বিক্রি বাড়ছে, বাড়ছে উদ্বেগও
চীনের বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতা বিএইডি ইউরোপের বাজারে নতুন নিবন্ধনের দিক থেকে ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, জার্মানি ও ফ্রান্স থেকে শুরু করে পূর্ব ইউরোপের ছোট ছোট দেশগুলোতেও কোম্পানিটির গাড়ি আগের চেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে। তুলনামূলক কম দামের মডেল, নিজস্ব ব্যাটারি প্রযুক্তি ও রাষ্ট্রীয় সহায়তাপ্রাপ্ত অর্থায়নের সমন্বয়ে বিএইডি দ্রুত তার উপস্থিতি বাড়াতে পেরেছে বলে বিশ্লেষকদের মত।
একীভূত সরবরাহ–শৃঙ্খলই এই বাড়তি শক্তির মূল ভিত্তি হিসেবে দেখা হচ্ছে। ব্যাটারি থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ অনেক যন্ত্রাংশ নিজস্ব কারখানাতেই তৈরি করায় উৎপাদন ব্যয় কম থাকে; সে কারণে প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় দাম কম রেখেও মুনাফা করা সম্ভব হয়। ইউরোপীয় অনেক ব্র্যান্ড যখন মূল্য কমিয়ে বিক্রি টানতে গিয়ে চাপের মুখে, তখন বিএইডি বড় পরিসরের উৎপাদনের সুবিধা কাজে লাগিয়ে বিক্রি বাড়িয়ে চলেছে। স্থানীয় বিক্রেতা নেটওয়ার্ক ও শোরুমও ধীরে ধীরে প্রসারিত হচ্ছে।
তবে নীতি–নির্ধারকেরা এ ট্রেন্ডকে নিছক বাজার প্রতিযোগিতা হিসেবে দেখছেন না। ইউরোপীয় কমিশন ইতোমধ্যে চীনা ইভি নির্মাতারা অতিরিক্ত ভর্তুকি পাচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে তদন্ত শুরু করেছে। প্রমাণ পাওয়া গেলে শুল্কসহ নানা বাণিজ্যিক প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে বলে ইঙ্গিত মিলেছে। ইউরোপের গাড়ি নির্মাতা ও শ্রমিক ইউনিয়নগুলো বলছে, ব্যাপক হারে সস্তা আমদানি দীর্ঘমেয়াদে স্থানীয় কারখানা বন্ধ ও বড় আকারে চাকরি হারানোর ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। বিএইডি অবশ্য দাবি করছে, তারা প্রযুক্তি ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার জোরে প্রতিযোগিতা করছে।
গ্রাহকদের প্রতিক্রিয়া এখনো মিশ্র; তবু আগ্রহ বাড়ছে। তুলনামূলক দীর্ঘ রেঞ্জের ব্যাটারি, উন্নত ফিচার আর কম দাম অনেক ক্রেতাকেই চীনা মডেলের দিকে টানছে। আবার অনেকে প্রশ্ন তুলছেন দীর্ঘমেয়াদি নির্ভরযোগ্যতা, সার্ভিস নেটওয়ার্কের ঘনত্ব ও গাড়ির সফটওয়্যার থেকে সংগৃহীত তথ্যের নিরাপত্তা নিয়ে। চীন–পশ্চিমের ভূরাজনৈতিক টানাপোড়েনের প্রেক্ষাপটে যে কোনো ডিজিটাল সংযোগযুক্ত পণ্য নিয়েই সন্দেহ কিছুটা বেশি; ইভি তার বাইরে নয়। কেউ কেউ আবার অপেক্ষা করছেন ইউরোপীয় শুল্ক সিদ্ধান্তের জন্য, ভবিষ্যতে অতিরিক্ত কর আরোপে যন্ত্রাংশের দাম ও সার্ভিসের খরচ বাড়বে কি না তা দেখার জন্য।
স্থানীয় উৎপাদন ও নীতির টানাপোড়েন
রাজনৈতিক ঝুঁকি কমাতে এবং স্থানীয় জনগণের আস্থা অর্জনে বিএইডি ইউরোপে আরও কারখানা বা অ্যাসেম্বলি প্ল্যান্ট গড়ার পরিকল্পনা করছে। ইতোমধ্যে ঘোষিত প্রকল্পের পাশাপাশি নতুন কয়েকটি দেশে শিল্পাঞ্চল খোঁজার কথা জানিয়েছে কোম্পানিটি। এ ধরনের কারখানা চালু হলে স্থানীয় লোকজনের জন্য নতুন চাকরি তৈরি হবে; একই সঙ্গে চীন থেকে সরাসরি গাড়ি আমদানির ওপর নির্ভরতা কমে সম্ভাব্য শুল্কের চাপও কমতে পারে।

এর বিপরীতে ইউরোপীয় সরকারগুলোকে জলবায়ু লক্ষ্য ও শিল্পনীতি একসঙ্গে সামলাতে হচ্ছে। বহু দেশ কার্বন নিঃসরণ কমাতে দ্রুত ইভি গ্রহণকে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে দেখছে, আর সাশ্রয়ী দাম না থাকলে মধ্যবিত্তের বড় অংশকে পুরোনো গাড়ি থেকে সরানো কঠিন হবে। খুব বেশি সুরক্ষাবাদী ব্যবস্থা নিলে দাম বাড়বে, ফলে সবুজ পরিবর্তনের গতি কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকছে। এই দ্বিধা থেকেই ব্রাসেলস ও বিভিন্ন রাজধানীতে বাণিজ্য নীতি নিয়ে উত্তপ্ত আলোচনা চলছে।
ইউরোপের ঐতিহ্যবাহী গাড়ি নির্মাতারা কেবল অভিযোগ না করে নিজেদের ব্যবসা পুনর্গঠনের পথও খুঁজছে। অনেকেই উৎপাদন ব্যয় কমাতে কারখানা পুনর্বিন্যাস, মডেল কমিয়ে সবচেয়ে লাভজনক ইভিতে জোর দেওয়া ও ব্যাটারি অংশীদারিত্ব দ্রুত বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। আবার কেউ কেউ নির্দিষ্ট যন্ত্রাংশে চীনা সরবরাহকারীদের সঙ্গেও কাজ করছে, যদিও একই সঙ্গে ‘অন্যায্য প্রতিযোগিতা’র অভিযোগও তুলছে। বিনিয়োগকারীরা তাকিয়ে আছেন—বাজার কি অনেক খেলোয়াড় নিয়ে চলবে, নাকি বিএইডির মতো কয়েকটি উচ্চ স্কেলের কোম্পানি শেষ পর্যন্ত দখল নেবে।
ড্রাইভারদের জন্য আপাতত সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হচ্ছে বিকল্পের সংখ্যা বাড়া। এখন অনেক ক্রেতাই বাজেটের মধ্যে ইউরোপীয়, কোরিয়ান ও চীনা মডেলের রেঞ্জ, চার্জিং গতি ও সফটওয়্যার ফিচার তুলনা করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। যেসব দেশে চার্জিং অবকাঠামো দ্রুত গড়ে উঠছে, সেখানে বিএইডির উপস্থিতি বেড়ে যাওয়ায় ইভি বাজারে মূল্য প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হবে—এমন ধারণা করছেন বিশ্লেষকেরা।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















