১০:১৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫

কিভাবে ঢাকাই মসলিন বোনা হতো ( শেষ পর্ব )

  • Sarakhon Report
  • ০৩:১৩:৪২ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৮ জুলাই ২০২৪
  • 19

শিবলী আহম্মেদ সুজন

ইস্ত্রি করা, রং করা সূচের কাজ করা

যারা মসলিন ইস্ত্রি করত, তাদের ইস্ত্রিওয়ালা বলা হত; এদের সবাই মুসলমান ছিল। মসলিন কাগজের ভাঁজে রেখে ইস্ত্রি করা হত, যাতে কাপড়ে দাগ না লাগে। ইস্ত্রি করা হয়ে গেলে মসলিন বাজারে ছাড়ার উপযুক্ত হত।

কিন্তু ক্রেতাদের চাহিদা মেটানোর জন্য কোন কোন মসলিনে সূক্ষ্ম সূচের কাজ (fineembroidery) করার নিয়ম ছিল। আবার কোন কোন সময় মসলিন রংও করা হত।

ঢাকার কারিগররা এত সুন্দর ভাবে সূচের কাজ করত যে, ইউরোপীয় লেখকেরা বিষয় বোধ না করে পারেনি। জেমস টেলর প্রমুখ ইংরেজ লেখকরা ঢাকার সূচের কাজের অনেক প্রশংসা করেছেন।

১৭৪৪ সালে ফ্রান্সের লেখক Abbede Guyon এর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন এবং বলেছেন যে, ফ্রান্সে যে সব চিকণ কাজ করা মসলিন দেখা যায় তা সবই ঢাকা থেকে আমদানীকৃত।

সূক্ষ্ম সূচের কাজকে যর-দো-জী বলা হত। মসলিনের উপর সোনা-রূপার বাদলা ও গুবরে পোকার ডানাও লাগান হত।

সোনা-রূপার বাদলা কয়েক প্রকারের ছিল; যেমন, মসলিনে ব্যবহৃত বাদলাকে গোলাপদাতন; টুপীতে ব্যবহৃত বাদলাকে গোশা; পাগরী, টুপী, চটীজুতা ও হুকার নলে ব্যবহৃত বাদলাকে সলমা; সোনার জরি ও বুটিদার জামায় ব্যবহৃত বাদলাকে বুলন বলা হত।

একটা মসলিনকে লম্বালম্বিভাবে একটি বাঁশের ফ্রেমের উপর বিছিয়ে প্রথমে তাতে নকশা আঁকা হত, তার পর যর-দজ-রা (চিকণ সূচের কাজে পটু লোক) তার উপর সূচ চালিয়ে জরির কাজ করত।

সুতার নাল কাটার জন্য তারা কাঁচি বা ছুরির পরিবর্তে সাধারণতঃ কাচ বা চীনা মাটির জিনিস ব্যবহার করত। রিফুকারদের ন্যায় যর-দজ-রাও নিজেদের মধ্যে শ্রেণীগতভাবে বসবাস করত এবং যর-দজ-রা সবাই মুসলমান ছিল।

যারা মসলিনের উপর ফুলের কাজ ও ঔপনিবেশিক করত, তাদের চিকণ দর্জি বা চিকণ কারিগর বলা হত। সাধারণতঃ মুসলমানদের জামা-কাপড়ের উপর ফুলের কাজ করা হত।

মসলিন-এর উপর মুগা সিল্ক দ্বারা ফুলের কাজ করাকে কসিদা বলা হত। কসিদা, যের-দজি বা চিকণ দর্জিদের কাজের মত অত সূক্ষ্ম ছিলনা।

কাপড়ে ঘর-দজি না করে কসিদার কাজ করার রেওয়াজ বেশী ছিল এবং সাধারণতঃ মুসলমান মেয়েরা অবসর সময়ে কসিদার কাজ করত।

কাপড়ের উপরে ফুল বা অন্যান্য চিত্র রং করে এঁকে এসব মেয়েলোকদের দেওয়া হত এবং তারা অবসর মত চিত্রগুলির উপর সূচ চালিয়ে কসিদার কাজ করত।

গাঁইট বাঁধা

সবার শেষে মসলিনের গাঁইট বাঁধার পালা। নারদিয়ারা কাপড় ভাঁজ করার পর একদল লোক কাপড়গুলি স্তূপাকৃতি করে কাপড়ের গাঁইট তৈরী করত।

এই লোকগুলিকে বস্তাবন্দ বলা হত। দুই তক্তার মাঝখানে কাপড়গুলি রেখে তক্তা দুটি ভাল করে এঁটে বেঁধে কাপড়ের গাঁইট তৈরী করা হত।

সূক্ষ্মতম মসলিনের এক একটি বাঁশের দুই গিরার মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গায় পুরে প্যাক করা হত। এভাবে প্যাক করার পর সেগুলি বাজারে বা অন্যান্য গন্তব্যস্থানে পাঠান হত।

তাঁতে মসলিন তৈরী হওয়ার পর থেকে গাঁইট বাঁধা পর্যন্ত যে প্রক্রিয়াসমূহ বর্ণনা হয়েছে, তাই মসলিন শিল্পীরা চিরাচরিত নিয়মে পালন করত।

কিন্তু বিদেশী বণিক কোম্পানীরা ঢাকায় বাণিজ্য-কুঠি স্থাপন করার পর তারা ঐ নিয়ম পালন করতনা। ওলন্দাজ এবং ফরাসী কোম্পানীর বাণিজ্য কুঠির কোন দলিল আমাদের হস্তগত হয়নি, কিন্তু ইংরেজ কোম্পানীর দলিলে দেখা যায় যে, তারা নিজেরাই এই প্রক্রিয়াসমূহের দায়িত্ব গ্রহণ করত।

তেজগাঁও-এ ইংরেজ কোম্পানীর একটি কারখানা ছিল। দালাল এবং পাইকারদের দ্বারা তাঁতে বুনা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তারা মসলিন সংগ্রহ করে নিত এবং তাদের নিজেদের কারখানায় জমা করে নিত।

সেখানে ধোলাই করা, সুতা সুবিন্যস্ত করা, সূচের কাজ করা, ইস্ত্রি করা এবং গাঁইট বাঁধা সকল কাজের জন্য লোক নিযুক্ত হত এবং কোম্পানীর কর্মচারীদের তত্ত্বাবধানে এসব কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন করা হত।

এভাবে সকল প্রক্রিয়া শেষ করে তারা কাপড়সমূহ কলকাতায় চালান দিত এবং সেখান থেকে ইংল্যান্ডে রপ্তানী করত।

প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আবদুল করিম-এর বইয়ের সহায়তায় এই রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে।

কিভাবে ঢাকাই মসলিন বোনা হতো ( পর্ব-৯)

কিভাবে ঢাকাই মসলিন বোনা হতো ( পর্ব-৯)

কিভাবে ঢাকাই মসলিন বোনা হতো ( শেষ পর্ব )

০৩:১৩:৪২ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৮ জুলাই ২০২৪

শিবলী আহম্মেদ সুজন

ইস্ত্রি করা, রং করা সূচের কাজ করা

যারা মসলিন ইস্ত্রি করত, তাদের ইস্ত্রিওয়ালা বলা হত; এদের সবাই মুসলমান ছিল। মসলিন কাগজের ভাঁজে রেখে ইস্ত্রি করা হত, যাতে কাপড়ে দাগ না লাগে। ইস্ত্রি করা হয়ে গেলে মসলিন বাজারে ছাড়ার উপযুক্ত হত।

কিন্তু ক্রেতাদের চাহিদা মেটানোর জন্য কোন কোন মসলিনে সূক্ষ্ম সূচের কাজ (fineembroidery) করার নিয়ম ছিল। আবার কোন কোন সময় মসলিন রংও করা হত।

ঢাকার কারিগররা এত সুন্দর ভাবে সূচের কাজ করত যে, ইউরোপীয় লেখকেরা বিষয় বোধ না করে পারেনি। জেমস টেলর প্রমুখ ইংরেজ লেখকরা ঢাকার সূচের কাজের অনেক প্রশংসা করেছেন।

১৭৪৪ সালে ফ্রান্সের লেখক Abbede Guyon এর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন এবং বলেছেন যে, ফ্রান্সে যে সব চিকণ কাজ করা মসলিন দেখা যায় তা সবই ঢাকা থেকে আমদানীকৃত।

সূক্ষ্ম সূচের কাজকে যর-দো-জী বলা হত। মসলিনের উপর সোনা-রূপার বাদলা ও গুবরে পোকার ডানাও লাগান হত।

সোনা-রূপার বাদলা কয়েক প্রকারের ছিল; যেমন, মসলিনে ব্যবহৃত বাদলাকে গোলাপদাতন; টুপীতে ব্যবহৃত বাদলাকে গোশা; পাগরী, টুপী, চটীজুতা ও হুকার নলে ব্যবহৃত বাদলাকে সলমা; সোনার জরি ও বুটিদার জামায় ব্যবহৃত বাদলাকে বুলন বলা হত।

একটা মসলিনকে লম্বালম্বিভাবে একটি বাঁশের ফ্রেমের উপর বিছিয়ে প্রথমে তাতে নকশা আঁকা হত, তার পর যর-দজ-রা (চিকণ সূচের কাজে পটু লোক) তার উপর সূচ চালিয়ে জরির কাজ করত।

সুতার নাল কাটার জন্য তারা কাঁচি বা ছুরির পরিবর্তে সাধারণতঃ কাচ বা চীনা মাটির জিনিস ব্যবহার করত। রিফুকারদের ন্যায় যর-দজ-রাও নিজেদের মধ্যে শ্রেণীগতভাবে বসবাস করত এবং যর-দজ-রা সবাই মুসলমান ছিল।

যারা মসলিনের উপর ফুলের কাজ ও ঔপনিবেশিক করত, তাদের চিকণ দর্জি বা চিকণ কারিগর বলা হত। সাধারণতঃ মুসলমানদের জামা-কাপড়ের উপর ফুলের কাজ করা হত।

মসলিন-এর উপর মুগা সিল্ক দ্বারা ফুলের কাজ করাকে কসিদা বলা হত। কসিদা, যের-দজি বা চিকণ দর্জিদের কাজের মত অত সূক্ষ্ম ছিলনা।

কাপড়ে ঘর-দজি না করে কসিদার কাজ করার রেওয়াজ বেশী ছিল এবং সাধারণতঃ মুসলমান মেয়েরা অবসর সময়ে কসিদার কাজ করত।

কাপড়ের উপরে ফুল বা অন্যান্য চিত্র রং করে এঁকে এসব মেয়েলোকদের দেওয়া হত এবং তারা অবসর মত চিত্রগুলির উপর সূচ চালিয়ে কসিদার কাজ করত।

গাঁইট বাঁধা

সবার শেষে মসলিনের গাঁইট বাঁধার পালা। নারদিয়ারা কাপড় ভাঁজ করার পর একদল লোক কাপড়গুলি স্তূপাকৃতি করে কাপড়ের গাঁইট তৈরী করত।

এই লোকগুলিকে বস্তাবন্দ বলা হত। দুই তক্তার মাঝখানে কাপড়গুলি রেখে তক্তা দুটি ভাল করে এঁটে বেঁধে কাপড়ের গাঁইট তৈরী করা হত।

সূক্ষ্মতম মসলিনের এক একটি বাঁশের দুই গিরার মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গায় পুরে প্যাক করা হত। এভাবে প্যাক করার পর সেগুলি বাজারে বা অন্যান্য গন্তব্যস্থানে পাঠান হত।

তাঁতে মসলিন তৈরী হওয়ার পর থেকে গাঁইট বাঁধা পর্যন্ত যে প্রক্রিয়াসমূহ বর্ণনা হয়েছে, তাই মসলিন শিল্পীরা চিরাচরিত নিয়মে পালন করত।

কিন্তু বিদেশী বণিক কোম্পানীরা ঢাকায় বাণিজ্য-কুঠি স্থাপন করার পর তারা ঐ নিয়ম পালন করতনা। ওলন্দাজ এবং ফরাসী কোম্পানীর বাণিজ্য কুঠির কোন দলিল আমাদের হস্তগত হয়নি, কিন্তু ইংরেজ কোম্পানীর দলিলে দেখা যায় যে, তারা নিজেরাই এই প্রক্রিয়াসমূহের দায়িত্ব গ্রহণ করত।

তেজগাঁও-এ ইংরেজ কোম্পানীর একটি কারখানা ছিল। দালাল এবং পাইকারদের দ্বারা তাঁতে বুনা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তারা মসলিন সংগ্রহ করে নিত এবং তাদের নিজেদের কারখানায় জমা করে নিত।

সেখানে ধোলাই করা, সুতা সুবিন্যস্ত করা, সূচের কাজ করা, ইস্ত্রি করা এবং গাঁইট বাঁধা সকল কাজের জন্য লোক নিযুক্ত হত এবং কোম্পানীর কর্মচারীদের তত্ত্বাবধানে এসব কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন করা হত।

এভাবে সকল প্রক্রিয়া শেষ করে তারা কাপড়সমূহ কলকাতায় চালান দিত এবং সেখান থেকে ইংল্যান্ডে রপ্তানী করত।

প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আবদুল করিম-এর বইয়ের সহায়তায় এই রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে।

কিভাবে ঢাকাই মসলিন বোনা হতো ( পর্ব-৯)

কিভাবে ঢাকাই মসলিন বোনা হতো ( পর্ব-৯)