লেডি গাগার জীবন যেন বারবার ভেঙে গিয়ে আবার নতুন করে গড়া। মঞ্চে দাঁড়িয়ে থাকা মুহূর্তগুলোতে তিনি যতটা শক্ত, ব্যক্তিগত জীবনের অন্ধকার ঠিক ততটাই গভীর ছিল। সেই ভাঙা জায়গা থেকেই তিনি এবার ফিরে এসেছেন নিজের সবচেয়ে জোরালো অ্যালবাম নিয়ে। নাম ‘মেহেম’। আর এই ফিরে আসার পথ তাঁর কাছে ছিল যেমন বেদনাদায়ক, তেমনই মুক্তির।

মঞ্চে ওঠার আগেই যে আতঙ্কে কাঁপতেন গাগা
বর্তমান সফরে প্রতিদিনই মঞ্চে ওঠার আগে গাগার বুক ধড়ফড় করে ওঠে। লাল বিশাল পোশাকের ভেতর দাঁড়িয়ে দর্শকদের প্রস্তুত চিৎকার যখন ভেসে আসে, তখনও তিনি নিজেকে সামলাতে সময় নেন। একসময় এই উত্তেজনাই ছিল তাঁর বেঁচে থাকার কারণ। তখন তিনি বলতেন, মঞ্চের বাইরে নিজেকে মৃত মনে হয়। খাবারহীন, ঘুমহীন দিনগুলোতে তিনি শুধু একটাই জিনিসে ভর করতেন—গান।
সেই সময়ের গাগা নিজের ট্রমা চেপে রাখতেন। উনিশ বছর বয়সে সংগীত জগতের এক ব্যক্তির হাতে যে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, সেই মানসিক ক্ষত বারবার ফিরে আসত। অন্যদিকে ‘আর্টপপ’ অ্যালবামের সময় সমালোচনার মুখে পড়ে তিনি আরও ভেঙে পড়েন।
অন্ধকার থেকে মুক্তি, সিনেমা আর সংগীতের মাধ্যমে বাঁচার পথ
এই ধাক্কাগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে গিয়ে তিনি কখনও জ্যাজে আশ্রয় নিয়েছেন, কখনও সিনেমায়। টনি বেনেটের সঙ্গে তাঁর গান, পরে সিনেমায় তার সাফল্য—সবই ছিল নিজেকে ধরে রাখার চেষ্টা। কিন্তু মনের ভিতরে চলছিল একদম অন্য লড়াই। সিনেমা এ স্টার ইজ বর্ণ–এর শুটিংয়ের পর তাঁর মানসিক ভেঙে পড়া এতটাই তীব্র হয়েছিল যে তিনি হাসপাতালের শয্যায়ও পৌঁছে গিয়েছিলেন। তখন ভাবতেন, হয়তো আর কখনও ভালো হয়ে ওঠা সম্ভব হবে না।

গাগা বলেন, এই সময়টাতে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন প্রেমিক মাইকেল পোলানস্কি। এই মানুষটাই তাঁকে আবার নিজের ভেতর ফিরিয়ে এনেছেন। নিজের আসল সত্তাকে চিনতে সহায়তা করেছেন। তিনি গাগাকে কখনও অন্য নামে ডাকেন না, শুধু স্টেফানি।
সব ভেঙে আবার নতুন গাগার জন্ম
গাগা বলেন, দীর্ঘ মাসের সাধনা, গান, লেখা আর নিজের ভেতরে ফিরে যাওয়ার পথ তাঁকে এই নতুন অ্যালবাম তৈরি করতে সাহায্য করেছে। ‘মেহেম’ নামটাই এসেছে সেই অন্তর্দ্বন্দ্ব ও বিশৃঙ্খলার মধ্য থেকে। যেন হারিয়ে যাওয়া নিজেকে তিনি আবার ছুঁয়েছেন।
বর্তমান সফর ‘মেহেম বল’ তাঁর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় আয়োজন। কিন্তু গাগা বদলে গেছেন। আর তিনি উত্তেজনার নেশায় ভর করে নেই। বিশাল পোশাক, আলো, শব্দ—সবকিছু মিলিয়ে যখন মঞ্চে ওঠেন, প্রথম দেড় মিনিট তাঁকে শ্বাস ঠিক রাখতে চেষ্টা করতে হয়। নিজের মাইকের ফিডে তাঁর হাঁপ ধরা গলা প্রেমিক পোলানস্কিও শুনে ফেলেন।
গান শুরু হলেই বদলে যায় তাঁর শরীর-মন
প্রথম গান শেষ হতেই পরিস্থিতি পাল্টে যায়। “আব্রাকাদাব্রা” শুরু হলেই যেন তাঁর শরীর মনে করিয়ে দেয়—এটাই গাগা। বিগত বছরের কঠোর প্রস্তুতি তাঁকে মঞ্চে ফিরিয়ে আনে। দর্শকদের দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, “পাঞ্জা তুলে ধরো!” আর সেই মুহূর্তেই যেন গাগা নিজেকে খুঁজে পান।

নিজেকে নিয়ে গাগার নতুন বোঝাপড়া
তিনি আজ নিজের দুই দিককে এক মানুষ হিসেবেই দেখেন—গাগা আর স্টেফানি আলাদা নয়। তিনি বলেন, অন্যেরা কি ভাবল সেটা আর তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। এখন তিনি শুধু নিজের সত্য সত্তাকেই বাঁচাতে চান।
রিহার্সালেও চলছে নিজের সঙ্গে যুদ্ধ
ট্যুরের আগে লাস ভেগাসের এক খালি অডিটোরিয়ামে দেখা মেলে তিনটি গাগার—নাচের জন্য একজন, পোশাকে আরেকজন, আর অন্ধকারে দাঁড়িয়ে তাঁদের দেখছেন বাস্তব গাগা। এই ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র যেন তাঁর ভেতরের আলো–অন্ধকারের প্রতিচ্ছবি।
পুরনো হিট “শ্যালো” নতুনভাবে সাজাতে গিয়ে তৈরি হয়েছে নতুন নাটকীয়তা—মঞ্চের ওপর ছোট নৌকায় চড়ে মঞ্চের এক পাশ থেকে আরেক পাশে যাওয়া। সব মিলিয়ে পুরো শো যেন তাঁর অবচেতন মনের ভৌতিক নাটক।
নিজের অন্ধকার দিকের মুখোমুখি হওয়া
‘ডিজিজ’ গানটি থেকে তৈরি ভিডিওতে প্রথম জন্ম নেয় তাঁর অন্ধকার সত্তা “মেহেম”—যে গাগার নিজের দিকেই আঘাত হানে। সেই ভয়ের গল্প থেকেই এই অ্যালবামের জন্ম। আগের মতো নয়, এবার তিনি অন্ধকারকে চাপা দেননি; বরং তাকে চেনার চেষ্টা করেছেন।
জোকার চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পর সমালোচনা বাড়লেও সেই বিদ্রোহী মনোভাবই তাঁকে আরও সাহসী করেছে। এইসব অভিজ্ঞতা মিলেই তিনি আজকের গাগা—একসঙ্গে ভাঙা, আবার জোড়া লাগানো, আরও শক্ত।
লেডি গাগার এই যাত্রা শুধু সংগীতের নয়; নিজের সঙ্গে নিজের লড়াই জয় করার গল্প। অন্ধকার থেকে ফিরে এসে তিনি আজ বলতে পারেন, তিনি বেঁচে আছেন, সেরে উঠছেন, আর নিজের আলো ফিরিয়ে আনছেন।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















