শিবলী আহম্মেদ সুজন
আলোচনায় দেখা যায় যে ঢাকাই মসলিন ঢাকায় উৎপাদিত কার্পাস দ্বারা তৈরী হত এবং ঢাকার দক্ষ কাটুনীরা ঢাকার কার্পাসকে সূক্ষ্ম সুতায় পরিণত করত। প্রশ্ন উঠে ঢাকাই মসলিনের সূক্ষ্মতা কি শুধু দেশে উৎপাদিত উওম কার্পাসের ফল, না ঢাকার দক্ষ কাটুনীদের ক্ষমতাই এর সূক্ষ্মতার মূল কারণ? ঢাকায় নিযুক্ত ইংরেজ বাণিজ্য বিষয়ক কর্মচারী (Commercial resident) জন টেলর ১৮০০ সালে মন্তব্য করেছেন’ যে ঢাকায় উৎপাদিত কাপাসের সঙ্গে পৃথিবীর অন্য কোথাও উৎপাদিত কার্পাসের তুলনা হয় না।
ঢাকাই কার্পাসের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ স্বরূপ তিনি বলেন যে, সমুদ্রের নিকটবর্তী হওয়ায় সমুদ্রের পানি মেঘনা নদীর দুই কূল বছরে কয়েকমাস প্লাবিত রাখে এবং এর ফলে যে পলিমাটি জন্মে তা কার্পাস উৎপাদনের জন্য অনেক উওম ; সামুদ্রিক বাতাসও কার্পাস উৎপাদনের বিশেষ সহায়ক। জন টেলর অবশ্য সরাসরি বলেননি যে, ঢাকায় উৎপাদিত কার্পাসের শ্রেষ্ঠত্ব ঢাকাই মসলিনের সূক্ষ্মতার মূল কারণ। কিন্তু তাঁর মতে ঢাকাই কার্পাস পৃথিবীর সকল কার্পাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ছিল।
Dr. Roxburghও বলেছেন যে, ঢাকার ফুটী কার্পাস অন্যান্য কার্পাসের চেয়ে উওম ছিল। যোগীশ চন্দ্র সিংহ প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে, ঢাকাই মসলিনের সূক্ষ্মতা ও শ্রেষ্ঠত্বের জন্য ঢাকায় উৎপাদিত কার্পাসের বিশেষ কোন দান নাই, বরং সুতা কাটুনী ও তাঁতিদের দক্ষতাই এর জন্য অনেকটাই দায়ী। প্রায় লেখকই মনে করেছেন যে, ঢাকাই কার্পাস খাট-আঁশ বিশিষ্ট ছিল, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ঢাকার ফুটী কার্পাস লম্বা আঁশ বিশিষ্ট ছিল।
ঢাকার ফুটী কার্পাস সূক্ষ্ম সুতা তৈরীর জন্য অত্যন্ত উপযোগী ছিল। কারণ ঢাকাই ফুটী কার্পাসের আঁশ অন্যান্য অঞ্চলে উৎপাদিত কার্পাসের আঁশের চেয়ে সূক্ষ্মতর (finer) এবং অধিকতর মসৃণ ও মোলায়েম (silky) ছিল। কোন কোন লেখক বলেছেন যে, ঢাকার বয়রাতি(নিম্নমানের তুলা) কার্পাসের দ্বারাই সূক্ষ্মতম মসলিন তৈরী হত, কিন্তু কথাটা সত্যি নয়। ১৭৮৮ সালে ঢাকাস্থ ইংরেজ বাণিজ্য বিষয়ক কর্মচারী সন্দীহীন ভাষায় বলেছেন যে, ফুটী কার্পাস দ্বারাই মসলিন তৈরী হত।
তাছাড়া যোগীশ চন্দ্র সিংহ মহাশয় কৃষ্ণ কুমার বসাক নামক একজন ভদ্রলোকের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন, যিনি অল্প বয়সে নিজে মসলিন তৈরী করতেন। সিংহ মহাশয় তাঁকে Watt-এর Wild and Cultivated Cotton Plants of the world নামক পুস্তিকায় ছাপান ঢাকাই ফুটী কার্পাসের চারাগাছের একটি ছবি দেখালে বসাক মহাশয় স্বীকার করেন যে, ঐ কার্পাসই মসলিন তৈরীর জন্য উত্তম ছিল। Dr.roxburgh ফুটা কার্পাসের উৎকর্ষের কয়েকটি কারণদিয়েছেনঃ
(ক) ফুটী কার্পাসের চারাগাছ ঋজু এবং খাড়া ছিল, এর ডালপালা অপেক্ষাকৃত কম ছিল এবং এর পাতার বিভিন্ন অংশ বেশ চিহ্নিত ছিল।
(খ) সম্পূর্ণ চারাগাছটি লাল রংএর ছিল, এমন কি পাতার বোঁটা এবং ভিতরকার রেখাগুলিও।
(গ) এর ফুলের ডাঁটাগুলি লম্বা ছিল এবং পাঁপড়ির বহিপ্রান্তও লাল রংবিশিষ্ট ছিল।
(ঘ) এর সুতার আঁশ অধিকতর লম্বা, অধিকতর মোলায়েম ও সূক্ষ্ম ছিল।
ঢাকার ফুটী কার্পাস নিঃসন্দেহে উৎকৃষ্ট ছিল, কিন্তু এ সত্বেও মনে হয় ঢাকাই মসলিনের উৎকর্ষ ও সূক্ষ্মতা বহুলাংশে নির্ভর করত সুতা কাটুনী ও তাঁতিদের দক্ষতার উপর।
অনেক ইউরোপীয় লেখক ঢাকাই মসলিনের সুতা কাটুনীদের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তাঁদের মতে এরূপ সূক্ষ্ম ও মিহি সুতা তৈরী, এবং তাও হাত চালিত একটি সামান্য টাকুর সাহায্যে, একমাত্র পাক-ভারতীয়দের দ্বারাই সম্ভব। তাঁরা বিনা দ্বিধায় স্বীকার করেছেন যে, কোন ইউরোপীয় তাঁতি এরূপ অসামান্য দক্ষতার অধিকারী হতে পারেনা। কারণ তাঁদের মতে ঢাকার প্রস্তুত সুতা, ম্যানচেস্টারের কলে প্রস্তুত সূক্ষ্মতম সুতার চেয়েও সূক্ষ্মতর ছিল।
জেমস টেলর বলেন, যদিও শত শত বৎসর ধরে পাক-ভারতীয় তাঁতিরা কাপড় প্রস্তুত করে দেশ-বিদেশে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে, ঢাকার মসলিনের মত এরূপ সূক্ষ্ম ও মিহি সুতী বস্ত্র পৃথিবীর অন্য কোথাও তৈরী হত না। অন্য এক লেখকের মতে, অনেকেই সত্যি মনে করত যে ঢাকাই মসলিন জীনপরীদের মত অশরীরী জীবেরাই তৈরী করত।
ঢাকায় উৎপাদিত কার্পাস অপেক্ষাকৃত উওম ছিল, কিন্তু ঢাকায় প্রস্তুত সুতা শ্রেষ্ঠতম ছিল। আগেই বলা হয়েছে যে জন টেলরের বিবরণে জানা যায় যে, ঢাকাই মসলিনের সুতা এত সূক্ষ্ম ছিল যে খুব অল্পসংখ্যক লোক এরূপ সুতা কাটার জন্য উপযুক্ত ছিল। কোন কোন ইউরোপীয় লেখক আবার মসলিনে ব্যবহৃত সুতার দোষেরও ইঙ্গিত করেছেন।
Leave a Reply