মাল্টি-ক্লাউড যুগে নির্ভরতার নতুন সমীকরণ
বহুদিনের প্রতিদ্বন্দ্বী গুগল ক্লাউড আর অ্যামাজন ওয়েব সার্ভিসেস এখন একই সঙ্গে হাত মিলাচ্ছে, সেটিও এমন এক জায়গায় যা দু’পক্ষেরই কৌশলের কেন্দ্রে। নতুন উদ্যোগে দুটি প্ল্যাটফর্মের মধ্যে তৈরি হবে সুরক্ষিত ব্যক্তিগত সংযোগ, যার মাধ্যমে কোম্পানিগুলো নিজস্ব কাজের চাপ এক ক্লাউড থেকে অন্য ক্লাউডে দ্রুত ও স্থিতিশীলভাবে পাঠাতে পারবে। আগে যেখানে এই ধরনের সংযোগ গড়তে সপ্তাহখানেক সময় আর আলাদা নেটওয়ার্ক প্রকৌশল দরকার হতো, সেখানে এখন লক্ষ্য “মিনিটের মধ্যে” লাইভ করে ফেলা। বড় বড় প্রতিষ্ঠানের জন্য এটি হচ্ছে এক ধরনের নিরাপত্তা জাল—কোনো একটি ক্লাউড হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেলে অন্যটিতে ঝটপট উঠিয়ে নেওয়ার সুযোগ।
এই সংযোগ বাস্তবে কাজ করবে টেলিকম অপারেটর বা নির্দিষ্ট ডেটা সেন্টারের ভেতর দিয়ে তৈরি ডেডিকেটেড লাইনে। গ্রাহকরা নির্দিষ্ট ব্যান্ডউইথ আর অঞ্চলের ভিত্তিতে অর্ডার করে নেবেন তাদের লিংক; একবার চালু হলে দুই ক্লাউডের মধ্যে ট্রাফিক যাবে কম ল্যাটেন্সি আর বেশি পূর্বানুমানযোগ্য গতিতে। তা কাজে লাগবে শেয়ারবাজারের লেনদেন, অনলাইন গেম, রিয়েল–টাইম অ্যানালিটিক্স বা ভিডিও–স্ট্রিমিংয়ের মতো সেবায়, যেখানে মিলিসেকেন্ডের দেরিও ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। প্রযুক্তি–পরিভাষায়, অনেকের কাছে গুগল ও এডব্লিউএস তখন আর দুই আলাদা দুনিয়া থাকবে না; বরং একই অবকাঠামোর দুই আলাদা জোনের মতো ব্যবহার করা যাবে।

মাল্টি–ক্লাউড ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ার বাস্তবতার সামনে এই পদক্ষেপকে অনেক বিশ্লেষকই বাস্তববাদী সমঝোতা হিসেবে দেখছেন। একক ক্লাউডে সবকিছু রাখলে সেই নির্দিষ্ট কোম্পানির আউটেজ, দাম বাড়ানো বা নীতিগত দ্বন্দ্বের ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়। আবার প্রতিটি প্ল্যাটফর্মের নিজস্ব শক্তি আছে—কোথাও ডেটা অ্যানালিটিক্স শক্তিশালী, কোথাও আবার মেশিন লার্নিং বা কনটেন্ট ডেলিভারিতে সুবিধা বেশি। ফলে বড় গ্রাহকেরা এখন চাইছেন ‘একটি–মাত্র’ ক্লাউডের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে, প্রয়োজনে সুবিধামতো একাধিক প্ল্যাটফর্মে কাজ ভাগ করে রাখতে।
সাম্প্রতিক কয়েকটি বড় আউটেজ প্রমাণ করেছে ক্লাউড ভেঙে পড়লে কত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে তার প্রভাব—একসঙ্গে থেমে যায় স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম, ই–কমার্স সাইট, এমনকি সরকারি সেবাও। নতুন এই ব্রিজ সেই সমস্যার পুরো সমাধান না করলেও স্থপতিদের হাতে বাড়তি অস্ত্র দিচ্ছে। একটি ব্যাংক ধরুন, তার মূল ডেটা ওয়্যারহাউস থাকতে পারে এক ক্লাউডে, আর রিয়েল–টাইম কপি আর ব্যাকআপ থাকবে অন্যটিতে; নতুন সংযোগের মাধ্যমে দু’দিকে তথ্য যাবে এনক্রিপ্টেড ভেতর–পথ ধরে। কোনো অঞ্চলে বড় সমস্যা হলে কয়েক মুহূর্তেই ট্রাফিক ঘুরিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে।
ডেটা সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা–ভাবনা
এত সব সুবিধার মধ্যেও নীতিনির্ধারকদের মাথায় ঘুরছে ডেটা কোথায় থাকবে আর কতটা নিয়ন্ত্রণ থাকবে জাতীয় আইনের আওতায়। স্বাস্থ্যতথ্য বা আর্থিক লেনদেনের মতো সংবেদনশীল ডেটা অনেক দেশেই সীমান্ত–পারের ক্ষেত্রে কড়া নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে। মাল্টি–ক্লাউড সংযোগের অদৃশ্য পথ যদি বেপরোয়া ব্যবহৃত হয়, তা আইনি গণ্ডি এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতাও তৈরি করতে পারে। গুগল আর অ্যামাজন বলছে, কোন অঞ্চলের মধ্যে ডেটা যাবে, কোন রুটে যাবে—সবকিছুই গ্রাহক ঠিক করবেন; তারপরও নিয়ন্ত্রকদের চোখে এটি অবশ্যই নজরদারির নতুন এলাকা।

নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞেরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, যেকোনো জটিল ব্যবস্থাকে জোড়া লাগালে সেখানে ভুল কনফিগারেশন বা অতিরিক্ত অনুমতির সুযোগ তৈরি হয়। কোনো ভঙ্গুর টেস্ট–এনভায়রনমেন্ট, ফাঁক থাকা ফায়ারওয়াল কিংবা ভুল রাউটিং নিয়ম হ্যাকারদের জন্য প্রবেশদ্বার হয়ে উঠতে পারে। বড় গ্রাহকরা তাই হয়তো শুরুতে সীমিত ক্ষেত্রে এই সুবিধা নেবেন—কম ঝুঁকির কাজ প্রথমে স্থানান্তর করবেন, পরে অভিজ্ঞতা থেকে নীতিমালা শক্ত করে ধীরে ধীরে গুরুত্বপূর্ণ সিস্টেম যোগ করবেন।
ছোট ব্যবসার জন্যও এ ঘোষণা অপ্রাসঙ্গিক নয়, যদিও তাদের অনেকেই এখনও একক ক্লাউডেই সব চালান। বড় প্রতিষ্ঠানের জন্য তৈরি হওয়া টুল অনেক সময়ই পরে সহজ প্যাকেজে গড়িয়ে যায় মাঝারি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ের কাছে। ভবিষ্যতে ম্যানেজড সার্ভিস প্রোভাইডাররা হয়তো ‘দুই ক্লাউড’–এর ওপর বসানো অ্যাপ্লিকেশন হোস্টিং প্যাকেজ দেবে, যেখানে গ্রাহককে নেটওয়ার্কের জটিলতা বুঝতেই হবে না।
শিল্প–বিশ্লেষকেরা তাই বলছেন, ক্লাউড বাজারে প্রতিযোগিতা এখন কেবল ডেটা সেন্টারের সংখ্যায় নয়; বরং কে কতটা নমনীয়, কে অন্য প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে কত সুন্দরভাবে কাজ করতে পারে, সেই মাপকাঠিতেও। গুগল–অ্যামাজনের এই সেতু সফল হলে, চাপ আসবে তৃতীয় আর চতুর্থ বড় খেলোয়াড়ের ওপর—তারাও যেন একই ধরনের সুবিধা দেয়। শেষ পর্যন্ত উপকারভোগী হবে সেই সব প্রতিষ্ঠান, যারা দীর্ঘমেয়াদি নির্ভরতা আর বিকল্প–স্বল্পতা, দুই–ই কমাতে চাইছে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















