তুষ্টিদের স্কুলের বাউন্ডারির ভেতর একদিকে একটা পুকুর রয়েছে। চারপাশে ঝোপঝাড় আর বড় বড় জাম-কড়ই-র সারি। এদের জড়িয়ে ছড়িয়ে রয়েছে বুনো লতাগুল্ম। তুষ্টি সুযোগ পেলেই পুকুরপাড়ে এসে দাঁড়ায়। সে সাঁতার জানে না। জলের দিকে তাকিয়ে থাকে এক দৃষ্টে। নাইলটিকা মাছগুলো দলবেঁধে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ায়। একটা ঢোঁড়া সাপ প্রায়ই পুকুরের এমাথা-ওমাথা করে।
সাপ দেখলেই শরীরের লোম খাড়া হয়ে যায় তুষ্টির। ভয়ে ধুকপুক করে অন্তর। তবু সে তাকিয়ে থাকে সেদিকেই। হরর ছবি দেখার মতো অমোঘ এক আকর্ষণ বোধ করে নিজের ভেতর। কিছুতেই হেলাফেলা করা যায় না। দৃষ্টিটা আপনাআপনি হুমড়ি খেয়ে পড়ে সাপটার উপর। যে পর্যন্ত সরিসৃপটা হেলেঞ্চা-কলমির দামে না লুকোচ্ছে ততোক্ষণ ওর চোখের পাতা পড়ে না। মাঝে মাঝে এরকম সাপ আচমকা চোখের সামনে পড়ে গেলে খুব ইচ্ছে করে এর পিছু নিতে। ওর ঘর কোথায়, ও খায় কি, ফরফর করে উড়তে থাকা ঘাস-ফড়িংগুলোর সঙ্গে ওর কেমন সম্পর্ক Ñ সব জানতে চায় মন। অবশ্যই নিরাপদ দুরত্ব বজায় রেখে !
এসময় পাশে এসে দাঁড়ায় ওর সহপাঠী হাবিবা। ওর দিকে তাকিয়ে ভয়ার্ত কন্ঠে বলে ওঠে,‘এতক্ষণ ধরে জলের দিকে তাকিয়ে কি ভাবছিস রে তুষ্টি ?’
‘কিছু না ?’
‘কেন , তোর ভয় করে না ?’
‘ ভয় করবে কেন ?’ বিস্ময়ে সহপাঠীর দিকে তাকায় তুষ্টি।
‘কেন, তুই জানিস না, এই পুকুরে এক বুড়ি থাকে ?’
‘বুড়ি ?’ চোখ বড় বড় করে তাকায় তুষ্টি ওর দিকে।
‘হ্যারে। গতবছর দারোয়ান মামার ছয় বছরের বাচ্চাটা হারায়া গেল না ? তাকে খুঁজতে গিয়েই তো দমকলবাহিনীর এক ডুবুরি এই পুকুরের তলায় বাচ্চাটাকে খুঁজে পেল। জানিস, বাচ্চাটা এক ধবধবা সাদা রঙের বুড়ির কোলে শুয়ে আছিল।’ বলে দম নেয় হাবিবা। এমনভাবে বলছে যেন দৃশ্যটা সে দেখতে পাচ্ছে চোখের সামনে।
‘বাঁচল বাচ্চাটা ?’ তুষ্টির চোখে দুপুরবেলার আলো। নানারকম গাছ-গাছরার ভেতর দিয়ে নরোম হয়ে ওর তুলতুলে মুখে লুকোচুরি খেলছে।
‘না।’
সঙ্গে সঙ্গে তুষ্টি চাপা গলায় বলে উঠল,‘ওটা রাক্ষস।’ বলেই সে আর সেখানে দাঁড়ায় না। শ্রেণিকক্ষে এসে পড়ে। হাবিবার চোখেমুখে অজানা ভয়।
তুষ্টি সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। বাচ্চাটার জন্যে ওর মনটা বিষণœ হয়ে পড়ে। সে বারবার করে ভাবতে থাকে মৃত শিশুটির কথা। জলবুড়িটা এত নিষ্ঠুর যে একটা শিশুকে পর্যন্ত বাঁচাতে পারল না ? ওর মনে অভিমান জমা হতে থাকে। সে আর কোনোদিন ওই জলাশয়টার কাছে আসবে না। কারণ, জলবুড়িটা ভাল নয়, সে খুনি। কিছুতেই ওর স্বর্গীয়া ঠানদির সঙ্গে মিলে না ; তার মতো ভালবাসা আর মমতার রসে চুবানো রসগোল্লা নয় এই শয়তানীটা।
শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের জন্য তখনও শিক্ষক প্রবেশ করেননি। টিফিন পিরিয়ডের পর প্রথম পাঠদানের ঘন্টা। সময় হয়ে যাওয়ায় ওরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে শিক্ষকের জন্যে। রিতা আপা কড়া শিক্ষক। পান থেকে চুন কষতে পারে না। রেগে একেবারে আগুন। আর কারও পড়া না শিখে আসলেও হয় । কিন্তু রিতা আপার অঙ্ক ক্লাসে অমনোযোগী হলে আর রক্ষা নেই। সঙ্গে সঙ্গে ডাইরেক্ট এ্যাকশন।
তুষ্টির সেদিকে খেয়াল নেই। সে সেই টিয়াপাখিটার খোঁজ করতে থাকে বড় কড়ই গাছটার দিকে তাকিয়ে। হঠাৎ মনে হল, টিয়াটা ওর জানালার একেবারে সামনে এসে ডেকে উঠল। বলল,‘কেমন আছিস রে তুষ্টি ? আমরা চলে যাচ্ছি। শীতটা তোদের এখানে কাটিেেয় গেলাম। ’
‘কেন, চলে যাচ্ছো কেন ?’ ফিসফিস করে প্রশ্ন করে পাল্টা।
‘প্রচুর ধুলাবালি তোদের শহরে। গাছপালা নেই। তাই বনে ফিরে যাচ্ছি। ’
‘কোন বন ?’
‘হলুদবন। তোমাদের শহরে আমরা যারা হলুদবনের বাসিন্দা বেড়াতে এসেছি, সবাই মিলে একসঙ্গে যাবো তো। কটা দিন সময় লাগবে।’ বলেই উড়ে অন্য একটা ডালে গিয়ে বসল।
তুষ্টির মনটা খারাপ হয়ে গেল। ঠিক তখনি শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করলেন জাঁদরেল শিক্ষক রিতা আপা।
Leave a Reply