স্বদেশ রায়
যে কোন জাতির প্রথম ও প্রধান কাজ তার শিশুদেরকে ভবিষ্যত মুখী করা। তা শিক্ষার ভেতর দিয়ে হোক আর জীবনচর্যার মধ্য দিয়ে হোক। ভবিষ্যত যেহেতু তাদের হাতে তাই জীবনের বোধ দিয়ে সে যাতে ছোটবেলা থেকেই ভবিষ্যতকে চিনতে পারে, ভবিষ্যত নিয়ে কল্পনা করতে পারে, ভবিষ্যতের ম্যাপ তৈরি করতে পারে সেই জগতটিই তাকে তৈরি করে দেয়া দরকার।
এখন প্রশ্ন আসে কে এই কাজটি করবে? আমাদের দেশে স্বাভাবিকভাবে বলা হয়, সব কাজ সরকারের। অতত্রব সরকার এ কাজ করবে। বাস্তবে সরকার কী- এই ধারনা জম্মানোর সুযোগ হয়তো আমাদের কম হয়েছে বলেই আমাদের মত দেশ গুলোতে সব দ্বায়িত্ব সরকারের কাঁধে চাপিয়ে দেয়া হয়। বর্তমান পৃথিবীর চাহিদাই কিন্তু কম সরকার। কেউ কেউ অবশ্য বলেন এটা ইউরোপয়িান এক ধরনের কল্পনা প্রবন মানুষের ধারনা ছিলো- কম সরকার বা ছোট আকারের সরকার, কিন্তু তা বাস্তব সম্মত নয়। তাদের সঙ্গে বির্তকে না গিয়েই বলা দরকার, কম সরকারই একটি রাষ্ট্র, সমাজ ও মানুষের জন্যে সব সময়ই ভালো। যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ে যে শিক্ষক সিলেবাসের পড়া কম পড়ান বাস্তবে তিনিই প্রকৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তেমনি যে সরকারকে সমাজ ও মানুষের জীবনে ও জীবনচর্যায় সব থেকে কম দেখা যায় সেই সরকারই ভালো সরকার।
এ কারনে শিশুদের ভবিষ্যতমুখী করার দ্বায়িত্ব কখনই শুধু সরকারের নয়, এটা গোটা সমাজ ব্যবস্থা, শিক্ষায়তন ও পরিবারের। শিশুরা সরাসরি শিক্ষা পায় শিক্ষায়তন ও পরিবার থেকে। আর পরোক্ষ শিক্ষা পায় সমাজ থেকে। তাই শিশুদের নিয়ে শিক্ষায়তন ও পরিবার এক ভাবে ভাববে আর রাষ্ট্র ও সমাজের মানুষ মিলে অন্যভাবে ভাববে।
পরিবার ও শিক্ষায়তন যেহেতু প্রত্যক্ষ শিক্ষা দেয় তাই তার শিক্ষা দেবার চরিত্র থেকে সমাজের শিক্ষা দেবার চরিত্রটি ভিন্ন হতে হয়। যেমন কেউ পড়ার রুমের জন্যে এক গুচ্ছ ফুল দিয়ে গেলে তখন ধরেই নেয়া হয় এ ফুলের সুবাস ঘরকে সুবাসিত করবে। কিন্তু পার্কে, রাস্তার পাশে, মাঠে বিদ্যায়তনে, বাড়ি বা ফ্লাটের বারান্দায় যদি ফুলগাছ থাকে তখন ফুলের সুবাস পাওয়াটা অভ্যাসের মধ্যে চলে আসে।
শিশুকে তার জীবনে ফুলের সুবাস পাওয়া অভ্যাসের মধ্যে আনতে হলে তাকে অবশ্যই এমনি ফুলের বাগানে বেড়ে ওঠার পরিবেশ দিতে হয়। শিশুকে ভবিষ্যতমুখী করার ক্ষেত্রটিও তেমনি- আর এক কারনে সমাজকে সেই পথে নিয়ে যেতে হয়- যাতে ফুলের সুবাস যেমন তার অভ্যাসে চলে যায় তেমনি ভবিষ্যতের পথে হাঁটাও তার অভ্যাসের অর্ন্তগত হবে।
বাস্তবে মানুষের ভবিষ্যতমুখী হওয়ার অর্থ কি? ভবিষ্যতমুখী অর্থাত্ বিজ্ঞানমুখী। আজ যে কম পক্ষে সত্তর হাজার বছরের সভ্যতা মানুষকে এখানে এনেছে- মানুষ কোন ডানায় ভর করে এখানে এসেছে? মানুষের সভ্যতার ইতিহাসের প্রতিটি পাতার দিকে তাকালে দেখা যায়, মানুষ বিজ্ঞানের ডানায় ভর করেই এখানে এসেছে। তার প্রতিটি পদক্ষেপ এগিয়েছে বিজ্ঞানের ওপর ভর করে। মানুষ যখন বিজ্ঞান বা বিদ্যাকে ত্যাগ করে অবিদ্যা বা বিজ্ঞাননির্ভর নয় এমন কিছুকে আকড়ে ধরতে গেছে তখনই মানুষ পিছে পড়ে গেছে।
কেউ কেউ মাঝে মাঝে এ নিয়ে ভুল ব্যখা দেয়। শুধু ভৌত বিজ্ঞানকে বিজ্ঞান বলে স্বীকৃতি দেয়। তারা খুঁজে দেখে না মানুষের সভ্যতা ভৌত ও সমাজবিজ্ঞান এই দুইয়ের ওপর ভর করেই এগিয়েছে। তাই যদি কখনও মনে করা হয় শুধু ভৌত বিজ্ঞানে ভর করে এগিয়ে যাবো তখন মানুষ নিজেকে মানুষের স্তর থেকে অন্যস্তরে নিয়ে যাবে। আবার ভৌত বিজ্ঞান ছাড়া সমাজবিজ্ঞানের কাঠামো তৈরি হয় না।
এ কারণে আগামীর জন্যে, বর্তমানের জন্যে বিজ্ঞান নির্ভর পরিবেশ গড়তে হলে অবশ্যই সমাজগঠন ও প্রায়োগিক বিজ্ঞান এই দুইয়ের দিকে অনেক বেশি জোর দিতে হয়। এই জোর দেবার কাজটি সমাজের অনেককে করতে হয়। যার ভেতর হয়তো এগিয়ে থাকে যারা শিক্ষায়তনের সঙ্গে জড়িত তারা। কারণ তারা নিজেদেরকে সারাক্ষণ চর্চার মধ্যে রাখতে পারে। আর শিশুরাও সরাসরি তাদের সংস্পর্শে থাকে। তারা যদি এ কাজটি করার ইচ্ছে করে তাহলে তাদের সীমাবদ্ধতাও কম। আধুনিক রাষ্ট্র ও রাজনীতির অবশ্য এখানে অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। কারণ, বর্তমান যুগে রাষ্ট্র দুটো কঠিন খাঁদে পড়ে গেছে। এক, জনতুষ্ঠি, দুই, অস্ত্র প্রতিযোগীতা। দুটোই অনেকটা বিষফোঁড়া- কিন্তু বর্তমানে বেশিক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে এখান থেকে বের হবার কোন উপায় নেই। এ এক শক্তিশালী চক্র।
তাই রাষ্ট্রকে পাশ কাটিয়েও শিশুদের জন্যে সমাজ ও সমাজের অনেককে ভাবার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। যেমন শিশুর সুকুমার বৃত্তিগুলোকে এবং চিন্তা শক্তিকে জাগ্রত করার জন্যে এক সময়ে এদেশের প্রতি রাস্তায় রাস্তায় ছবি আঁকা, নাঁচ শেখা, অভিনয় শেখা, গান শেখার স্কুল দেখা যেতো। আর বিজ্ঞান চর্চার জন্যে স্কুল কলেজ ভিত্তিক শুধু নয়, পাড়া মহল্লাতেও গড়ে উঠেছিলো বিজ্ঞান ক্লাব।
বাস্তবতা হচ্ছে দ্রুত সেগুলো কমে যাচ্ছে। কিন্তু পাশাপাশি এই সব সুযোগ এখন অনেকখানি স্ক্রীনে চলে এসেছে।হাতের স্মার্ট ফোনে চলে এসেছে। প্রযুক্তির এই সুফল যাতে ঘরে ওঠে সেটাই এখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ। শুধু শিশুদের দোষ দিয়ে লাভ নেই এই বলে যে স্মার্টফোন বা কম্পিউটারের স্ক্রীনে থাকা একটি মুর্খ জেনারেশন সামনে আসছে। বরং জ্ঞান যখন হাতের মুঠোয় এসেছে তখন তাকে প্রকৃত অর্থে ব্যবহার করে কীভাবে ভবিষ্যতের একটি উন্নত জ্ঞানী প্রজম্ম হিসেবে গড়ে তোলা যায় সেই চিন্তাই গুরুত্ব রাখে বেশি। দোষারোপ করা অতি সহজ কাজ। ভেঙ্গে ফেলাও অতি সহজ কাজ। গড়া ও এগিয়ে দেবার কাজটি সব সময়ই শুধু কঠিন নয়, বেশ ভারীও হয়। তবে সমাজের একটি শ্রেনীকে বা কয়েকজনকে এভার বহন করতেই হয়।
রোমান সম্রাটরা সম্রাজ্য গড়ে ছিলো কিন্তু ভবিষ্যতের সভ্যতা গড়েছিলেন মাত্র হাতে গোনা কয়েকজন গুনী। সব সভ্যতা, সব দেশ ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে গেছে এমনি হাতে গোনা কয়েকজন গুনী ও প্রজ্ঞাবানের হাত ধরে। এ কাজ সম্রাটের নয়। শিশুদের ভবিষ্যতমুখী করার কাজটিও এ মুহূর্তে এমনিভাবে সমাজ থেকেই নিতে হবে। রাষ্ট্র মাঝে মাঝে সে কাজে বাধাও দিতে পারে, সেটাকে হেমলক মনে করেই শিশুকে সভ্যতা ও দেশের স্বার্থে ভবিষ্যত মুখী করা ছাড়া কোন বিকল্প কোন কালেই ছিলো না।
লেখক: রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক সারাক্ষণ ও The present world.
Leave a Reply