মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান
প্রশ্নটি ছোট।
আপনার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিটি কে?
উত্তরটি একেকজনের কাছে একেক রকম!
কেউ বলতে পারেন, জো বাইডেন। কারণ তিনি পৃথিবীর ক্ষমতাধর দেশটি পরিচালনা করছেন।
আবার কারো উত্তর হতে পারে, বর্তমানে জো বাইডেন ছাড়াও অনেক ক্ষমতাধর মানুষ আছেন। হতে পারেন তিনি পুটিন বা মার্ক জাকারবার্গ কিংবা লিওনেল মেসি অথবা অন্য কোনো সেলিব্রেটি।
অনেকের উত্তর হতে পারে, মানব সভ্যতায় অবদান রেখেছেন এমন কারো নাম।
এই তালিকা শেষ হবে না। সবার ক্ষেত্রে যে এক উত্তর আসবে না-এটাও সত্য। একটি মাত্র নামে উত্তর পাওয়া যাবে না এমনটাও ভাবতে পারেন অনেকে।
আমাদের মনে যে উত্তরই আসুক না কেন, পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষটি তার খুব কাছের।
উত্তর কিন্তু একটাই-মা।
আপনার মা-ই আপনার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।
২
কবি কাজী কাদের নেওয়াজ লিখেছেন,
‘মা কথাটি ছোট্ট অতি
কিন্তু যেন ভাই
ইহার চেয়ে নাম যে মধুর
ত্রিভুবনে নাই।’
এই মধুর নামটি আমাদের প্রত্যেকের জীবনের শুরুর মুহূর্ত থেকে জড়িয়ে আছে। ২০০৩ সালে জার্নাল অফ সাইকোলজিকাল সায়েন্স-এ প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, নবজাতক জন্মের সময় তার মায়ের কণ্ঠস্বর চিনতে পারে। আরো পরিষ্কার করে বলা যায়, গর্ভে থাকার সময় থেকেই শিশু তার মায়ের কণ্ঠস্বরের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠে। মাতৃগর্ভের শিশু তার মায়ের পড়া কবিতা, গান কিংবা ধর্মগ্রন্থের পাঠ সব কিছুই অনুভব করতে পারে। পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে, একটি শিশুকে যদি তার মায়ের কণ্ঠস্বর রেকর্ড করে শোনানো হয় তবে তার হার্ট রেট বেড়ে যায়। সেখানে যদি অন্য কোরো নারীর কণ্ঠস্বরের রেকর্ড তাকে শোনানো হয় তবে হার্ট রেট কমে যায়। একারণে জন্মের আগে বা পড়ে সব সময়ই মায়ের কণ্ঠস্বর শিশুকে আগ্রহী করে তোলে।
শুধু কণ্ঠস্বরই নয়, মায়ের স্পর্শ শিশুর মনে নিরাপত্তার জন্ম দেয়। সায়েন্টিফিক আমেরিকার গবেষকরা জানিয়েছেন, মায়ের স্পর্শে শিশুর মন শান্ত হয় এবং ঘুম ভালো হয়। আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, শিশু জন্মের পর সারা শরীরের তুলনায় প্রাকৃতিকভাবেই মায়ের বুকের কাছে দুই ডিগ্রি বেশি উষ্ণ থাকে যার ফলে মায়ের কোলে শিশু সবচেয়ে আরাম ও নিরাপদ বোধ করে।
মায়ের গন্ধ শিশুর কাছে সবচেয়ে প্রিয়। মায়ের শরীরে বেড়ে ওঠার সময় এই গন্ধটিই হয় তার জন্য অন্যতম অভিজ্ঞতা। জন্মের পর গন্ধ শুকেই শিশু তার মাকে চিনতে পারে।
নবজাতক শিশু বারো ইঞ্চির দূরত্বের বেশি কিছু দেখতে পায় না। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এই দূরত্বে সে সবচেয়ে বেশি সময় তার মায়ের মুখই দেখতে পায়। একারণে তার কাছে সবচেয়ে প্রিয় চেহারা হয় তার মায়ের মুখ।
একটি শিশু জন্মের সময়ে তার মায়ের কষ্টের পরিমাপ করা সম্ভব নয়। কেউ কেউ তুলনা দিতে গিয়ে বলেন, একটি পূর্ণ বয়স্ক মানুষের কুড়িটি হাড় যদি একসঙ্গে ভেঙ্গে যায় তবে যে ব্যথা তিনি অনুভব করবেন, শিশু জন্ম দেয়ার সময় মায়ের ব্যথা তার চেয়েও বেশি। আবার কেউ কেউ বলেন, শিশু জন্মের সময় মায়ের বেদনা সহ্য করার ক্ষমতা বিস্ময়করভাবে বেড়ে যায়। এটা অন্যের পক্ষে অনুভব করা সম্ভব নয়। একারণে আমেরিকা-সহ কিছু দেশে শিশু জন্মের সময় বাবাকেও অপারেশন থিয়েটারে থাকতে বলা হয়। যেন বাবা অনুভব করতে পারেন, সন্তান জন্ম দিতে মা কেমন কষ্ট করেন!
৩
পুরানো ঢাকায় একটি কাহিনী প্রচলিত আছে। তখন সেখানে পঞ্চায়েত বা সরদার প্রথা চালু ছিল। কালাচাঁদ সরদার ছিলেন খুবই প্রভাবশালী। যদিও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তেমন ছিল না, কিন্তু প্রজ্ঞা ও বিচারবোধ তার প্রতি সবার সশ্রদ্ধ সম্মান নিয়ে আসতো। একবার একজন মা এসে সরদারের কাছে নালিশ করলেন, তার ছেলে সব সময়ই অত্যাচর করে। খেতে দেয় না। মাঝে মাঝেই মারধর করে।
সরদার খুব মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনলেন। তিনি সেই মাকে আশ্বস্ত করলেন। এরপর লোক মারফত তিনি ঘটনার সত্যতা জানতে পেরে পরদিন
খুব সকালে লাঠিয়াল বাহিনী পাঠিয়ে অবাধ্য ছেলেটিকে ধরে আনলেন। সরদার বাড়ির কাছে একটি কাঁঠাল গাছ দেখিয়ে তার সঙ্গে ছেলেটিকে বেঁধে রাখতে বললেন। তিনি যখন বেরিয়ে যাচ্ছিলেন তখন পাহারাদারদের নির্দেশ দিলেন একটি বড় কাঁঠাল যেন ছেলেটির পেটের সঙ্গে শক্ত করে বাঁধা হয়। অন্যদের আরো বললেন, সন্ধ্যার পর তিনি আসার আগে যেন কেউ তাকে কোনো খাবার না দেয় এবং কোনো ভাবেই যেন বাঁধন আলগা না হয়।
এই কঠোর নির্দেশ দিয়ে তিনি বেরিয়ে গেলেন। এদিকে সেই মা যখন শুনলেন তার ছেলেকে ধরে আনা হয়েছে তিনি পাগলের মতো ছুটে এলেন। বন্দি ছেলের অবস্থা দেখে তার সব অভিযোগ হারিয়ে গেল। পাহারাদারদের অনুরোধ করতে লাগলেন ছেলেকে ছেড়ে দিতে। কিন্তু কেউ তার কথা শুনলো না। এমনকি ছেলেকে কিছু খেতেও দিল না। ছেলেকে জড়িয়ে মা কাঁদতে লাগলেন।
সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরে সরদার সব দেখলেন। তাকে দেখেই মা দৌঁড়ে এসে পা জড়িয়ে ধরে ছেলেকে ছেড়ে দিতে বলতে লাগলেন। ছেলের বিরুদ্ধে তার কোনো অভিযোগ নেই সেটাও বললেন তিনি।
সরদারের মুখে একটু মুচকি হাসি ফুটলো। তিনি মা এবং ছেলেকে তার সামনে
নিয়ে আসতে বললেন। সালিশে আরো গণ্যমান্য ব্যক্তিরা হাজির হলেন। সরদার ছেলেকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, কি রে ব্যথা পেয়েছিস?
ছেলেটি উত্তর করলো, হ্যাঁ। খুব বেশি ব্যথা পেয়েছি।
সরদার আবার জানতে চাইলেন, কোনটাতে বেশি ব্যথা পেলি, দড়ি দিয়ে
গাছের সঙ্গে বাঁধাতে, না কাঁঠাল পেটে বেঁধে রাখায়?
মুখ কুঁকড়ে ছেলেটি উত্তর দিলো পেটে কাঁঠাল নিয়ে সারা দিন থাকাটাই ছিল বেশি কষ্টের।
এবার সরদার বললেন, মাত্র একদিন পেটে কাঁঠাল নিয়ে থাকতে কষ্ট হলো। আর তোকে জন্ম দিতে তোর মায়ের দশ মাস দশ দিন এরচেয়ে অনেক বেশি কষ্ট হয়েছে শুধু বয়ে বেড়াতেই। এবার তুই কি তোর মায়ের কষ্ট বুঝতে পারছিস
ছেলেটি আর কোনো কথা না বলেই মায়ের পায়ে জড়িয়ে ক্ষমা চাইতে লাগলো।
8.
মায়ের ভূমিকা সন্তানের জীবনে অতুলনীয়। বিষয়টি ইংরেজ কবি রুডিয়ার্ড কিপলিং কবিতার কয়েকটি লাইনে অসাধারণ ভাবে তুলে ধরেছেন,
IF I were hanged on the highest hill, Mother o mine, O mother o’ mine! I know whose love would follow me still, Mother o mine, O mother o mine! If I were drowned in the deepest sea, Mother o mine, O mother o mine! I know whose tears would come down to me, Mother o mine, O mother o’ mine! If I were damned of body and soul, Mother o’ mine, O mother o mine! I know whose prayers would make me whole, Mother o mine, O mother o’ mine!
কবিতাটির মর্মার্থ হলো, যদি আমাকে পাহাড় চূড়ায় ফাঁসি দেয়া হয়, আমি জানি আমার মায়ের ভালোবাসা সেখানে পৌঁছে যাবে। যদি আমাকে গভীর সাগরে ডুবিয়ে রাখা হয়, আমি জানি আমার মায়ের চোখের পানি সেখানে ভেসে আসবে। যদি আমার শরীর ও আত্মাকে খণ্ড করা হয়, আমি জানি আমার মায়ের প্রার্থনায় তা জোড়া লেগে যাবে।
কিপলিং-এর কবিতায় যে জোড়া দেয়ার কথা আছে তা আবেগময় লাইন মনে হলেও আজকাল বিজ্ঞান প্রমাণ করছে মা সন্তানের অনেক খণ্ড খণ্ড অংশকে
‘জোড়া’ দিতে পারেন। অনেক বড় বড় রোগ থেকেও রক্ষা করতে রক্ষাকবচ রেখে যেতে পারেন।
বিজ্ঞানের এই বিস্ময়কর আবিস্কার হলো স্টেম সেল। যা কেবল একজন মায়ের পক্ষেই সন্তানের জন্য রেখে যাওয়া সম্ভব। অধিকাংশ ক্যানসার, পারকিনসন্স, জেনেটিকাল ডিজঅর্ডার, দৃষ্টিহীনতা, কয়েক ধরনের ডায়াবেটিস, জটিল হৃদরোগ, চুলপড়া, হাড়ভাঙাসহ অনেক দুরারোগ্য রোগকেও স্টেম সেল ব্যবহার করে দূর করার কাজ চলছে। কেউ কেউ তা বাস্তবে পরিণত করেছেন।
স্টেম সেলকে এক কথায় বলা যায় মাদার সেল বা মাতৃকোষ। এই সেল থেকেই সারা দেহের বিভিন্ন কোষের সৃষ্টি হয়। জন্মের সময় বাবা মায়ের শুক্রাণু এবং ডিম্বাণু মিলিত হয়ে এককোষী জাইগোট তৈরি হয়। সেই এক কোষ থেকে দুই কোষ, দুই থেকে চার- এভাবে ধীরে ধীরে মাতৃগর্ভে প্লাসেন্টার ভেতর বেড়ে ওঠে মানব শিশু। একটি মাত্র মাতৃকোষ থেকে সব তৈরি হলেও চামড়া, হাড়, মাংস, হৃদপিণ্ড, লিভার এদের কোষের গঠন এক নয়, টিস্যুর গড়ন আলাদা। এক পর্যায়ে বিজ্ঞানীরা ভাবতে থাকেন, স্টেম সেল হলো এমন মাতৃকোষ যা থেকে যে কোনো সময় যে কোনো কোষ তৈরি করা সম্ভব। তাই কোনো ভাবে যদি স্টেম সেল সংরক্ষণ করা যায়, তবে পরবর্তী সময়ে কেউ অসুস্থ হয়ে গেলে তার শরীরের ক্ষতিগ্রস্ত অংশে প্রয়োজনীয় স্টেম সেল সরবরাহ করা গেলে তা থেকে উপশম সম্ভব হবে।
মানবদেহে স্টেম সেলের সবচেয়ে বড় উৎস হলেন সন্তান জন্ম দেয়া মা নিজে! মায়ের গর্ভে যে স্থানটিতে ভ্রুণ অবস্থা থেকে শিশুটি বেড়ে ওঠে সেটাকে বলে প্লাসেন্টা। এটি একটি গোলাকার ফুলের মতো বস্তু। যার ভেতর তরলের মধ্যে শিশুটি ভাসতে থাকে। এটি নিরাপদ আবরণ হিসাবে কাজ করে। এখান থেকেই শিশুর খাবার সরবরাহ হয়। একমাত্র ভাইরাস ছাড়া আর কোনো ক্ষতিকর পদার্থ এর মধ্যে ঢুকতে পারে না। এই প্লাসেন্টার সঙ্গে একটি কর্ড বা নাড়ি যুক্ত থাকে। যা দিয়ে মায়ের শরীর থেকে রক্ত ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় পদার্থ শিশুর দেহে যায়। এই নাড়িটি জন্মের পরও শিশুর নাভির সঙ্গে যুক্ত থাকে। যা এক পর্যায়ে কেটে দেয়া হয়। এই কারণেই সন্তানকে বলা হয় ‘মায়ের নাড়ি ছেড়া ধন।’
যদি মাইনাস ২৭৬ ডিগ্রি তাপমাত্রায় তরল নাইট্রোজেনে স্টেম সেল রাখা যায় তবে শত শত বছরেও তার কোনো ক্ষতি হবে না। ইংল্যান্ডসহ পৃথিবীর অনেকগুলো দেশেই স্টেম সেল সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে কর্ড ব্লাড সংরক্ষণের উদ্যোগ নিচ্ছেন। ভবিষ্যতে সন্তান যদি কোনো দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয় তবে তারই রেখে দেয়া স্টেম সেল থেকে সন্তানের চিকিৎসা করা সম্ভব হবে। সন্তান জন্মের পর ভারতের জনপ্রিয় অভিনেত্রী ঐশ্বরিয়া রাই বচ্চন তার নিজ সন্তানের স্টেম সেল সংরক্ষণের ঘোষণা দেন। তিনি প্রত্যেক মাকে এই উদ্যোগে অংশ নিতে আহ্বান জানান।
৫
অনেকে ভাবতে পারেন তার মা কোনো সেলিব্রেটি নন। একেবারেই সাধারণ। এতো বেশি সাধারণ যে কিছু মানুষ আছেন যারা সমাজে ‘প্রতিষ্ঠিত’ হয়ে গেলে তখন আর মায়ের পরিচয় দিতে চান না। তখন অবস্থা হয় অনেকটা ছেলের কাছে লেখা চিঠির সেই মায়ের মতো।
যে ছেলেটি গ্রামে স্কুলে পড়ার সময় থেকে দেখে এসেছে তার মা স্কুলে খুব কম বেতনে চাকরি করেন। যার একটি চোখ নেই। যাকে নিয়ে তার বন্ধুরা হাসাহাসি করে। মায়ের প্রতি অবজ্ঞা এক সময় অবহেলায় এবং এক পর্যায়ে ঘৃণায় পরিণত হয়। মায়ের প্রতি তার দুর্ব্যবহার চরমে ওঠে। এক পর্যায়ে ছেলেটি বড় হলে মাকে ছেড়ে চলে যায়। যদিও তার মা অনেক কষ্ট করে শেষ পর্যন্ত তার লেখাপড়ার সব খরচ বহন করেন।
অনেক দূরের একটি শহরে ছেলেটি এক সময় প্রতিষ্ঠিত হয়। সে বিয়ে করে। তার দুটো ফুটফুটে সন্তান হয়। পরিবার নিয়ে সে বেশ সুখেই বসবাস করতে লাগে। একদিন সে শুনতে পেল বাড়ির বাইরে কাউকে দেখে তার বাচ্চারা হাসাহাসি করছে। সে শুনতে পেল বাচ্চারা বলছে, এক চোখা বুড়ি!
বাড়ির বাইরে এসে ছেলেটি দেখতে পেল এক বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে আছেন। তার একটি চোখ নেই। নিজের মাকে চিনতে তার বেশ কিছুটা সময় লাগলো। আর
চেনার সঙ্গে সঙ্গেই সে চিৎকার দিয়ে গালাগাল শুরু করলো। তাকে বেরিয়ে যেতে বললো। তার মা দ্রুত চলে যেতে যেতে বললেন, ‘আমার ভুল হয়েছে। আমি সম্ভবত ভুল ঠিকানায় চলে এসেছি।’
বেশ কয়েক বছর পরের কথা। সমাজে ‘সফল’ এই ছেলেটির কাছে তার প্রাক্তন স্কুল থেকে চিঠি এলো। স্কুলে রিইউনিয়ন হবে। তার বন্ধুরাও তাকে যেতে বললো। সে গেল। অনেকদিন পর পুরানো বন্ধুদের সঙ্গে তার দেখা হওয়াতে বেশ ভালো লাগলো। সব বন্ধুদের মধ্যে তার নিজের সামাজিক অবস্থান ভালো হওয়াতে মনে মনে একটু গর্ব বোধ করলো।
এক সময় আনমনা ভাবে সে পথ চলতে শুরু করে। সেই পরিচিত পরিবেশ। সব ঠিক আগের মতোই আছে। হঠাৎ সে আবিষ্কার করলো, সে তার নিজের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। যেখানে তার মা থাকেন!
সম্বিৎ ফিরে পেতেই সে যখন চলে যেতে নেবে ঠিক তখনই পাশের বাড়ির ভদ্রমহিলা তাকে দেখে এগিয়ে এলেন। তার কাছে এসে অনেক কথা বললেন। সে বিরক্ত নিয়ে শুনলেও একটা কথা বুঝতে পারলো, কিছুদিন আগে তার মা মারা গেছেন। এতে তার মধ্যে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না। তবে ফিরে আসার আগে প্রতিবেশী তার মায়ের লেখা একটি চিঠি হাতে ধরিয়ে দিলেন।
ফেরার পথে গাড়িতে চড়ে চিঠিটি ফেলে দিতে গিয়েও কী মনে করে চিঠিটি পড়া শুরু করলো ছেলেটি:
“আমার অতি প্রিয় সন্তান
আমি জানি, তুমি যখন এই চিঠি পাবে তখন আমি থাকবো না। আমি জানি, তোমার অনেক শখ আমি পূরণ করতে পারি নি। আমি জানি, আমার মতো একচোখের একজন কুৎসিত নারীকে মা ভাবতে তোমার কষ্ট হয়েছে।
তোমার মনের সব কষ্টের জন্য আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি বাবা।
তোমার জন্মের পরপরই তোমার বাবার মৃত্যু আমাদের পরিবারকে অসহায় করে তোলে। আত্মীয় স্বজন যারা নানা সময় তোমার বাবার কাছ থেকে উপকৃত হয়েছিল তারাও দূরে সরে যায়। স্কুলের আয়ার চাকরিটি আমি বাধ্য হয়েই নিই। কারণ আমার কাছে আর কোনো বিকল্প ছিল না। এর মধ্যে হঠাৎ তোমার জলবসন্ত হয়। এর প্রকোপে তোমার একটি চোখ নষ্ট হয়ে যায়। আমি শুধু কাঁদতাম। আমার ছেলে বড় হলে সবাই তাকে ‘একচোখা’ বলে কটাক্ষ করবে এই ভাবনায়। একদিন চোখের এক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার গ্রামে আসেন। তার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, চাইলে আমার একটা চোখ তোমাকে দিতে পারি। আমি রাজি হলাম। সেই মহান ডাক্তার কম খরচে অপারেশন করে আমার একটি কর্নিয়া তোমার চোখে বসিয়ে দেন। তুমি দুই চোখেই দেখতে পারো। সেই আনন্দ আমি কীভাবে ভুলবো।
তুমি চলে যাওয়ার পর সব সময়ই তোমার কথা মনে হতো। অনেক খোঁজাখুঁজি করে তোমার ঠিকানা জোগাড় করি। ভেবেছিলাম দূর থেকে তোমাকে একবার দেখে চলে আসবো। কিন্তু তোমার দেবদূতের মতো সন্তান দুটোকে দেখে মনের ভুলে এগিয়ে গিয়েছিলাম।
তোমাকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলার জন্য আমি দুঃখিত।
তুমি যেখানেই থাকো, যতো দূরে থাকো- ভালো থেকো।
ইতি
তোমার মা”
৬
মায়ের ভালোবাসা অনুভব করার মতো ক্ষমতা সন্তানের থাকে না। তাই আজই আপনার মাকে বলুন, আপনি তাকে কতোটা ভালোবসেন। কতোটা অনুভব
করেন। আগামীকাল এই সুযোগ আপনার নাও হতে পারে।
আর যাদের অবস্থা কিশোর কুমারের সেই গানের মতো;
বেশ তো ছিলাম ছোটবেলায় মায়ের আঁচল তলে
সেই কথাটি ভেবে এখন ভাসি চোখের জলে
শিশু ঘুমলো পাড়া জুড়লো
বর্গি এলো দেশে
গানের সুরে ঘুম পাড়াতো মা যে ভালোবেসে
ঘুম পাড়ানি ছড়ায় এখন খোকন ঘুমোয় না
তারার দেশে হারিয়ে গেছে স্নেহময়ী মা।
প্রিয় মুখটিকে একবার দেখার আশায় যাদের তারার দেশে খুঁজে বেড়াতে হয়, যাদের মনে হয় কখনো যদি স্বপ্নে এসে দেখা দেয়, যার মধুর হাসিটি দেখার জন্য মন ছটফট করে, যাকে একবার কাছে এনে দিতে বন্দি তোতা পাখিটিকেও ছেড়ে দিতে আপত্তি থাকে না- তারা কী করবেন?
তারা প্রাণ ভরে প্রার্থনা করবেন মায়ের জন্য।
এটা মনে রাখবেন, আপনার মা যেখানেই থাকুন, যতো দূরেই থাকুন, তিনি আপনাকে সব সময়ই দেখছেন। তিনি আপনার পাশেই আছেন। সব সময়ই তার আশীর্বাদ আপনার ওপর মমতার ছায়া তৈরি করে রেখেছে।
লেখক পরিচিতি: সাংবাদিক ও গবেষক
Leave a Reply