থাইল্যান্ডের পাতায়ার আলো ঝলমলে স্ক্যামার অ্যালিতে ঢুকলেই স্পষ্ট বোঝা যায়, এখানে অর্থের স্রোত বয়ে যাচ্ছে—আর তার বড় অংশই প্রতারণার টাকা। এমনকি সাধারণ ট্যাক্সি চালক মেই-এর ব্যাংক হিসাবও এই জালিয়াতি তদন্তে আটকে গেছে। এই গল্প শুধু পাতায়া নয়, বরং থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, লাওস ও মিয়ানমারের বিস্তৃত মেকং অঞ্চলের কোটি কোটি ডলারের সাইবার প্রতারণা শিল্পের প্রতিচ্ছবি।
স্থানীয়দের ব্যাংক হিসাব জব্দ, বাড়ছে ভোগান্তি
মেই জানালেন, প্রতারকরা থাই নাগরিকদের নামে খোলা ব্যাংক হিসাবে কিউআর কোডের মাধ্যমে লেনদেন করে। এসব হিসাব বাস্তবে নিয়ন্ত্রণ করে বিদেশি সাইবার অপরাধীরা।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে থাই ব্যাংকগুলো হাজার হাজার সন্দেহজনক এমন হিসাব বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু এতে সাধারণ মানুষও বিপদে পড়ছেন।
মেই বলেন, এখানে প্রতিটি চালক, প্রতিটি ছোট ব্যবসায়ী—সবার অবস্থা একই। তাদের অর্থপ্রবাহ হঠাৎ আটকে গেছে।
মেকং অঞ্চলে প্রতারণার টাকার পাহাড়
মিয়ানমার, কম্বোডিয়া ও লাওসে ছড়িয়ে থাকা বৃহৎ সাইবার প্রতারণা কেন্দ্রগুলো প্রতিবছর চুরি হওয়া কোটি কোটি ডলার পাচার করে।
এই প্রতারণার অর্থ শুধু পাতায়ায় নয়—ব্যাংককের বিলাসবহুল ভিলা, নমপেনের রেস্তোরাঁ, ভিয়েনতিয়েনের দামি গাড়ি—সবখানেই ঢুকে যায়।
এ এমন এক সাম্রাজ্য, যার শিকড় বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের তথ্য অনুযায়ী, মেকং অঞ্চলের এসব প্রতারণায় বছরে চল্লিশ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি হারাচ্ছেন ভুক্তভোগীরা। তুলনা করলে, লাওসের পুরো আনুষ্ঠানিক অর্থনীতির আকার তারও কম।

বিশেষজ্ঞ জেসন টাওয়ার বলেন, অর্থনীতিতে যদি প্রতারণার টাকা প্রধান ভূমিকা নেয়, তাহলে প্রভাবশালী গোষ্ঠীরাও সেই অর্থে হাত রাখবে। ফলে সম্পত্তি, শপিং মল, বিলাসবহুল জীবনযাপন—সবই এই টাকার জোগানে বিকশিত হচ্ছে।
প্রতারণা চক্র ও ক্ষমতাবানদের যোগসূত্র উন্মোচিত
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সাম্প্রতিক অভিযানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ক্ষমতাবান মহলে ব্যাপক চাপ তৈরি হয়েছে।
চীন-কাম্বোডিয়ার ব্যবসায়ী চেন ঝির মালিকানাধীন শত শত মিলিয়ন ডলারের সম্পদ সিঙ্গাপুর, হংকং ও লন্ডনে জব্দ করা হয়েছে।
চেন-এর প্রতিষ্ঠান অভিযোগ অস্বীকার করলেও তদন্ত চলছে।
থাইল্যান্ড এখন নজরদারিতে রয়েছে, কারণ এখানকার কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির প্রতারণা অর্থের সঙ্গে যোগসূত্রের অভিযোগ উঠেছে।
থাইল্যান্ডের অর্থপাচার দমন সংস্থা জানিয়েছে, তারা তিনশ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি সম্পদ জব্দ করতে যাচ্ছে যা চেন ও ব্যবসায়ী ইয়িম লিকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে ধারণা করা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী অনুতিন চার্নভিরাকুল ঘোষণা দিয়েছেন—কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
কিন্তু তাঁর সরকারের এক উপপ্রধানমন্ত্রীর নামও প্রতারণার অর্থের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় সমালোচনা বাড়ছে।
সামাজিক মাধ্যমে উঠে আসা পুরনো ছবিতে অনুতিনকে দক্ষিণ আফ্রিকার এক ব্যক্তির সঙ্গে দেখা যাওয়ায় আরও প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।
বিরোধী নেতা রাংসিমান রোম বলেন, থাই মাটিতে প্রতারণা চক্র এতটা শক্তিশালী হয়ে উঠেছে—এটাই অবিশ্বাস্য।
মিয়ানমারে অভিযানে নাটকীয় মোড়
মিয়ানমারের সামরিক জান্তা যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের চাপের মুখে মিয়াওয়াদি সীমান্ত শহরের বড় বড় প্রতারণা কমপ্লেক্সে অভিযান শুরু করেছে।
হাজার হাজার বাংলাদেশি, চীনা, ইথিওপীয়, ভারতীয় ও ফিলিপিনো শ্রমিককে সেখান থেকে উদ্ধার করা হয়েছে—যাদের অনেকেই নির্যাতন ও আটক থাকার অভিযোগ করেছেন।
কিছু কমপ্লেক্স ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে, যেগুলো পরিচালনা করছিল জান্তা-সমর্থিত ডেমোক্রেটিক কারেন বেনেভোলেন্ট আর্মি।
এদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠী কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন দখল করা প্রতারণা কেন্দ্রগুলোতে সাংবাদিকদের প্রবেশের সুযোগ দিয়ে প্রমাণ দেখাচ্ছে, কিভাবে এসব চক্র বিশ্বব্যাপী প্রতারণা পরিচালনা করে। তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে—এ ধরনের কার্যক্রম আর চলতে দেওয়া হবে না।
তবুও সাইবার প্রতারণার ব্যবসা টিকে আছে।

চক্রের বড় কর্তা পালাচ্ছে, নতুন কেন্দ্র গড়ে উঠছে
থাই সীমান্ত নিরাপত্তা সূত্র জানিয়েছে, সিন্ডিকেটের উচ্চপর্যায়ের নেতারা ইতোমধ্যে তিন হাজার ডলার করে দিয়ে নিরাপদপথে মিয়ানমারের আরও গভীরে নতুন প্রতারণা ঘাঁটিতে চলে যাচ্ছে।
সূত্রটি বলেছে, তাদের ধরা যায় না; কারণ এখানে সবাই কোনো না কোনোভাবে ভাগ পায়।
শান রাজ্যের তাচিলাইক ও লাওসের ভিয়েনতিয়েন অঞ্চলের বর্জিত প্রকল্প এলাকাগুলোতে নতুন প্রতারণা কেন্দ্র গড়ে উঠছে।
জেসন টাওয়ার সতর্ক করে বলেছেন, এসব ছত্রভঙ্গ অভিযান হয়তো সমস্যা আরও ছড়িয়ে দেবে। প্রতারণা চক্রগুলি ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে পারে।
তিনি আরও জানান, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন গঠিত বিশেষ বাহিনী এখন ক্রিপ্টোকারেন্সি, বিশ্বজুড়ে জমি কেনাবেচা ও বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রতারণার অর্থ কোথায় যাচ্ছে তা অনুসন্ধান করছে—যা মেকং অঞ্চলের প্রতারণা অর্থনীতির বিরুদ্ধে বৈশ্বিক অভিযান হিসেবে দেখা হচ্ছে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাইবার প্রতারণা সাম্রাজ্য এতটাই বিস্তৃত যে তা স্থানীয় অর্থনীতি থেকে শুরু করে বৈশ্বিক রিয়েল এস্টেট পর্যন্ত জড়িয়ে গেছে।
চক্র ভাঙার চেষ্টা চলছে, কিন্তু সবাই যখন কোনো না কোনোভাবে লাভবান—তখন এই ভয়াবহ প্রতারণা যন্ত্র বন্ধ করাই সবচেয়ে কঠিন।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















