০১:০৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৯ জুন ২০২৫

জীবন আমার বোন (পর্ব-৩৭)

  • Sarakhon Report
  • ১২:০০:৪২ অপরাহ্ন, রবিবার, ৩০ জুন ২০২৪
  • 17

মাহমুদুল হককে বাদ দিয়ে বাংলা উপন্যাসকে ভাবা ভুল হবে। বাংলাদেশে কেন মাহমুদুল হক বহু পঠিত নয় বা তাঁকে নিয়ে কম আলোচনা হয় এ সত্যিই এক প্রশ্ন। 

মাহমুদুল হকের সাহিত্য নিসন্দেহে স্থান নিয়েছে চিরায়ত সাহিত্যের সারিতে। 

তার উপন্যাস জীবন আমার বোন শুধু সময়ের চিত্র নয়, ইতিহাসকে গল্পের মধ্যে দিয়ে আনা নয় সেখানে রয়ে গেছে আরো অনেক কিছু। 

তরুণ প্রজম্মের পাঠকের কাজে তাই তুলে দেয়া হলো মাহমুদুল হকের এই অনবদ্য উপন্যাস জীবন আমার বোন। আর আগের প্রজম্ম নিশ্চয়ই নতুন করে আরেকবার গ্রহন করুক এক অমৃত সাহিত্য। – সম্পাদক

মাহমুদুল হক

‘দেশ দেশ ক’রে চাষার মতো অমন চিৎকার জুড়েছিস কেন? দেশ বলতে কি বুঝিস তুই? একটা আধপাতা বয়সের ছোকরা, কতোটুকু বোঝার ক্ষমতা আছে তোর? কবিতা লেখার নামে রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করছিস পাঁচ বছর; যখন দেখছিস কিচ্ছু হচ্ছে না তখন ষাঁড়ের মতো গায়ের জোর ফলিয়ে বলছিস এক্সপেরিমেন্টাল। ডিপার্ট- মেন্টাল হেডদের মোট ব’য়ে ব’য়ে নাড়ুবাবুটি সেজে কোনো রকমে সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছিস, কিন্তু ভাগ্যে চাকরি জোটেনি। নিজের বেকারত্ব নিয়ে হাবুডুবু খেতে খেতে এখন হঠাৎ দেশ দেশ ক’রে পাগলা হ’য়ে উঠেছিস, আমাদের ময়নার বাপ যেমনভাবে বলে জয়বাংলা কায়েম হ’লেই আর কাজ করাতে হবে না তার মেয়েকে! এটা আর কিছু নয়, ক্লাস পাবার জন্যে হেডস্যারদের ঝাঁকামুটে সাজা যেমন, বিজ্ঞাপনের’ টাকা মারার জন্যে সঙ্কলন বের করা যেমন, ঠিক তেমনি একটা কিছু! দেশের তুই কি বুঝিস?’

মুরাদ ফিরে এসে বসলো। বসার সময় হাতের বইগুলো ডিভানের ওপর ছুড়ে দিলো; বই ছুড়ে ডিভানটাকে সজোরে মারলো সে। তারপর আচমকা সেন্টার টেবিলে দুম ক’রে প্রচণ্ড কিল বসিয়ে বললে, ‘তুই একটা ইতর, জঘন্য তোর মন। কিসের জোরে কোন্ অধিকারে এত সহজে তুই এসব কথা বলতে পারিস?’

‘খাঁড়ের মতো চিৎকার করবি না। এটা রেক্স নয়, ভদ্রলোকের বাড়ি।’ ‘আমি চিৎকার করছি, না চিৎকার করছিস তুই? তুই একটা বদ্ধোন্মাদ।’

‘দাদা’

দরোজার ভারী পর্দার গা ধ’রে রজু এসে দাঁড়িয়েছে, খোকা দেখতে গেল। বললে, ‘ও কিছু না, তুই ভিতরে যা’ একটা সিগ্রেট ধরিয়ে সে আবার আগের জায়গাতেই এসে বসলো। বললে, ‘তোর সম্পর্কে কতগুলো বাজেকথা উচ্চারণ করতে হয়েছে, এজন্যে দুঃখিত। কিন্তু যা সত্যি তা বলতে আমি কারো চোখ রাঙানোর পরোয়া করি না। অধিকার আবার কিসের, সাহস লাগে নাকি এতে?’

মুরাদ ততক্ষণে বন্য পশুর মতো হিংস্র উত্তেজনাকে ঝেড়ে ফেলে অনেকটা সংযত হ’য়ে এসেছে। সে কতকটা সহজ হওয়ার অভিপ্রায়েই আহতকণ্ঠে বললে, ‘আমি তোর সঙ্গে ঝগড়া করতে আসিনি’ মুখের কথা কেড়ে নিয়ে খোকা বললে, ‘কিন্তু দরকার হ’লে মারা- মারিও তুই করতে পারিস।’

‘তোর আত্মম্ভরিতা সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে দিন দিন। তুই কি ভাবছিস না ভাবছিস তাতে আমার কিছু যায় আসে না, আমি শুধু গোটা সমস্যাকে দু’জনের মধ্যেকার ব্যক্তিগত ব্যাপার হিশেবে দেখতে চাইনি, যেটা তুই চাস। কথা হচ্ছিলো দেশ নিয়ে; তার ধারকাছ দিয়ে না গিয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি শুরু করে দিলি তুই। নিছক মাতলামি ছাড়া আর কি বলবো একে! দেশ বলতে তোদের ধানমন্ডির এই বাড়ি নয়, যা ঘুষের পয়সায় তোর বাবা তৈরি করেছে। দেশ মানে খান সাহেবদের দালালি নয়। দেশ মানে ভক্ত কুকুরের মতো প্রভুদের পা চাটা নয়। এই যে হারামির পয়সায় থরে থরে সাজানো তোর ঘর, চারপাশের রাশি রাশি বই, আলস্য আরাম ঘুম, দেশের চেহারাটা ঠিক এর উল্টোটাই।’

 

 

 

জীবন আমার বোন (পর্ব-৩৭)

১২:০০:৪২ অপরাহ্ন, রবিবার, ৩০ জুন ২০২৪

মাহমুদুল হককে বাদ দিয়ে বাংলা উপন্যাসকে ভাবা ভুল হবে। বাংলাদেশে কেন মাহমুদুল হক বহু পঠিত নয় বা তাঁকে নিয়ে কম আলোচনা হয় এ সত্যিই এক প্রশ্ন। 

মাহমুদুল হকের সাহিত্য নিসন্দেহে স্থান নিয়েছে চিরায়ত সাহিত্যের সারিতে। 

তার উপন্যাস জীবন আমার বোন শুধু সময়ের চিত্র নয়, ইতিহাসকে গল্পের মধ্যে দিয়ে আনা নয় সেখানে রয়ে গেছে আরো অনেক কিছু। 

তরুণ প্রজম্মের পাঠকের কাজে তাই তুলে দেয়া হলো মাহমুদুল হকের এই অনবদ্য উপন্যাস জীবন আমার বোন। আর আগের প্রজম্ম নিশ্চয়ই নতুন করে আরেকবার গ্রহন করুক এক অমৃত সাহিত্য। – সম্পাদক

মাহমুদুল হক

‘দেশ দেশ ক’রে চাষার মতো অমন চিৎকার জুড়েছিস কেন? দেশ বলতে কি বুঝিস তুই? একটা আধপাতা বয়সের ছোকরা, কতোটুকু বোঝার ক্ষমতা আছে তোর? কবিতা লেখার নামে রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করছিস পাঁচ বছর; যখন দেখছিস কিচ্ছু হচ্ছে না তখন ষাঁড়ের মতো গায়ের জোর ফলিয়ে বলছিস এক্সপেরিমেন্টাল। ডিপার্ট- মেন্টাল হেডদের মোট ব’য়ে ব’য়ে নাড়ুবাবুটি সেজে কোনো রকমে সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছিস, কিন্তু ভাগ্যে চাকরি জোটেনি। নিজের বেকারত্ব নিয়ে হাবুডুবু খেতে খেতে এখন হঠাৎ দেশ দেশ ক’রে পাগলা হ’য়ে উঠেছিস, আমাদের ময়নার বাপ যেমনভাবে বলে জয়বাংলা কায়েম হ’লেই আর কাজ করাতে হবে না তার মেয়েকে! এটা আর কিছু নয়, ক্লাস পাবার জন্যে হেডস্যারদের ঝাঁকামুটে সাজা যেমন, বিজ্ঞাপনের’ টাকা মারার জন্যে সঙ্কলন বের করা যেমন, ঠিক তেমনি একটা কিছু! দেশের তুই কি বুঝিস?’

মুরাদ ফিরে এসে বসলো। বসার সময় হাতের বইগুলো ডিভানের ওপর ছুড়ে দিলো; বই ছুড়ে ডিভানটাকে সজোরে মারলো সে। তারপর আচমকা সেন্টার টেবিলে দুম ক’রে প্রচণ্ড কিল বসিয়ে বললে, ‘তুই একটা ইতর, জঘন্য তোর মন। কিসের জোরে কোন্ অধিকারে এত সহজে তুই এসব কথা বলতে পারিস?’

‘খাঁড়ের মতো চিৎকার করবি না। এটা রেক্স নয়, ভদ্রলোকের বাড়ি।’ ‘আমি চিৎকার করছি, না চিৎকার করছিস তুই? তুই একটা বদ্ধোন্মাদ।’

‘দাদা’

দরোজার ভারী পর্দার গা ধ’রে রজু এসে দাঁড়িয়েছে, খোকা দেখতে গেল। বললে, ‘ও কিছু না, তুই ভিতরে যা’ একটা সিগ্রেট ধরিয়ে সে আবার আগের জায়গাতেই এসে বসলো। বললে, ‘তোর সম্পর্কে কতগুলো বাজেকথা উচ্চারণ করতে হয়েছে, এজন্যে দুঃখিত। কিন্তু যা সত্যি তা বলতে আমি কারো চোখ রাঙানোর পরোয়া করি না। অধিকার আবার কিসের, সাহস লাগে নাকি এতে?’

মুরাদ ততক্ষণে বন্য পশুর মতো হিংস্র উত্তেজনাকে ঝেড়ে ফেলে অনেকটা সংযত হ’য়ে এসেছে। সে কতকটা সহজ হওয়ার অভিপ্রায়েই আহতকণ্ঠে বললে, ‘আমি তোর সঙ্গে ঝগড়া করতে আসিনি’ মুখের কথা কেড়ে নিয়ে খোকা বললে, ‘কিন্তু দরকার হ’লে মারা- মারিও তুই করতে পারিস।’

‘তোর আত্মম্ভরিতা সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে দিন দিন। তুই কি ভাবছিস না ভাবছিস তাতে আমার কিছু যায় আসে না, আমি শুধু গোটা সমস্যাকে দু’জনের মধ্যেকার ব্যক্তিগত ব্যাপার হিশেবে দেখতে চাইনি, যেটা তুই চাস। কথা হচ্ছিলো দেশ নিয়ে; তার ধারকাছ দিয়ে না গিয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি শুরু করে দিলি তুই। নিছক মাতলামি ছাড়া আর কি বলবো একে! দেশ বলতে তোদের ধানমন্ডির এই বাড়ি নয়, যা ঘুষের পয়সায় তোর বাবা তৈরি করেছে। দেশ মানে খান সাহেবদের দালালি নয়। দেশ মানে ভক্ত কুকুরের মতো প্রভুদের পা চাটা নয়। এই যে হারামির পয়সায় থরে থরে সাজানো তোর ঘর, চারপাশের রাশি রাশি বই, আলস্য আরাম ঘুম, দেশের চেহারাটা ঠিক এর উল্টোটাই।’