‘তুই শুধু চোখ দিয়ে দেখছিস কেন সবকিছু’
‘তুই দেখছিস কান দিয়ে খোকা অসহিষ্ণু হ’য়ে বললে, ‘তোর কি কখনো এইসব দুমদুমারি হট্টগোল দেখে অন্য কোনো কথা মনে আসে না? ওদের সঙ্গে আমাদের তফাতটা তাহলে রইলো কোথায়? তফাতটুকু কি তাহলে এইটুকুই- ওদের গায়ে খাকি পোশাক আমাদের গায়ে গামছা, ওদের পায়ে বুটজুতো আমাদের পায়ে চটি, ওদের কাঁধে অটোম্যাটিক রাইফেল আমাদের কাঁধে ইশলের বই! তফাতটা যদি কেবলমাত্র এইটুকু হয়, তার মানে এও দাঁড়ায়, প্রয়োজন হ’লে আমরা খাকি পোশাক পরবো, রাইফেল কাঁধে নেবো। কিন্তু খুব ভালো ক’রে খতিয়ে দেখলে ধরা যাবে ওরা যা, আসলেই আমরা তা নই। ওরা যা পারে আমরা তা পারি না। আমাদের তা পারা উচিত নয়। আমি পাঞ্জাবী সোলজারদের মতো হ’তে ভালবাসি- এই জাতীয় কথা উঠলেও ঘৃণায় শিউরে উঠবো আমরা। কিন্তু কেন? গুণ্ডামি পাণ্ডামি লুট হত্যা ধর্ষণের জাতীয় চরিত্র নেই ব’লে? ঠিক তা নয়; হয়তো উল্টোটা ব’লেই। আমরা মানুষ, হৃদয়হীন, চিন্তাশক্তিহীন রোবট নই; তুই আমার কথা শুনছিস?’
‘শুনছি” মুরাদ মাথা নেড়ে বললে, ‘আমরা যে কি মাল প্রত্যেকটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাই তা ব’লে দেবে-‘
খোকা মুরাদের কথার ধার দিয়েও গেল না।
সে বললে, ‘আমরা কি বলি? বলি পশুশক্তি! ওরা এক একটা জানোয়ার। আধা জানোয়ার থেকে এক লাফে পুরোপুরি জানোয়ার হওয়াটা এমন কোনো কঠিন ব্যাপার নয়, বরং সেটাই সহজ। আমরা এই আধা জানোয়ারের দুল সবসময় পুরোপুরি জানোয়ার হ’য়ে ওঠার জন্যে উদগ্রীব থাকি, প্যাচপেচে পরিবেশ দলদলে পরিস্থিতি এসব খুঁজি, সুযোগ পেলেই গর্জন ক’রে জাহির করতে চাই সেই পশুত্বকে। কিন্তু আমি বলছি ওরা প্রত্যেকে ভিন্ন ভিন্নভাবে এক একটি রোবট, নিছক পশু নয়। প্রয়োজনের খাতিরে আধা জানোয়ার থেকে পুরোপুরি জানোয়ার হ’তে পারি, কিন্তু বল, রোবট হ’তে পারবি, চিন্তা করতে পারিস তুই?’
‘ বরং তুই থাম খোকা। এখনই আমার গা ছমছম করছে। গ্লাসে ঢেলে যা গেলা যায়, তোর অভ্যেস মড়ার মাথার খুলিতে ঢেলে তা গেলা। তুই শালা বুজিংগো দলের পান্ডা; এক কাপ চাকে ইচ্ছে ক’রে হেমলক বানিয়ে ফেলিস!’
‘আমি কি খুব বাজে কথা বলছি?’
‘প্যাঁচ মারাটা তোর চিরকেলে স্বভাব। আন্দোলন ইজ আন্দোলন- খুব জোর দিয়ে মুরাদ বললে,’ রোবট আবার কি? আগেও বহুবার তুলেছিস কথাটা, আধুনিক মানুষ তোর কাছে নিছক রোবট।’
বাধা দিয়ে খোকা বললে, ‘রবার্টসনের টিটানের কথা তোর মনে আছে? তুই কি মনে করিস নিছক সাইন্স ফিকশন? তাহলে টাই- টানিকটা কি?’
মুরাদ বললে, ‘এখানে যা কিছু ঘটছে, কিংবা ঘটতে চলেছে, সেটা অভাবনীয় কিছু নয়, ইতিহাসের নিয়মেই তা হচ্ছে। বুজরুকি মেরে ধাপ্পা দিয়ে জনতার রুদ্ররোষকে ধামাচাপা দেওয়া এখন অসম্ভব। আজকের পৃথিবীর স্বাধিকার প্রমত্ত বলবান মানুষ তার দৃষ্টিকে আর আচ্ছন্ন রাখতে চায় না; তারা সদা সতর্ক। স্বাধিকারকে যা খর্ব করবে, নস্যাৎ ক’রে দেবে, এমন সবকিছুর ওপরই তারা আঘাত হানতে বদ্ধপরিকর।’
‘এসব ডাস্টবিনের কথা! বছরের পর বছর ওই একই গতে কথা ব’লে যাবি তোরা, তবু যাহোক ল্যাটিন আমেরিকার কথা ওঠেনি। তোর কথায় আজকের পৃথিবীর স্বাধিকারপ্রমত্ত মানুষের যে ছবিটা ফুটে উঠেছে তাতে তুড়িলাফ দেবার মতো তেমন কিছু নেই। খবরের কাগজের মাস- মাইনের রিপোর্টার কিংবা পেশাদার ভাড়াটে নেতাদের মতোই দায়সারাগোছের একটা চেহারা আঁকলি তুই। আজকের পৃথিবীর মানুষ বলতে গিয়ে তুই কিছুসংখ্যক মানুষকে একফালি তরমুজের মতো আলাদা ক’রে ফেলতে চাস। তার মানে গতকালকের পৃথিবীতে যে মানুষ ছিলো তাদের সঙ্গে এদের ঘোরতর প্রভেদ ধরতে পারছিস তুই। গতকালকের পৃথিবী সম্পর্কে তোর মনে নিশ্চয়ই কোনো স্বচ্ছ ধারণা জন্মেছে, তা না হ’লে ওই টনটনে ভেদজ্ঞানটা আসছে কোথেকে। এখন আমাকে বুঝিয়ে বল, গতকালকের সেই মানুষের সম্পর্কে তোর যাবতীয় ধারণার মূল সত্য কোন্টি, নাকি ওটা এমনিই কথার কথা?’
‘তার মানে তুই আমাকে ভূতের ভয় দেখাবি এখন, এই তো?
Leave a Reply