যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউক্রেন সংকট সমাধানের জন্য যে থ্যাংকসগিভিং–এর সময়সীমা নির্ধারণ করেছিলেন, তা থেকে সরে এসেছেন। শান্তি প্রতিষ্ঠায় তাঁর আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও স্পষ্ট হচ্ছে—বর্তমান উদ্যোগ খুব শিগগির কোনো সমাধান আনতে পারবে না। তাঁর বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ ও রাশিয়ার কর্মকর্তাদের মধ্যে মস্কোতে যে বৈঠক হচ্ছে, সেটিও রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনের ইতি টানার মতো কোনো চুক্তির সম্ভাবনা তৈরি করছে না।
শান্তি আলোচনার মূল বাধা
কিয়েভ ও মস্কোর অবস্থানের ব্যবধান এখনও তীব্র ও স্পষ্ট। দুই পক্ষের অনমনীয় অবস্থান ত্যাগ না করার পেছনে রয়েছে বিপুল আত্মত্যাগ, উদ্বেগ এবং রক্তপাতের ইতিহাস। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ডোনেৎস্কের পূর্বাঞ্চল নিয়ন্ত্রণে রাখার দাবিতে অনড় থাকবেন—আগামী দিনগুলোতে তা আরও স্পষ্ট হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ প্রস্তাব, যা তাঁর দিকেই যাচ্ছে, গত সপ্তাহে ফাঁস হওয়া খসড়া পরিকল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ ছাড় বাদ দিয়েছে। এই ছাড় বাদ পড়ায় ইউক্রেন বা তার ইউরোপীয় মিত্ররা কোনো সামরিক বা রাজনৈতিক যুক্তি খুঁজে পাচ্ছে না। গত দশ বছরের যুদ্ধ, রাশিয়ার তিন দফায় ইউক্রেনে হামলা, ব্যর্থ কূটনৈতিক আলোচনা ও প্রতারণার ইতিহাস বিবেচনায় মস্কোর সদিচ্ছা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
বারবার ব্যর্থতার কারণ
দুই আলাদা আলোচনাপথে ইউক্রেনের সঙ্গে এক ধরনের এবং রাশিয়ার সঙ্গে আরেক ধরনের চুক্তি করার প্রচেষ্টা কখনোই দুই পক্ষকে বাস্তবিকভাবে কাছে আনতে পারেনি। কাগজে–কলমে অগ্রগতি দেখা গেলেও বাস্তবে তা ফলপ্রসূ হয়নি। ফারাক রয়ে গেছে, দাবিদাওয়াও একই জায়গায় আটকে আছে। তাই আলোচনায় অগ্রগতি যেন খুব কাছাকাছি মনে হয়, আবার নাগালের বাইরে থেকেও যায়।
চুক্তির তাত্ত্বিক প্রস্তাব
চুক্তির নানা দিক এখনো তাত্ত্বিক ও অনিশ্চিত—ভবিষ্যৎ জোট, অর্থায়ন বা সামরিক সীমাবদ্ধতার মতো বিষয়গুলো বাস্তবে কতটা কার্যকর হবে, তা অনিশ্চিত। অতীতের নানা সমঝোতার মতো এসব প্রস্তাবও সময়ের বাস্তবতায় বদলে যেতে পারে বা হারিয়ে যেতে পারে। বাস্তবে যদি শান্তি আসে, তবে ইউক্রেনের ছয় লাখ সেনাবাহিনীর প্রস্তাবিত সীমা অর্থহীন হয়ে পড়বে। যুদ্ধোত্তর অর্থনৈতিক সংকট সামাল দেওয়া, সৈন্য কমানো এবং স্থিতি ফিরিয়ে আনার চ্যালেঞ্জ তখনই বড় হয়ে উঠবে। ন্যাটো–সদস্যপদ তখন যেমন কম প্রয়োজনীয় মনে হতে পারে, তেমনি তা বাস্তবায়নও কঠিন হবে। রাশিয়া যদি জি–৮–এ ফিরতে চায়ও, ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে পুতিনের পুনরায় হাত মেলানো এখনো অবিশ্বাস্য। ইউক্রেন পুনর্গঠনের ব্যয় কে বহন করবে—উভয় দেশের অস্বচ্ছ ব্যবসায়িক কাঠামোর কারণে এটিও সহজ বা স্বচ্ছ প্রক্রিয়া হবে না।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন
মূল প্রশ্ন একটাই—চুক্তি কি যুদ্ধ থামাতে পারবে? ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি আবারও এক ভয়াবহ দ্বিধার মুখে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেওয়া ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিশ্চয়তার মূল্য কত—তার বিপরীতে ডোনেৎস্কের অংশ রাশিয়াকে দিলে ইউক্রেনের রাজনৈতিক ও সামরিক অবস্থানে যে ক্ষতি হবে, তা কতটা সহনীয়? যদি চুক্তি টিকে থাকে, তবে সেটি কঠিন কিন্তু বাস্তব সিদ্ধান্ত। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে যদি রাশিয়া আগের মতো চুক্তি ভঙ্গ করে, তবে এই সিদ্ধান্ত কার্যত কোনো সিদ্ধান্তই থাকবে না।
ইউক্রেনের অভ্যন্তরীণ সংকট
এই কূটনৈতিক বাস্তবতার পাশাপাশি জেলেনস্কির সামনে রয়েছে বহু অভ্যন্তরীণ সংকট। ট্রাম্পের সময়সীমা রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্র দখল করলেও শুক্রবার জেলেনস্কির প্রশাসনে নতুন দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। দুর্নীতি দমন সংস্থা তাঁর প্রধান সহকারী ও আলোচনার প্রধান প্রতিনিধি আন্দ্রি ইয়েরমাকের বাসায় তল্লাশি চালিয়েছে। একই সঙ্গে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী তীব্র জনবল সংকটে ভুগছে। আগামী বছরের ইউরোপীয় অর্থায়ন কী হবে তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে, যদিও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলেছে তারা ঘাটতি পূরণ করতে পারে। অন্যদিকে যুদ্ধক্ষেত্রে তিন দিক থেকে রাশিয়ার অগ্রগতি ইউক্রেনকে বিপদে ফেলেছে—জাপোরিঝিয়ায় দ্রুতগতির অগ্রগতি, দোনেৎস্কের পোকরোভস্কে ধীর কিন্তু নিশ্চিত অগ্রগতি এবং উত্তরাঞ্চলে কুপিয়ানস্কে সম্প্রসারণ। এত কম সৈন্য নিয়ে এত ফ্রন্টে লড়াই চালানো ইউক্রেনের জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
মাঠের বাস্তবতা
ডোনেৎস্কের ইউক্রেন–নিয়ন্ত্রিত অংশ শীতে আরও ঝুঁকিতে পড়েছে। ক্রামাতোরস্কে রাশিয়ার স্বল্প দূরত্বের ড্রোন হামলা শুরু হয়েছে। মস্কোর বাহিনী এতটাই নিকটে যে ইউক্রেন অদূর ভবিষ্যতে কোনো এলাকা পুনরুদ্ধার করতে পারবে—এমন আশা নেই। এখন ইউক্রেন ও তার মিত্রদের হিসাব যুদ্ধ কীভাবে ঘুরিয়ে দেওয়া যায় সে বিষয়ে নয়; বরং রাশিয়ার ভেতরে চাপ কতটা বাড়ানো সম্ভব এবং রাশিয়া আগে ভেঙে পড়বে কি না—সে প্রশ্নে এসে দাঁড়িয়েছে। বন্ধ সমাজে ভাঙনের সম্ভাবনা অনুমান করা কঠিন। ২০২৩ সালে ওয়াগনার বিদ্রোহ প্রথমে অবিশ্বাস্য মনে হলেও মাত্র ৭২ ঘণ্টায় প্রিগোজিনের যোদ্ধারা যখন মস্কোর দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, পরিস্থিতি পুরোপুরি বদলে গিয়েছিল। ইউক্রেনের সংকট আরও প্রকাশ্য, আরও তীব্র এবং আরও তাৎক্ষণিক।

জেলেনস্কির ভবিষ্যৎ লড়াই
আগামী পথ জেলেনস্কির জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। রাশিয়া এখন বেশি প্রস্তুত, বেশি সম্পদশালী এবং যুদ্ধক্ষেত্রে অগ্রগতির ধারায় রয়েছে। ইউক্রেনের জন্য এটি অস্তিত্বের লড়াই—রাশিয়ার মতো ইচ্ছামতো যুদ্ধ থামিয়ে দেওয়ার মতো অবস্থানে তারা নেই। গত ১০ মাসের কূটনৈতিক দোদুল্যমানতা এমন বাস্তবতা তৈরি করেছে যেখানে একসময় অকল্পনীয় মনে হওয়া কোনো চুক্তিও এখন সম্ভাবনার আলো দেখাচ্ছে। বছরের শুরুতে ইউক্রেন বা ইউরোপ কেউই ভূমি ছেড়ে শান্তি পাওয়ার ধারণা গ্রহণযোগ্য মনে করেনি। কিন্তু এখন সেই বিষয়টি ট্রাম্পের ২৮ দফা শান্তি পরিকল্পনার প্রথম সংস্করণে ঢুকে গেছে। যদিও ইউরোপের ফাঁস হওয়া পাল্টা প্রস্তাবে তা বাদ দেওয়া হয়েছে, পুতিনের দাবিতে তা অটল রয়েছে।
সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ
এখন একটি চক্র আবার পুনরাবৃত্তি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। উইটকফ মস্কো সফরে আবার শুনবেন—রাশিয়া ডোনেৎস্ক ছাড়া কোনো শান্তি চুক্তি করবে না। তিনি এই বার্তা ট্রাম্পকে জানাবেন। এরপর জেলেনস্কির ওপর আবার চাপ তৈরি হবে এবং হয়তো ট্রাম্প নতুন একটি সময়সীমাও ঘোষণা করবেন।
#Ukraine #Zelensky #Russia #Trump #PeaceTalks
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















