আফ্রিকাতেও কিরণ দেয় আমাদের এই একই সূর্য’। কিন্তু সূর্য সেখানে মাটির অনেক কাছে, তাই রোদ হয় কাঠ-ফাটা। আর সিংহ ভাবে সূর্য বোধ হয় দুটো: একটা গরম, একটা ঠান্ডা।
সিংহ থাকে খাঁচায়। যেন লাইন-টানা কাগজের ওপর আঁকা। আঁকা হয়েছে হলুদ-বাদামী রঙে। সিংহের আধখানায় ঘন, লম্বা লম্বা চুল, অন্য আধখানা রোগা, লোম-ছাঁটা, মসৃণ। হয়ত আধখানায় তার সর্বদাই গরম লাগে, অন্য আধখানায় ঠান্ডা।
খাঁচায় থাকলে শুধু এক জায়গাতেই থাকতে হয়, কিছুই ভালো করে দেখা হয় না। যেমন, শুঁড়-ওয়ালা একটা মাথা দেখতে পায় সিংহ, কুলো-পানা তার কান। কিন্তু মাথার ওই মালিকটির পা কটা, তা সে জানে না। নাকি তিমি মাছের মতো লেজ নেড়ে সে সাঁতরাচ্ছে? ক্ষর-ওয়ালা চারটে সর, সরু ঠ্যাঙ দেখতে পাচ্ছে সিংহ, আর সে ঠ্যাঙ থেকে কোথায় কোন গাছের মাথা ছাড়িয়ে ছোটো ছোটো শিও সমেত এইটুকু এক মুণ্ডু।
কিছু কিছু পড়শীদের সে আদৌ দেখতে পায় না। শুধু তাদের ডাক শোনে। ভাবে, যার ডাক যত জোরালো ততই সে হবে প্রকান্ড। অথচ সবচেয়ে জোরে চে’চামেচি করে কেবল হাঁসগুলো।
মাথা থেকে পা পর্যন্ত পুরোপুরি যাদের সে দেখতে পায়, তারা হল মানুষ।
ছোটো, বড়ো, কালো-চুলো, শণ-চুলো, চুপচাপ, কিচকি’চে নানান রকমের। লোকেই তাকে খাওয়ায়। রোগ হলে চিকিৎসা করে। এমনি স্রেফ দেখতে আসে। আর তার সম্পর্কে’ কে কী বলছে, আগ্রহ করে সিংহ তা শোনে।
‘সিংহের আধখানার লোম ছে’টে ফেলেছে, আধখানা ছাঁটা হয় নি,’ বাবাকে বলে ছোট্ট এক খুকি, আনমনার মতো মাথা নাড়ে বাবা।
সিংহ বোঝে যে ওটা ঠাট্টা, তাই আপন মনে হাসে: মোচ নাড়ায়। অসমান দাঁতের এক থোকা মায়ের হাত টানাটানি করে বলে: ‘আমায় একটা সিংহ কিনে দাও-না!’ ‘রাখব কোথায় শুনি?’
‘দিদিমার ঘরে।’
সঙ্গে সঙ্গেই খোকার হাত টেনে মা তাকে নিয়ে যায় সেই খাঁচাটার কাছে, যেখানে শাড়-ওয়ালা প্রকাণ্ড মাথাটা ভেসে আছে।
সারাদিন দর্শক এসেছে দেখতে। সিংহ হয় বসে থেকেছে নয় ছোটো ছোটো চামড়ার বালিশের মতো থাবার ওপর মাথা রেখে সটান হয়েছে। ঘুমের পর সে পিঠ বাঁকিয়ে খাঁচার কাঠের মেঝেতে ঘষে ঘষে শান দিয়েছে নখে।
রোজ দেখা হয় এমন বন্ধু সিংহের আছে। যেমন, পেত্রভ। সিংহকে মাংস খাওয়ায় পেত্রভ, খাঁচা পরিষ্কার করে। গা থেকে তার তামাকের গন্ধ ছাড়ত, মাঝে মাঝে মদের। তবে সহ্য করে যেত সিংহ। বন্ধুর জন্যে লোকে কী না সহ্য করে!
রোজ খাঁচার সামনে দিয়ে যেত মিলিশিয়াম্যান। ক্যাঁচ-ক্যাঁচ করত বেল্ট, ঝক-ঝক করত বোতাম। সিংহের দিকে চোখ মটকে সে বলত:
‘এই যে ভায়া!’
মোচ নাড়াত সিংহ, বাঁ চোখ কুচকে তুলত। মিলিশিয়াম্যানের নাম সে জানত না, তাই তাকে ডাকত ‘এই যে ভায়া’।
তাছাড়া সে চিনত আইসক্রীম-পশারিনীকে, মোটাসোটা, মুখখানা লাল। ঠান্ডা মাল বেচলেও সবসময়েই তার গরম লাগত। একবার সে আইসক্রীম দেয় সিংহকে। এতই তা সুস্বাদু যে সিংহ কাঠি সমেত গোটা জিনিসটাই গিলে ফেলে।
আর ছিল চিজিক। একটি বাচ্চা ছেলে সে। সিংহের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় তার। স্বপ্ন দেখত সে পেত্রভ হবে, সিংহকে খানা দেবে, সাফ করবে তার খাঁচা। একবার সিংহের পক্ষ নেয় চিজিক: সিংহ খাঁচায় থাকলে কেউ তাকে ভয় পায় না, এমনকি অপমান করতে, ঢিল মারতেও পারে।
এক ঢ্যাঙাকে একদিন ধমকেছিল চিজিক:
‘খবরদার, সিংহকে ঢেলাবি না বলছি!’
চিজিককে পিটিয়ে দেয় ঢ্যাঙাটা। অথচ সিংহ তার পক্ষ নিতে পারে না। খাঁচার মধ্যে ছটফট করে সে।
একবার গ্রীষ্মের সকালে সিংহের চোখে পড়ল খাঁচার দরজাটা যেন সামান্য খোলা। তা দেখে সিংহ থাবা দিয়ে সামান্য ঠেলা দিলে। ক্যাঁচকে চিয়ে খুলে গেল দরজা। নাক কোঁচকালে সিংহ, মোচ নাড়ালে, বেরিয়ে এল খাঁচা থেকে। ভাবলে একটু বেরিয়ে টেরিয়ে ফিরে আসবে। রাস্তার ভেজা বালিতে ধীরে ধীরে থাবা পেতে সিংহ হেলে দুলে এগুল। কোথাও যাবার তার তাড়া ছিল না। শুধু পায়চারি করে আর এদিক-ওদিক তাকায়।
শাঁড়-ওয়ালা মুণ্ডুটার নাম হাতি, দেখা গেল সে ভেসে থাকে না, লেজও তার তিমির মতো নয়, সাধারণ শুকনো লেজ, ডগায় চুল নেই। আর সরু সরু ঠ্যাঙগুলো আর ছোট্ট শিঙ-ওয়ালা মুণ্ডুটার মালিক কেবল একজনই জিরাফ! আর সবার চেয়ে জোরে চ্যাঁচায় হাঁসেরা।
ফুর্তি হল সিংহের, লেজ নেড়ে সে এগিয়ে চলল।
এক জায়গায় দেখা হল পেরভের সঙ্গে। খুশি হয়ে সিংহ কদম বাড়ালে। পেতভ কিন্তু থমকে গিয়ে টলতে টলতে পড়ে গেল মাটিতে। পেরভের কাছে এল সিংহ। কানে গেল যে পাহারাদারের বুক ধুক ধুক করছে, ভাবলে নিশ্চয় ঘুমচ্ছে। তাই ওকে ঘাঁটিয়ে লাভ নেই। ঘুমন্ত পাহারাদারকে ডিঙ্গিয়ে সিংহ এগুল ফটকের দিকে।
বেরিয়ে বেড়াবার সময় বন্ধুর দেখা পেলে খুবই আনন্দ হয় বৈকি। অচেনা জগতে মনে হয় নিশ্চিন্দি। শুধু একটা জিনিসে ভারি বিব্রত লাগল সিংহের পরিচিতদের অদ্ভুত সব ব্যবহার। ও কিছুতেই বুঝে পাচ্ছিল না কেন ওকে দেখেই মড়ার মতো ঘুমিয়ে পড়ার ইচ্ছে হল পেত্রভের, কেনই বা দৌড়বার দরকার পড়ল আইসক্রীম-পশারিনীর। অমন মোটাসোটা ভারিক্কী মেয়েটি যে অত জোরে ছুটতে পারে তা সিংহ কখনো কল্পনাও করে নি। সিংহের দিকে মাথাও নাড়লে না সে, আইসক্রীমের ভারি বাক্সটা মাটিতে ফেলে দিয়ে ছুট লাগালে। বাক্সের নিচে জমে উঠল শাদা মিষ্টি জল। সিংহ তা চেটে দেখলে, কিন্তু এবার আইসক্রীম তার পছন্দ হল না।
চট করেই সে শহরে ঢোকে নি। চিড়িয়াখানার গেটের কাছে খানিক দাঁড়িয়ে সে চেয়ে রইল শহরের অদ্ভুত, অপরিচিত জীবনযাত্রার দিকে। পাথুরে রাস্তার ধার বরাবর সারি দিয়েছে প্রকান্ড প্রকান্ড পাথরের খাঁচা, তাতে জানলা বসানো। কাছ দিয়ে যাচ্ছে লোক। অজস্র লোক।
অদ্ভুত এক ধরনের জানোয়ার দেখতে পেলে সিংহ, ঢিপ-ঢিপ চোখ তাদের কাচের, থাবাগুলো নরম, গোল-গোল। থামছে সেগুলো, লোক উগরে দিচ্ছে, ফের নতুন লোক গিলছে। এই নরখাদকদের লোকে ভয় পাচ্ছে না, নিজেরাই তারা ইচ্ছে করে ঢুকছে মুখ-গহ্বরে, সিংহের মনে হল যেন লোকের ভয়ই হচ্ছে পাছে তাদের খেয়ে নিতে জন্তুটার দেরি হয়।
কাঁধ নাড়ালে সিংহ। কেশর ঝাড়া দিলে এই ভাবেই ওরা সেজেগুজে নেয় তারপর এগুল শহরে।
সিংহ দেখে সবাই ছটে পালাল। জোয়ান, বুড়ো, লাল-চুলো, মুটকো, বড়ো, ছোটো, রোগা, টেকো, কোঁকড়া-গুলো সবাই যে যেমন পারে, হাঁস-ফাঁস করে, হোঁচট খেয়ে, লাফিয়ে লাফিয়ে, খুটখুটিয়ে ছুট লাগাল পাল্লা দিয়ে। ফুর্তিবাজ মিলিশিয়াম্যান ‘এই যে ভায়া’ গাছে উঠে
পাখির মতো পড়ে শিস দিতে লাগল যেন এক মস্ত নীলরঙা পাখি, কাঁধে তার লাল লাল লিরই ছোটাছুটিতে প্রথমটা সিংহের মজাই লেগেছিল। এমনকি নিজেও সে একটু পালক।
ছট লাগায়। লোকে কিন্তু হুটছিল তার চেয়েও জোরে। চোখ তাদের হয়ে উঠছিল গোল-গোল, ফ্যাকাশে মুখ, দু’ঠোঁট চাপা।
সিংহের ইচ্ছে হচ্ছিল ডেকে বলে:
‘আরে দাঁড়াও, ছুটছ কোথায়? এসো না একসঙ্গে যাই, ঘুরে বেড়াই, গরম হয়ে নিই রোদ্দুরে…’
কিন্তু বলতে গিয়ে তার মুখ দিয়ে যে হতাশ গর্জন বেরুল, তাতে আড়ষ্ট হয়ে গেল গোটা শহর।
গোল-গোল থাবার ওপর নীলরঙা জন্তুটার কাছে গেল সিংহ। শকে দেখল। আঁচড়াল থাবা দিয়ে। নীল জম্বুটা গজরালে না, খে’কালেও না। দাঁড়িয়ে রইল যেন, মাটিতে পোঁতা, লোকজন খাচ্ছে না, উগরেও দিচ্ছে না।
ফাঁকা শহরটায় ভয়-ভয় করে উঠল সিংহের এ যেন এক বিশাল অচেনা তৃণক্ষেত্র, সূর্য যেখানে ঠান্ডা। সবাই ফেলে পালিয়েছে তাকে। সবাই তার সঙ্গে বেইমানি করেছে। কিন্তু কী জন্যে? লোকেদের যে ও খুবই ভালোবাসে। চোখে জল এসে গেল সিংহের।
নির্ভীক উদারচেতা পশু সে। তাকে পশুরাজ বলা হয় এই জন্যে নয় যে তার জোর বেশি- হাতি, গণ্ডার, জলহস্তী তার চেয়ে অনেক বলবান। সিংহ পশুরাজ কারণ কখনো সে আড়াল থেকে আক্রমণ করে না, আর লড়াইয়ে নামার সময় আগেই হংশিয়ারি দেয়। কিছুতেই ভয় পায় না সে। কিন্তু ফাঁকা শহরে তার ভয় লাগল। নিঃসঙ্গতার জন্যে।
ঠান্ডা পাথরের ওপর বসলে সে মাথা হেট করে নিস্তব্ধতার মধ্যে হঠাৎ একটা পরিচিত পদশব্দ কানে এল তার। চাইতেই সে দেখলে চিজিককে। বইয়ের ব্যাগ দোলাতে দোলাতে ইশকুলে যাচ্ছিল ছেলেটা, গান গাইছিল শিস দিয়ে:
‘শি-শিউ-শে-শে!’
সিংহকে দেখে চিজিক ভয় পেলে না, বরং খুশিই হল সে। বললে:
জবাবে দীর্ঘশ্বাস ফেললে সিংহ।
‘ব্যাপারটা কী?’
সিংহ ঘাড় ঝাঁকিয়ে তাকালে মৃতপ্রায় শহরটার দিকে। চোখে পড়ল জানলা দিয়ে লোকে চেয়ে আছে তার দিকে।
‘চল যাই,’ বললে চিজিক। ‘মাথা হে’ট করিস না,’ বললে চিজিক। ‘আমারও অমন হয়,’ বললে চিজিক, ‘চল যাই।’
চলল তারা পাশাপাশি। চলল ফাঁকা শহরটা দিয়ে, লোকে তাদের দিকে চেয়ে চেয়ে অবাক হচ্ছিল, যেন অভাবনীয় কিছু একটা ঘটেছে। অথচ কিছুই ঘটে নি। স্রেফ দুই বন্ধুর দেখা হল, পাশাপাশি চলছে। এতে চোখ কপালে তোলার কী আছে?
শুধু সিংহটা এখন কোনো লাইন-টানা কাগজে নয়, শাদা কাগজে আঁকা।
পরে ঘটনাটা সবাই ভুলে গেছে। কিন্তু অনেকদিন সিংহকে এই প্রশ্নটা খাঁচিয়েছে: খাঁচায় থাকলে, সবাই তাকে কেন ভালোবাসে আর স্বাধীনতা পেলেই পালায়? খাঁচার ভেতরকার সিংহ আর ছাড়া-পাওয়া সিংহ তো একই সিংহ, উত্তরে শহর আর উত্তপ্ত আফ্রিকার আকাশে তো সেই একই সূর্য।
Leave a Reply