দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যায় মৃতের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। ইন্দোনেশিয়ায় অন্তত ১১১ জনের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে, আর থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলের একটি হাসপাতালে লাশ সংরক্ষণের জায়গা না থাকায় হিমায়িত ট্রাক ব্যবহার করতে হচ্ছে। টানা ভারী বর্ষণে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ থাইল্যান্ডের বহু এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে, হাজারো মানুষ আটকে পড়েছে এবং বহু জায়গায় ভূমিধসের ঘটনা ঘটেছে।
ইন্দোনেশিয়ায় মারাত্মক পরিস্থিতি
প্রাণহানি ও নিখোঁজ
ইন্দোনেশিয়ার উত্তর সুমাত্রায় বন্যা ও ভূমিধসে এই সপ্তাহে অন্তত ১১১ জন মারা গেছেন। প্রায় ১০০ জন এখনো নিখোঁজ বলে স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে।
উত্তর সুমাত্রা পুলিশের মুখপাত্র সিনিয়র কমিশনার ফেরি ওয়ালিনতুকান জানান, উদ্ধার অভিযান ও সহায়তা পৌঁছে দেওয়াই এখন মূল লক্ষ্য।
যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন
বন্যায় বহু এলাকা এখনো বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। তিনি বলেন, কিছু জায়গায় যোগাযোগ ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থা বন্ধ রয়েছে।
তাঁর ভাষায়, “আশা করি আবহাওয়া অনুকূলে এলে আমরা হেলিকপ্টার নিয়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পৌঁছাতে পারব।”
মেদানে জলাবদ্ধতা
সুমাত্রার রাজধানী মেদান শহরে কোমর–সমান পানি জমে গেছে। ঘরবাড়ি ডুবে যাওয়ায় অনেক বাসিন্দা রাস্তায় দাঁড়িয়ে গাড়িচালকদের অনুরোধ করছেন যেন তারা ধীরে গাড়ি চালান, যাতে ঢেউ উঠে ঘরের ভিতরের জিনিস আরও নষ্ট না হয়।
অনেকে বৃষ্টির মধ্যে চলাচল করতে রেইনকোট, পলিথিন কোট ও মোটরবাইক হেলমেট পরে রাস্তায় নেমেছেন।

আতঙ্কের অভিজ্ঞতা
পশ্চিম সুমাত্রার ৫৩ বছর বয়সী মিসনিয়াতি জানান, নামাজ পড়ে বাসায় ফেরার পথে হঠাৎ দেখেন রাস্তা পানিতে ভাসছে। দ্রুত বাড়ি ফেরার চেষ্টা করলে কোমর–সমান পানিতে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। প্রবল স্রোতের কারণে প্রায় পড়ে যাচ্ছিলেন তিনি।
বাড়ি পৌঁছে দেখেন পানির উচ্চতা বুক–সমান। তিনি বলেন, “আমরা পুরো রাত ঘুমাইনি, শুধু পানি বাড়ছে কি না দেখেছি।”
কারণ: মৌসুমি বৃষ্টি, ঝড় ও জলবায়ু পরিবর্তন
দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মৌসুমি বৃষ্টিতে প্রায়ই হঠাৎ বন্যা ও ভূমিধস হয়। এ মৌসুমের ভারী বৃষ্টি সাম্প্রতিক ট্রপিক্যাল ঝড়ের কারণে আরও তীব্র হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৃষ্টি ও ঝড়ের ধরনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে—ঝড়ের সময়কাল ও তীব্রতা বেড়েছে, বৃষ্টির পরিমাণও বেশি। উষ্ণ বাতাসে বেশি আর্দ্রতা থাকে, ফলে স্বল্পসময়ে প্রবল বর্ষণ নামছে। উষ্ণ সাগরও ঝড়কে আরও শক্তিশালী করে তুলছে।
সংরক্ষণবিদরা বলছেন, অত্যধিক উন্নয়নও বন্যা পরিস্থিতিকে ভয়াবহ করছে।
ইন্দোনেশিয়ান ফোরাম ফর দ্য এনভায়রনমেন্ট (WALHI)-এর কর্মী উলি আর্তা সিয়াগিয়ান জানান, “জঙ্গল কেটে পাম অয়েল বাগান, খনি ও অন্যান্য কার্যক্রম বাড়লে পানিনিয়ন্ত্রণের প্রাকৃতিক ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যায়।”
দক্ষিণ থাইল্যান্ডে মৃত্যু বাড়ছে
ছাদে আশ্রয়, মর্গে আর জায়গা নেই
থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলীয় হাত ইয়াই ও সঙ্গখলা প্রদেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। অনেক মানুষ ছাদের উপর দাঁড়িয়ে নৌকা দিয়ে উদ্ধারের অপেক্ষায় ছিলেন।
সঙ্গখলা প্রদেশে অন্তত ৫৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। সেখানকার প্রধান হাসপাতালের মর্গে জায়গা না থাকায় অতিরিক্ত লাশ রাখতে বাইরে হিমায়িত ট্রাক দাঁড় করানো হয়েছে।
হাসপাতালের এক কর্মকর্তা চার্ন জানান, “মর্গের ধারণক্ষমতা শেষ হয়ে গেছে, তাই অতিরিক্ত জায়গার প্রয়োজন।”

দ্রুত পানিবৃদ্ধি
বাসিন্দারা জানান, বৃহস্পতিবার হঠাৎ করেই পানি বেড়ে যায়।
৬৭-বছরের কামবান উংপানিয়া বলেন, “দ্বিতীয় তলার ছাদের কাছ পর্যন্ত পানি উঠে যায়। আমাকে নৌকায় করে উদ্ধার করা হয়েছে।”
দোকান মালিক চায়াফল প্রমক্লেং প্রথমে ভেবেছিলেন তার দোকান রক্ষা পাবে, কারণ পানি ছিল মাত্র গোঁড়ালি–সমান। কিন্তু পরদিন ফিরে দেখেন কোমর–সমান পানি দোকান ভরেছে। তিনি বলেন, “কিছুই করার ছিল না। জীবন বাঁচাতে দোকান ছেড়ে বেরিয়ে আসেছি।”
থাই সরকার জানিয়েছে, হাত ইয়াই জেলার প্রধানকে উদ্ধার কার্যক্রমে গাফিলতির অভিযোগে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
মালয়েশিয়ায় দুইজনের মৃত্যু
মালয়েশিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় পারলিস রাজ্যে ভারী বৃষ্টির বন্যায় দুইজনের প্রাণহানি ঘটেছে। বহু এলাকা পানিতে তলিয়ে আছে।
ইন্দোনেশিয়ার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া একই আবহাওয়া ব্যবস্থা শুক্রবার সকালে মালয়েশিয়ায় প্রবেশ করে। ঝড়ের শক্তি কিছুটা কমে গেলেও তা ব্যাপক বৃষ্টি বর্ষণ করেছে, যা বন্যা–কবলিত পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করেছে।
এই বন্যায় সামগ্রিকভাবে দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার তিনটি দেশ মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে—মৃত্যু বাড়ছে, মানুষ নিখোঁজ, এবং বহু এলাকা এখনো পানির নিচে। উদ্ধার ও সহায়তা অভিযান এখনও জোরদার চলছে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















