১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশের অভ্যুদয় কোনো আকস্মিক ঐতিহাসিক দুর্ঘটনা ছিল না, কিংবা কেবল একটি সামরিক পরাজয়ের ফলও নয়। এটি ছিল রাজনৈতিক ভুলের দীর্ঘ শৃঙ্খল, কাঠামোগত অবিচার, নেতৃত্বের ব্যর্থতা এবং একের পর এক হাতছাড়া সুযোগের চূড়ান্ত পরিণতি—যার সূচনা হয়েছিল ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের অনেক আগেই। এই ভুলগুলোকে সৎভাবে বোঝা—অস্বীকার বা অতিরিক্ত আত্মদোষারোপ ছাড়া—শুধু ইতিহাসের স্পষ্টতার জন্য নয়, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে ন্যায়, পুনর্মিলন এবং আঞ্চলিক সহযোগিতার ভিত্তিতে ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্যও জরুরি।
ইতিহাস কেবল ভুলের জন্য জাতিকে শাস্তি দেয় না; ভুল থেকে শিক্ষা নিতে ব্যর্থ হলেই সে শাস্তি দেয়।
ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও বাংলা
উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে বাংলা কোনো প্রান্তিক প্রদেশ ছিল না; বরং ছিল তার বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক চালিকাশক্তি। স্যার সৈয়দ আহমদ খানের সংস্কারমূলক চিন্তা থেকে শুরু করে বাংলার বিপ্লবী রাজনীতি—সব ক্ষেত্রেই বাংলার মুসলমানরা মুসলিম রাজনৈতিক চেতনা গঠনে নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করেছিলেন।
১৯০৬ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ তার প্রাথমিক শক্তি পেয়েছিল বাংলার মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে। এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও খাজা নাজিমুদ্দিন কেবল প্রাদেশিক নেতা ছিলেন না; তারা ছিলেন মুসলিম রাজনীতির জাতীয় পর্যায়ের নেতৃত্ব। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব, যা পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করে, উত্থাপন করেছিলেন বাঙালি নেতা ফজলুল হক—যা পাকিস্তান আন্দোলনে বাংলার কেন্দ্রীয় ভূমিকার প্রতীক।
১৯৪৬ সালের নির্বাচন: উপেক্ষিত গণতান্ত্রিক ম্যান্ডেট
১৯৪৬ সালের নির্বাচন ছিল এক ঐতিহাসিক মোড়। সমগ্র ভারতে মুসলমানরা বিপুলভাবে মুসলিম লীগের পক্ষে ভোট দিয়ে তাদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের দাবিকে বৈধতা দেন। বাংলায় মুসলিম লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় প্রমাণ করে যে মুসলিম জাতীয়তাবাদ কোনো অভিজাত রাজনীতির কল্পনা নয়, বরং একটি গণআন্দোলন।
অদ্ভুতভাবে, ১৯৪৭ সালের আগে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে যে গণতান্ত্রিক ম্যান্ডেট এত দৃঢ়ভাবে রক্ষা করা হয়েছিল, স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের ভেতরেই—বিশেষত পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষেত্রে—তা ধীরে ধীরে ক্ষুণ্ন হতে থাকে। এই দ্বন্দ্বই পরবর্তীতে রাষ্ট্রকে তাড়িয়ে বেড়ায়।

মুসলিম লীগ নেতৃত্বে কাঠামোগত ভারসাম্যহীনতা
সংখ্যাগত শক্তি ও রাজনৈতিক অবদানের পরও মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী পরিসরে—বিশেষ করে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটিতে—বাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব ছিল অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে কম। ১৯৪৭ সালের পর ক্ষমতা ক্রমেই কেন্দ্রীভূত হয় পশ্চিম পাকিস্তানি অভিজাত, বেসামরিক আমলাতন্ত্র এবং পরে সামরিক প্রতিষ্ঠানের হাতে।
এই ভারসাম্যহীনতাই বিচ্ছিন্নতার প্রাথমিক বীজ বপন করে। মুসলিম ঐক্যের নামে গঠিত একটি রাষ্ট্র এমন এক কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থায় পরিণত হয়, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা রাজনৈতিক কর্তৃত্বে রূপ নেয়নি।
১৯৪৭–এর পর: ন্যায্য ক্ষমতা বণ্টনের ব্যর্থতা
স্বাধীনতার সময় পাকিস্তান গভীর কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ উত্তরাধিকারসূত্রে পায়, তবে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ন্যায্য ক্ষমতা বণ্টনের অভাব ছিল সবচেয়ে গুরুতর। পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক ক্ষমতা, সামরিক নেতৃত্ব ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ দৃঢ়ভাবে ছিল পশ্চিম অংশে।
পূর্ব পাকিস্তানের পাট রপ্তানি থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব জাতীয় আয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখলেও উন্নয়ন ব্যয় অসমভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে ঝুঁকে ছিল। এই বৈষম্য কেবল অনুভূত ছিল না; প্রামাণ্যভাবেও নথিবদ্ধ ছিল।
ভাষা প্রশ্ন: গভীর অবহেলার প্রতীক
ভাষা বিতর্ক কোনো বিচ্ছিন্ন ইস্যু ছিল না; এটি ছিল প্রাতিষ্ঠানিক অবহেলার প্রতীক। উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার জোরাজুরি উপেক্ষা করেছিল এই বাস্তবতা যে পাকিস্তানের জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা ছিল বাংলা।
১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারির মর্মান্তিক ঘটনায়, যখন বাংলার স্বীকৃতির দাবিতে শিক্ষার্থীরা শহীদ হন, পাকিস্তানের ভেতরে অধিকার প্রশ্নে প্রথম রক্তপাত ঘটে। এই মুহূর্তটি সতর্কবার্তা হওয়ার কথা ছিল; বরং তা আরও গভীর বিচ্ছিন্নতার পূর্বাভাসে পরিণত হয়।
সংবিধানের অনুপস্থিতি ও গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার ভাঙন
পাকিস্তানের অন্যতম গুরুতর ব্যর্থতা ছিল সংবিধান প্রণয়নে দীর্ঘ বিলম্ব। নয় বছর দেশটি স্থায়ী সংবিধান ছাড়াই চলেছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, আমলাতান্ত্রিক আধিপত্য এবং ১৯৫৮ সালের সামরিক হস্তক্ষেপ গণতান্ত্রিক মানদণ্ড ক্ষয় করে।
১৯৫৪ সালে বাঙালি দলগুলোর নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্ট পূর্ব পাকিস্তানে ভূমিধস বিজয় অর্জন করে। সেই ম্যান্ডেটকে সম্মান করা হয়নি। প্রাদেশিক সরকার বাতিল করা হয়, যা এই ধারণা দৃঢ় করে যে কেন্দ্রের অনুকূলে ফল এলে তবেই গণতন্ত্র গ্রহণযোগ্য।
মধ্যপন্থী নেতৃত্বের বিলোপ
১৯৬৩ সালে বৈরুতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর হত্যাকাণ্ড পূর্ব–পশ্চিম বিভাজন ঘোচাতে সক্ষম হাতে গোনা নেতাদের একজনকে সরিয়ে দেয়। তিনি একটি ফেডারেল, গণতান্ত্রিক পাকিস্তানে বিশ্বাস করতেন এবং পূর্ব পাকিস্তানে বিপুল জনপ্রিয় ছিলেন।
ঢাকায় তার জানাজা পরিণত হয় বিশাল জনসমাবেশে, যেখানে ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান ক্ষোভের স্লোগান শোনা যায়। মধ্যপন্থী নেতৃত্বের শূন্যতা ধীরে ধীরে আরও কট্টর বয়ানে পূরণ হয়।

১৯৬৫ সালের যুদ্ধ: কৌশলগত স্বল্পদৃষ্টি ও পূর্বাঞ্চলের অসুরক্ষা
ভারতের সঙ্গে ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান কার্যত অরক্ষিতই থেকে যায়। পূর্বাঞ্চলীয় ফ্রন্ট খোলার বা নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কোনো গুরুতর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বাঙালিদের কাছে এই অবহেলা কেবল সামরিক ছিল না; ছিল মানসিকও।
এই ধারণা দৃঢ় হয় যে পূর্ব পাকিস্তান ছিল ব্যয়যোগ্য—সমান অংশীদার নয়, বরং দরকষাকষির হাতিয়ার। জাতীয় ঐক্য আরও দুর্বল হয়।
১৯৭০ সালের নির্বাচন: মারাত্মক গণতান্ত্রিক ব্যর্থতা
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন পাকিস্তানকে সংকট থেকে বেরিয়ে আসার শেষ সাংবিধানিক সুযোগ দিয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে—একটি নজিরবিহীন গণতান্ত্রিক ম্যান্ডেট।
এই ম্যান্ডেট মানতে অস্বীকার করাই বিপর্যয় ডেকে আনে। রাজনৈতিক কৌশল, বিলম্ব ও অবিশ্বাস ব্যবধানকে আরও বাড়িয়ে তোলে। যা সাংবিধানিক আলোচনায় মীমাংসা হতে পারত, তা সংঘাতে নেমে যায়।
জাতীয়তাবাদ বনাম ফেডারেলবাদ: হারিয়ে যাওয়া কৌশলগত সুযোগ
আওয়ামী লীগের ‘বাংলাদেশ’ নাম গ্রহণ বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থানকে প্রতিফলিত করেছিল। প্রেক্ষাপটে তা বোধগম্য হলেও, এতে অনিচ্ছাকৃতভাবে প্রতিষ্ঠানের সেই বয়ান শক্তিশালী হয় যে আন্দোলনটি ছিল বিচ্ছিন্নতাবাদী, ফেডারেলবাদী নয়।
যদি দাবিটি ‘পূর্ব পাকিস্তান প্রজাতন্ত্র’ নামে উত্থাপিত হতো—কোরিয়া বা জার্মানির মতো বিভক্ত রাষ্ট্রের নজিরে—তবে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ গতিবিধি ভিন্ন হতে পারত। তবুও এতে কেন্দ্রের দায় লাঘব হয় না।
১৯৭১: অশ্রু ও ট্রমায় চিহ্নিত বিচ্ছেদ
১৯৭১ সালের ঘটনাবলি সহিংসতা, বাস্তুচ্যুতি ও বিপুল মানবিক দুর্ভোগে চিহ্নিত এক বিচ্ছেদে গিয়ে ঠেকে। এই ট্র্যাজেডি ছিল সবার—বাঙালি, পাকিস্তানি, সৈনিক, বেসামরিক মানুষ এবং উভয় পক্ষের শহীদদের।
ঢাকার পতন কেবল সামরিক পরাজয় ছিল না; ছিল নৈতিক ও রাজনৈতিক ধস।
পাঁচ দশক পর: সৎ আত্মসমালোচনার মুহূর্ত
পাঁচ দশক পর বাংলাদেশেও ইতিহাসের বয়ান বদলাচ্ছে। রাজনৈতিক পরিবর্তন ও নতুন নির্বাচন শাসনব্যবস্থা, ইতিহাস ও পরিচয় নিয়ে বিতর্ক নতুন করে উন্মুক্ত করেছে।
পাকিস্তানও—যদিও সীমিতভাবে—পুনর্মিলনের পথে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। ক্ষমতায় থাকাকালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের বাংলাদেশ সফর এবং তার অনুশোচনার প্রকাশ একটি প্রতীকী সূচনা ছিল।

অনুশোচনা থেকে পুনর্মিলন: ন্যায়ের বাস্তব উদ্যোগ
শুধু কথা যথেষ্ট নয়। বাস্তব পদক্ষেপই ঐতিহাসিক ভুলকে ভবিষ্যৎ সম্ভাবনায় রূপ দিতে পারে।
১৯৭১ সালের শহীদদের কবর জিয়ারত ও ফাতেহা পাঠ, যার মধ্যে বাংলাদেশে সমাহিত নিশান-ই-হায়দারপ্রাপ্ত শহীদ মেজর মুহাম্মদ আকরাম এবং নিহত বাঙালি বেসামরিক নাগরিকরাও অন্তর্ভুক্ত।
সম্পত্তি বিরোধ নিষ্পত্তি: পাকিস্তানে—বিশেষত করাচি ও অন্যান্য শহরে—বাঙালিদের রেখে যাওয়া সম্পত্তি আইনগতভাবে প্রকৃত উত্তরাধিকারীদের ফিরিয়ে দেওয়া। একইভাবে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও অন্যান্য স্থানে পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত সম্পত্তির বিষয়টি দ্বিপাক্ষিক কাঠামোর মাধ্যমে সমাধান।
নির্বাচিত বিস্মৃতি নয়, বরং ঐতিহাসিক স্বীকৃতি—একাডেমিক বিনিময় ও যৌথ গবেষণা উদ্যোগের মাধ্যমে।
বাণিজ্য, শিক্ষা, জলবায়ু সহনশীলতা ও আঞ্চলিক শান্তিতে সহযোগিতার নতুন অধ্যায়।
ভুলকে সম্ভাবনায় রূপান্তর
পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছেদ অনিবার্য ছিল না; ধারাবাহিক ব্যর্থতার ফলেই তা ঘটেছে। এই সত্য স্বীকার করা পাকিস্তানকে দুর্বল করে না; বরং তার নৈতিক ভিত্তি শক্ত করে।
জাতি পরিণত হয় অতীত অস্বীকার করে নয়, বরং সাহস ও সহমর্মিতায় তার মুখোমুখি হয়ে। ন্যায় যদি নীতিকে পথ দেখায় এবং পারস্পরিক সম্মান যদি কূটনীতিকে গড়ে তোলে, তবে ১৯৭১ সালের ক্ষত জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় রূপ নিতে পারে।
ভুল স্বীকার হলে তা সেতুতে পরিণত হতে পারে। ইতিহাস যদি শেখা হয়, তবে রাজনীতি যা একদিন বিভক্ত করেছিল, তা আবারও এক করতে পারে।
লেখক: পাকিস্তানের একজন সম্পাদক, গবেষক ও ভূ- রাজনীতি বিশেষজ্ঞ
মুবাশ্বির মীর 



















