেশের বন্দুক-অপরাধ, সড়ক দুর্ঘটনা, সন্ত্রাসবাদ ইত্যাদি সূচকে আপাতদৃষ্টিতে অস্বচ্ছ মানদণ্ড ব্যবহার করা হয়। চীনকে রাখা হয় শীর্ষে, আর যুক্তরাষ্ট্রকে দেখানো হয় গড়ের নিচে। বিশ্লেষকদের মতে, এটি আন্তর্জাতিকভাবে নিরাপত্তার ধারণাকে চীনের মানদণ্ডে পুনর্গঠনের চেষ্টা।
বিস্তারমান নজরদারি–প্রযুক্তির বাজার
চীনের নিরাপত্তা প্রভাব বিস্তারের সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার হচ্ছে নজরদারি প্রযুক্তি রপ্তানি। হিকভিশন এবং দাহুয়া বিশ্বের সবচেয়ে বড় সিসিটিভি নির্মাতা হিসেবে বাজারের প্রায় চল্লিশ শতাংশ শেয়ার দখল করে আছে। হুয়াওয়ের ‘সেফ সিটি’ সিস্টেম এখন একশটির বেশি দেশে ব্যবহৃত হয়। গিগাজ নেটওয়ার্কস ইথিওপিয়া, কাজাখস্তান, মিয়ানমার ও পাকিস্তানের মতো দেশে ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি সরবরাহ করেছে। এইসব প্রযুক্তি দিয়ে সরকারগুলো শুধু নিরাপত্তা জোরদারই করছে না—বরং নিজেদের নাগরিকদের ওপর নজরদারিও বাড়াচ্ছে।

চীনা পুলিশ প্রশিক্ষণ: দ্রুত বিস্তার
কার্নেগি এনডাউমেন্টের নতুন গবেষণা দেখায় যে ২০০০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১৩৮টি দেশের পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রায় ৯০০টি প্রশিক্ষণ সেশন দিয়েছে চীন। শি জিনপিং ক্ষমতায় আসার পর এক দশকে প্রশিক্ষণের সংখ্যা ১৪ থেকে বেড়ে ১৩৮-এ পৌঁছায়। বিদেশি পুলিশ দলগুলো সাধারণত চীনের পুলিশ একাডেমিতে কয়েক সপ্তাহ বা মাস কাটায়, যেখানে আইন–শৃঙ্খলা ব্যবস্থা, সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ ও রেল নিরাপত্তা নিয়ে পড়ানো হয় এবং স্থানীয় থানায় ফিল্ড ভিজিট করানো হয়। প্রশিক্ষকদের প্রায়ই শি জিনপিংয়ের বই ‘দ্য গভর্নেন্স অব চায়না’ হাতে ছবি তুলতে দেখা যায়। কখনও ছাত্ররা তাই চি বা ক্যালিগ্রাফি শেখে, আবার কখনও চীনা পুলিশ সরাসরি বিদেশে গিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। এ বছর সলোমন দ্বীপপুঞ্জে গিয়ে চীনা প্রশিক্ষকরা “ফেংচিয়াও মডেল” প্রচার করেছেন, যেখানে প্রতিবেশীরা একে অন্যকে নজরদারি করে।
কোন ধরনের দেশগুলো এই প্রশিক্ষণ পাচ্ছে?
গবেষণায় দেখা গেছে যে সব স্বৈরশাসিত দেশের প্রায় বিয়াশি শতাংশই চীনা পুলিশ প্রশিক্ষণ পেয়েছে। এমনকি প্রায় এক-তৃতীয়াংশ পূর্ণ গণতন্ত্রও সীমিতভাবে এই প্রশিক্ষণ নিয়েছে, যা মূলত ভাষা বা সমন্বয়–দক্ষতা বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে। আফ্রিকা, মধ্য এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর অংশগ্রহণ সবচেয়ে বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে, আফ্রিকায় চীনা বিনিয়োগ ও বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পগুলো রক্ষার আগ্রহই এই প্রশিক্ষণকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।
চীনারা কি স্বৈরশাসন রপ্তানি করছে?
চীনের দাবি—তারা কোনো শর্ত ছাড়াই সাহায্য করে। কিন্তু বাস্তবে তাদের প্রশিক্ষণে ভিআইপি সুরক্ষা, দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণ এবং ভিড়–মনিটরিংয়ের মতো বিষয়গুলো এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যা স্বৈরশাসকদের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী। এর বিনিময়ে এই নেতারা প্রায়ই চীনের ভূখণ্ডগত দাবিগুলো সমর্থন করে। গবেষণা বলছে—স্বৈরাচারী দেশে হুয়াওয়ের প্রযুক্তি ব্যবহারের মাত্রা বাড়লে সেখানে ডিজিটাল দমন–নীতি বেড়ে যায়, অথচ গণতান্ত্রিক দেশে এই প্রভাব দেখা যায় না। অর্থাৎ, যেসব দেশের সরকার ইতিমধ্যে দমনমূলক প্রবণতা রাখে, চীনের প্রযুক্তি তাদের সক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়; আর যেখানে গণতান্ত্রিক কাঠামো শক্তিশালী, সেখানে প্রযুক্তি অপব্যবহার করার সুযোগ কম।
যেসব দেশ চীনের পথ অনুসরণ করছে
কাজাখস্তান ২০২২ সালের অস্থিরতার পর পুরো শহর জুড়ে চীনা নজরদারি ক্যামেরা স্থাপন করে। বহু বিশ্লেষক মনে করেন তারা শিনজিয়াংয়ে ব্যবহৃত নজরদারি মডেলকে অনুসরণ করছে। আলমাটি বিমানবন্দরে দুর্নীতিবিরোধী কর্মী সানঝার বোকায়েভকে শুধুমাত্র মুখ শনাক্ত হওয়ার কারণে আটক করা হয়—যদিও তিনি কোনো অপরাধ করেননি।

অস্থিতিশীলতা কমে কি?
ইথিওপিয়া এই প্রশ্নের সবচেয়ে বড় উদাহরণ। দেশটি চীনা প্রশিক্ষণ, চীনা সেন্সরশিপ ব্যবস্থা এবং চীনা নজরদারি প্রযুক্তির ভারী উপস্থিতিতে আরও নিয়ন্ত্রিত হয়ে উঠেছে। কিন্তু একই সময়ে দুই প্রদেশে সশস্ত্র বিদ্রোহ দেখা দিয়েছে, তীব্র জাতিগত উত্তেজনা তৈরি হয়েছে এবং ইরিত্রিয়ার সঙ্গে নতুন যুদ্ধের সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছে। ফলে চীনের সহায়তা পাওয়া মানেই স্থিতিশীলতা—এ ধারণা ভুল।
‘স্বৈরতন্ত্রের সরঞ্জাম–বাক্স’
চীন অত্যন্ত কৌশলে অবদমন–ক্ষমতা বাড়ালেও প্রকাশ্যে কখনও স্বৈরশাসন সমর্থন করে না। বরং তারা দেশগুলোকে এমন সরঞ্জাম দেয়—যা ব্যবহার করে দেশগুলো নিজেরাই তাদের নাগরিকদের ওপর নিয়ন্ত্রণ জোরদার করতে পারে। উদাহরণ হিসেবে সার্বিয়াকে ধরা যায়। একটি চীনা–নির্মিত রেল স্টেশনের ছাদ ধসে ১৬ জন মারা গেলে দেশজুড়ে গণবিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে, অথচ সার্বিয়ার ৮১% মানুষ এখনও চীনের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রাখে। কারণ চীন কখনও মূল্যবোধ–ভিত্তিক রাজনৈতিক অবস্থান নেয় না এবং কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সংকট নিয়ে মন্তব্যও করে না। ফলে দেশগুলোর জনগণ পশ্চিমাদের তুলনায় চীনের প্রতি কম শঙ্কিত থাকে।
প্রতিযোগিতা কঠিন: প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জে নতুন বাস্তবতা
সলোমন দ্বীপপুঞ্জসহ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অনেক দেশে চীনা প্রশিক্ষণ পুলিশ বাহিনীকে রাষ্ট্ররক্ষাকারী বাহিনীতে পরিণত করছে—যারা জনগণের সেবাদাতা নয় বরং সরকারের স্বার্থরক্ষাই প্রধান কাজ হিসেবে দেখছে। অস্ট্রেলিয়া বাধ্য হচ্ছে চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে, যা বিশ্লেষকেরা “উপহার–প্রতিযোগিতা” বলে আখ্যা দিয়েছেন—যেখানে চীনের চেয়ে বেশি সহায়তা দিয়ে দেশগুলোকে নিজেদের প্রভাব–বৃত্তে রাখতে হয়। সলোমন দ্বীপপুঞ্জ এখন নিজস্ব সেনাবাহিনী গঠনের পরিকল্পনা করছে। অধিকাংশ দেশ এটিকে বিপজ্জনক পদক্ষেপ মনে করলেও অস্ট্রেলিয়া হয়তো ভয়ে সমর্থন দেবে—না হলে দেশটি চীনের দিকে ঝুঁকে যেতে পারে।
দ্বিপাক্ষিক নিরাপত্তার ‘দুটি মডেল’
বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্ব এমন এক পর্যায়ে যাচ্ছে যেখানে অভ্যন্তরীণ দমন–ক্ষমতা দেবে চীন, আর বাহ্যিক প্রতিরক্ষা দেবে যুক্তরাষ্ট্র। ভিয়েতনাম ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ অনেক দেশই এই দ্বিমুখী নিরাপত্তা–ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। এটি হবে আরও বেশি লেনদেনভিত্তিক, কম আদর্শগত এবং এমন এক কাঠামো যেখানে রাষ্ট্র শক্তিশালী হবে, কিন্তু নাগরিকেরা দুর্বল হয়ে পড়বে।
#চীন #নিরাপত্তা_রপ্তানি #জিএসআই #নজরদারি_প্রযুক্তি #স্বৈরশাসন #আন্তর্জাতিকরাজনীতি #এশিয়াপ্যাসিফিক #ক্ষমতাসংকোচন #সারাক্ষণরিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















