শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫:৫৬ পূর্বাহ্ন

মেডেল

  • Update Time : শুক্রবার, ১৬ আগস্ট, ২০২৪, ৭.০০ পিএম

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

কয়েক বছর পূর্বে এ ঘটনা ঘটেচে, তাই এখন মাঝে মাঝে আমার মনে হয় ব্যাপারটা আগাগোড়া মিথ্যে; আমারই কোন প্রকার শারীরিক অসুস্থতার দরুন হয়তো চোখে ভুল দেখে থাকবো বা ওই রকম কিছু! কিন্তু আমার মন বলে, তা নয়, ঘটনাটা মিথ্যে ও অবাস্তব বলে উড়িয়ে দেওয়ার কোনও কারণ ঘটে নি। আমার তখনকারের অভিজ্ঞতাই সত্যি, এখন যা ভাবচি, তাই মিথ্যে।

ঘটনাটি খুলে বলা দরকার।

প্রসঙ্গক্রমে গোড়াতেই একথা বলে রাখি যে, গত দশ বৎসরের মধ্যে আমার শরীরে কোনও রোগ-বালাই নেই। আমার মন বা মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ সুস্থ আছে এবং যে সময়ের কথা বলচি, এখন থেকে বছর চারেক আগে, তখনও সম্পূর্ণ সুস্থ ছিল। আমার স্কুলমাস্টারের জীবনে অত্যাশ্চর্য বা অবিশ্বাস্য ধরনের কখনও কিছু দেখি নি। অন্য পাঁচজন স্কুলমাস্টারের মতোই অত্যন্ত সাধারণ ও একঘেয়ে রুটিন বাঁধা কর্তব্যের মধ্যে দিয়েই দিন কাটিয়ে চলেছি আজ বহু বৎসর।

সে বছর বর্ষাকালে, গরমের ছুটির কিছু পরে একদিন ক্লাসে পড়াচ্ছি, এমন সময় একটি ছেলে আর একটি ছেলের সঙ্গে হাত-কাড়াকাড়ি করে কি একটা কেড়ে বা ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করচে, আমার চোখে পড়লো। আমি ওদের দুজনকে অমনোযোগিতার জন্যে ধমক দিতে, অন্য একটি ছেলে বলে উঠলো, “স্যার, কামিখ্যে সুধীরের মেডেল কেড়ে নিচ্ছে…”

“কার মেডেল? কিসের মেডেল?”

সুধীর নামে ছেলেটি দাঁড়িয়ে উঠে বললে, “আমার মেডেল, স্যার!”

অন্য ছেলেটির দিকে চেয়ে বললুম, “ওর মেডেল তুমি নিচ্ছিলে, কামিখ্যে?

কামিখ্যে ওরফে কামাখ্যাচরণ মৌলিক নামে ছেলেটি বললে, “নিচ্ছিলুম না স্যার, দেখতে চাইছিলুম; তা, ও দেবে না…”

“ওর মেডেল যদি ও না দেয়; তোমার কেড়ে নেবার কি অধিকার আছে? বোসো, ও রকম আর করবে না…”

কথা শেষ করে সুধীরের দিকে চেয়ে ক্লাসের ছেলেদের পরস্পরের মধ্যে ভ্রাতৃভাব ও সখ্য থাকার ঔচিত্য সম্বন্ধে নাতিদীর্ঘ একটি বক্তৃতা দেবার পরে ঈষৎ কৌতূহলের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলুম, “কই, কি মেডেল দেখি? কোথায় পেলে মেডেল?”

ভেবেছিলুম আজকাল কলকাতার পাড়ায় পাড়ায় যে সব ব্যাডমিন্টন খেলা, সাঁতারের বা দৌড়ের প্রতিযোগিতা প্রভৃতি অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে, তারই কোন কিছুতে সুধীর হয়তো চতুর্থ স্থান বা ওই ধরনের কোনো সাফল্যলাভ করে ছোট্ট এতটুকু একটা আধুলির মতো মেডেল পেয়ে থাকবে-এবং সম্পূর্ণ স্বাভাবিক যে, সে সেটা ক্লাসে এনে পাঁচজনকে গর্ব-ভরে দেখাতে চাইবে; এমন কি এই ছুতো অবলম্বন করে ক্লাসসুদ্ধ হেডমাস্টারের কাছে দলবদ্ধ হয়ে গিয়ে একবেলার জন্যে ছুটিও চাইতে পারে। সুতরাং মেডেলটা যখন আমার হাতে এসে পৌঁছুলো, তখন সেটাকে তাচ্ছিল্যের সঙ্গেই হাত পেতে নিলুম; কিন্তু মেডেলটার দিকে একবার চেয়ে দেখেই চেয়ারে সোজা হয়ে বসলুম। না, এ তো পাড়ার ব্যাডমিন্টন ক্লাবের বাজে মেডেল নয়, মেডেলটা পুরনো, বড় ও ভারি চমৎকার গড়ন! কি জিনিস দেখি?

মেডেলের গায়ে কি লেখা রয়েচে, আধ-অন্ধকার ক্লাসরুমে ভালো পড়তে পারলুম না-ও-পিঠ উলটে দেখি, মহারানী ভিক্টোরিয়ার অল্প-বয়সের মূর্তি খোদাই করা। পকেটে চশমা নেই, মনে হল অফিস ঘরের টেবিলে ফেলে এসেচি। ইতিমধ্যে অনেকগুলি ছেলে ভিড় করেচে আমার চেয়ারের চারিপাশে-মেডেল দেখবার জন্যে। তাদের ধমক দিয়ে বললুম, “যাও, বোসোগে সব, ভিড় কোরো না এখানে।”

একটা ছেলেকে বললুম, “কি লেখা আছে মেডেলের গায়ে পড়ো তো?”

‘ক্লাস ফোরের ছেলে-অতি কষ্টে ধীরে ধীরে পড়লে, “ক্রাইমিয়া, সিবাস্টোপোল, ভিক্টোরিয়া রেজিনা।”

“ও পিঠে?”

“সার্জেন্ট এস. বি. পার্কিন্‌স্, সিক্সথ ড্রাগন গার্ডস্-আঠারো শ’ চুয়ান্ন সাল..” দস্তুরমতো অবাক হয়ে গেলুম। ক্রাইমিয়ার যুদ্ধের সময় সিবাস্টোপোলের রণক্ষেত্রে

কোনও সাহসের কাজ করবার জন্যে এই মেডেল দেওয়া হয়েছিল ইংলন্ডের সামরিক দপ্তর থেকে ড্র্যাগন গার্ডস্ সৈন্যদলের সার্জেন্ট পার্কিকে। এ তো সাধারণ জিনিস মোটেই নয়! ক্রাইমিয়া—সিবাস্টোপোল? চার্জ অফ দি লাইট ব্রিগেড্। কিন্তু কলকাতার নীলমণি দাসের লেনের সুধীর সাহার কাছে সে মেডেল কোথা থেকে আসে।

“এদিকে এসো, এ মেডেল কোথায় পেয়েচ?”

“ওটা আমার স্যার!”

“তোমার তা বুঝলুম। পেলে কোথায়?”

“আমার দাদু দিয়েচেন স্যার।”

“তোমার দাদু কোথায় পেয়েছিলেন জানো?

“হ্যাঁ, স্যার, জানি। আমার দাদুর বাবার কাছে এক সাহেব জমা রেখে গিয়েছিল।”

“কি ভাবে?”

“আমাদের মদের দোকান ছিল কিনা, স্যার। মদ খেয়ে টাকা কম পড়লে ওটা বাঁধা রেখে গিয়েছিল, আর নিয়ে যায় নি-দাদুর মুখে শুনেচি।”

হিসেব করে দেখলুম ছিয়াশি উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েচে সেই বছরটি থেকে, যে বছরে সার্জেন্ট পার্কিন্‌স্ (সে যেই হোক) এ মেডেল পায়। তখন তার বয়স যদি কুড়ি বছরও থেকে থাকে, এখন তার বয়স হওয়া উচিত একশো ছয়। সুতরাং সে মরে ভূত হয়ে গেছে কোন্ কালে।

সেদিন ছিল শনিবার, সকাল সকাল স্কুল ছুটি হবে এবং অনেক দিন পরে সেদিন দেশে যাবো পূর্বেই ঠিক করে রেখেছিলুম। আমার এক গ্রাম-সম্পর্কে জ্যাঠামশায় ইতিহাস নিয়ে নাড়াচাড়া করেন, বেশ পড়াশুনো আছে, গ্রামেই থাকেন। ভাবলুম, তাঁকে মেডেলটা দেখালে খুশি হবেন খুব। সুধীরের কাছ থেকে মেডেলটি চেয়ে নিলুম, সোমবারে ফেরত দোব বললুম। স্কুলের ছুটির পরে বাসা থেকে সুটকেসটি নিয়ে শিয়ালদা স্টেশনে এসে আড়াইটের গাড়ি ধরলুম। দেশের স্টেশনে যখন নামলুম, তখন বেলা সাড়ে পাঁচটা। দু’মাইল রাস্তা হেঁটে বাড়ি পৌঁছুতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল। সন্ধ্যার আগেই হয়তো পৌঁছুতে পারা যেত-কিন্তু আমি খুব জোরে হাঁটি নি।

ভাদ্র মাসের শেষ, অথচ বৃষ্টি তত বেশি না-হওয়ায় পথ-ঘাট বেশ শুকনো খটখটে।
পথের ধারের বর্ষা-শ্যামল গাছপালা চোখে বড় ভালো লাগছিল অনেক দিন কলকাতা বাসের পরে-তাই জোরে পা না-চালিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে আসছিলুম। এখানে প্রথমেই বলি, আমার বাড়িতে কেউ থাকে না। পাশের বাড়ির এক বৃদ্ধা, আমি গেলে রান্না করে দিয়ে আসতেন বরাবর। আমার এক বাল্যবন্ধু বৃন্দাবন, অনেক বছর ধরে বিদেশে থাকে, পিসিমার মুখে শুনলুম, আজ দিন পনেরো হল বৃন্দাবন বাড়ি এসেচে। শুনে বড় আনন্দ হল, সন্ধ্যার পরেই ওর সঙ্গে দেখা করবো ঠিক করে, চা খেয়ে নদীর ধারে বেড়াতে বার হলুম-যাবার সময় সুটকেসটা খুলে মেডেলটা পকেটে নিলুম, বৃন্দাবনকেও দেখাবো।

নদীর ধারে গিয়ে দেখি-বর্ষার দরুন নদীর জল ভয়ানক বেড়েচে, নদীর জল কূল ছাপিয়ে দু’ধারের মাঠে পড়েচে। অনেকক্ষণ বসে রইলুম, সন্ধ্যার অন্ধকার নামলো একটু একটু, বাদুড়ের দল বাসায় ফিরচে। কেউ কোনো দিকে নেই। এক জায়গায় বর্ষার তোড়ে নদীর পাড় ভেঙে গিয়েচে। অনেকটা উঁচু পাড়, নিচে খরস্রোতা বর্ষার নদী। জায়গাটা দিয়ে যেতে যেতে একবার কি-রকম ভেঙেচে দেখবার ইচ্ছে গেল। পাড়ের ধারে দাঁড়িয়ে নিচে জলের আবর্ত দেখচি, পাড়টা সেখানে অনেকখানি উঁচু, জল অনেক নিচে-হঠাৎ আমার মনে একটা অদ্ভুত ইচ্ছা জেগে উঠলো-আমি লাফ দিয়ে পাড় থেকে জলে পড়বো! দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ইচ্ছাটা যেন ক্রমে বেড়ে উঠচে লাফাই দিই লাফ…! অথচ বর্ষার খরস্রোতা নদী, কুটো ফেললে দু’খানা হয়ে যায়। আমি সাঁতার জানি না, গভীর জল পাড়ের নিচেই। ইচ্ছাটা কিছুতেই যেন সামলাতে পারচিনে। এমন কি আমার মনে হল আর কিছুক্ষণ থাকলে আমাকে লাফ দিতেই হবে, নইলে আমার জীবনের সুখ চলে যাবে!…

তাড়াতাড়ি ‘নদীর পাড় থেকে একরকম জোর করেই চলে এলুম। কারণ যেন মনে হচ্ছিল এর পর আমার আর যাওয়ার ক্ষমতা থাকবে না, পা দুটো যেন ক্রমশ সীসের মত ভারী হয়ে উঠচে-এর পর ওই বিপজ্জনক নদীর পাড় থেকে পা দুটোকে নাড়াবার ক্ষমতা চলে যাবে আমার!…

নদীর ধার থেকে বৃন্দাবনদের বাড়ি আসবার পথে ও সব ইচ্ছে আর কিছু নেই। আমি নিজের মনোভাবে নিজেই আশ্চর্য হয়ে গেলুম-কি অদ্ভুত! এ রকম হওয়ার মানে কি? ট্রেনে বসে অতিমাত্রায় ধূমপান করেছিলাম মনে পড়লো। এই ভাদ্র মাসের গরমে অত ধূমপান করা ঠিক হয় নি, তার ওপর বাড়ি এসে দু’তিন পেয়ালা চা খেয়েচি। এ সবেই ওরকমটা হয়ে থাকবে। নিশ্চয়ই তাই। বৃন্দাবনের বাড়ি গেলুম। বৃন্দাবনকে অনেক দিন পরে দেখে সত্যিই আনন্দ হল। দুজনে অনেক রাত পর্যন্ত অনেক গল্প করলুম। অনেক-বছর-ধরে-জমানো অনেক সুখ-দুঃখের কাহিনী। বড় গরম আজ, কোথাও এতটুকু বাতাস নেই। ভাদ্রমাসের গুমোট গরম। বৃন্দাবন বললেন, “চল ভাই, ছাদে গিয়ে বসে গল্প করি, তবুও একটু হাওয়া পাওয়া যাবে। …তুই আমাদের এখানে খেয়ে যাবি-মা বলে দিয়েচেন। তোদের বাড়িতেও খবর দেওয়া হয়েচে।”

দু’জনে ছাদে উঠলুম। বাড়িটা দো-তলা। দো-তলার ছাদের ওপর একখানা মাত্র ঘর আছে। আমি জানতুম, বৃন্দাবনের কাকা ওই ঘরটায় থাকেন। দো-তলার ছাদে উঠে দেখলুম-বাড়ির পেছন দিকটায় বাঁশের ভারা-বাঁধা। বললুম, “বাড়িতে রাজমিস্ত্রি খাটচে বুঝি, বৃন্দাবন?

“হ্যাঁ ভাই, কাকার ঘরটা মেরামত হবে; উত্তর দিকে দেওয়ালটার গা থেকে নোনা ধরা ইটগুলো বার করা হচ্ছে।”

বৃন্দাবন দোতলার ঘরটার মধ্যে ঢুকলো-আমার কিন্তু মনে কেমন একটা অস্থির ভাব!

খানিকক্ষণ ঘরের মধ্যে গল্প করে আমি একটু জল খেতে চাইলুম। বৃন্দাবন জল আনতে নিচে নেমে গেল, আমি ছাদে পায়চারি করতে লাগলুম। ছাদে কেউ নেই। অন্ধকার ছাদটা।… যে দিকটায় রাজমিস্ত্রিরা ভারা বেঁধে কাজ করচে, পায়চারি করতে করতে সেখানটাতে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখচি, হঠাৎ আমার মনে হল-ছাদ থেকে লাফ দিয়ে পড়িনে কেন?

বেশ হবে! লাফ দেবো? প্রায় দুর্দমনীয় ইচ্ছা হল লাফ দেবার। লাফ দেওয়াই ভালো। লাফ দিতেই হবে। দিই লাফ-এমন সময় বৃন্দাবন ছাদের ওপর এসে বললে, “আয় ঘরের মধ্যে, মা চা পাঠিয়ে দিচ্ছেন; ওখানে দাঁড়িয়ে কেন?”

আরও প্রায় আধ-ঘণ্টা কথা বলবার পরে, নিচে থেকে চা ও খাবার এসে পৌঁছুলো। আমারা দুই বন্ধুকে অনেক রাত পর্যন্ত গল্পগুজব করলুম। তারপর বৃন্দাবন খাওয়ার কতদূর যোগাঢ় হল দেখতে নিচে চলে গেল।

ঘরের মধ্যে বড় গরম-আমি বাইরের ছাদে খোলা হাওয়ায় আবার বেড়াতে লাগলুম। রাজমিস্ত্রিদের ভারার কাছে এসে দাঁড়িয়ে আমার মনে হল-লাফ এবার দিতেই হবে। কেউ নেই ছাদে। কেউ বাধা দিতে আসবে না-এই উপযুক্ত অবসর। সঙ্গে সঙ্গে আমার মনের গভীর তলায় কে যেন বলচে-‘লাফ দিও না, মূর্খ’! লাফ দিও না, পড়ে চূর্ণ হয়ে যাবে।’–আমার মাথার মধ্যে কেমন ঝিমঝিম করচে!…

কতক্ষণ পরে জানিনে, এবং কিসে থেকে কি হল তাও জানিনে, হঠাৎ বৃন্দাবনের চিৎকারে আমার চমক ভাঙলো? দেখি, বৃন্দাবন আমাকে হাত ধরে টেনে তুলচে।

“একি সর্বনাশ! তুই লাফ দিয়ে পড়লি দেখলুম যেন! ভাগ্যিস, বাঁশে পা-বেঁধে গিয়েচে তাই রক্ষে-কি হল তোর?”

আমার মাথা যেন কেমন ঘুরছিল, গা ঝিমঝিম করছিল। বৃন্দাবনকে বললুম, “আমি ভাই কিছুই জানিনে তো?…”

বৃন্দাবন ঘরের মধ্যে নিয়ে গিয়ে আমায় শুইয়ে দিলে। সকলে বললে ট্রেনে আসার দরুন আর গরমে শরীর কি রকম খারাপ হয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলুম। আমি জানি মাথা ঘুরে পড়ে আমি যাই নি, লাফ আমি ইচ্ছে করেই দিয়েছিলুম-তবে ঠিক যে সময়টাতে আমি লাফ দিয়েচি সে সময়ের কথাটা আমি অনেক চেষ্টা করে কিছুতেই মনে করতে পারলুম না।

বিছানায় শুয়ে বেশ সুস্থ বোধ করলুম। পাশ ফিরতে হঠাৎ যেন কি একটা শক্ত জিনিস বুকের কাছে ঠেকলো। পকেটে হাত দিয়ে দেখি-সুধীরের সেই মেডেলটা।

আশ্চর্য, এটার কথা এতক্ষণ একেবারে ভুলেই গিয়েছিলুম। বৃন্দাবনকে সেটা দেখালুম। ওদের বাড়ির সকলে মেডেলটা হাতে করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখলে।

রাত্তিরে নিজের ঘরে এসে শুয়ে পড়লুম। আমার বাড়িতে কেউ নেই বর্তমানে, একাই থাকি এক ঘরে। একটা জিনিস লক্ষ্য করচি; যখন থেকে বৃন্দাবনদের বাড়ি থেকে বার হয়ে পথে পা দিয়েছি, তখন থেকেই কেমন এক ধরনের ভয় করচে আমার! বাড়িতে যখন ঢুকলুম, তখন ভয়টা যেন বাড়লো। একা ঘরে কতবার এর আগে শুয়েচি-এমন ভয় হয় নি মনে কোন দিন। না, শরীরটা সত্যিই খারাপ। শরীর খারাপ থাকলে মনও দুর্বল হওয়া খুবই স্বাভাবিক।

আলো নিবিয়ে শুয়ে পড়লুম। আমার শিয়রের কাছে একটা বড় জানলা-জানলা দিয়ে বাড়ির পেছনের বন-বাগান চোখে পড়ে। বেশ জ্যোৎস্না উঠেচে-কৃষ্ণ-পক্ষের একাদশীর বিভূতি রচনাবলী-নবম খণ্ড কিশোর সাহিত্য-৪২

জ্যোৎস্না। হাওয়া আসবে বলে জানলা খুলে রেখেচি। কতক্ষণ ঘুম হয়েছিল জানি নে, ঘণ্টা- খানেকের বেশি হবে না-হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। মনে হতে লাগলো আমার শিয়রের দিকের জানলায় কে দাঁড়িয়ে! যেন মাথা তুলে সে দিকে চেয়ে দেখলেই তাকে দেখা যাবে। কথাটা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভীষণ ভয় হল। অথচ কিসের যে ভয় জানিনে। এমন ভয় যে, কিছুতেই শিয়রের জানলার দিকে তাকাতে পারলুম না। চোখে না দেখলেও আমার বেশ মনে হল, জানলার গরাদেতে দুটো হাত রেখে কে দাঁড়িয়ে আছে-জ্বলন্ত চোখে সে আমার দিকে চেয়ে রয়েচে-আমি ওদিকে চাইলেই দেখতে পাবো।

প্রাণপণে চোখ বুজে শুয়ে রইলুম, কিছুতেই চাইবো না। ঘুমুবার চেষ্টা করলুম-কিন্তু ঘরের মধ্যে কোথাও কি ইঁদুর পচেছে? কিসের পচা গন্ধ? যেন আয়োডিন, লিন্ট, মলম প্রভৃতি উগ্র গন্ধের সঙ্গে পচা ক্ষতের গন্ধ মেশানো? এতকাল বাড়িতে থাকা নেই, যার ওপর বাড়ি ঘর পরিষ্কার রাখার ভার, সে কিছুই দেখাশোনা করে না বোঝা গেল।…

কে যেন আমার মনের ভেতর বলচে, “চেয়ে দেখ, তোমার মাথার শিয়রের জানলার দিকে চেয়ে দেখ না?”

ঘরের চারিধারে কিসের যেন একটা প্রভাব-কোনো অমঙ্গলজনক, হিংস্র, উগ্র, অশান্ত ধরনের ব্যাপারটা, ঠিক বলে বোঝানো যায় না। আমি যেন ভয়ানক বিপদগ্রস্ত। সে এমন বিপদ, যা আমাকে মরণের দোর পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারে-এমন কি সে দোরের চৌকাঠ পার করে অন্ধকার মৃত্যুপুরীর হিমশীতল নীরবতার মধ্যে ডুবিয়ে দিতেও পারে!…

…আমি চাইবো না…কিছুতেই চাইবো না শিয়রের জানলার দিকে।

কিন্তু যে প্রভাবই হোক, আমার ঘরের মধ্যে, দেওয়ালের এ পিঠে তার অধিকার নেই। বহুকাল ধরে পূর্বপুরুষেরা বাস্তু শালগ্রামের অর্চনা করেচেন এ ঘরে-এর মধ্যে কারও কিছু খাটবে না। আমার মনই আবার এ কথাগুলি যেন বললে! অন্ধকার রাত্রে নির্জন ঘরে মন কত কথা কয়!

জানলার ধারে কি যেন একটা শব্দ হল।

অদ্ভুত ধরনের শব্দটা। কে যেন জানলার গরাদের ওপর ঠোকা দিয়ে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইচে! একবার দুবার, তিনবার ভয়ে আমার বুকের মধ্যে ঢিপ্টিপ্ করতে লাগলো—কাউকে ডাকবো চীৎকার করে? একবার চেয়ে দেখবো জানলার দিকে জিনিসটা কি? হঠাৎ আমার মনে পড়লো একটা ধাড়ি বেঁজী অনেকদিন থেকে বাইরের দেওয়ালে, কড়িকাঠের খোলে বাসা বেঁধে আছে-আজ বিকেলেও সেটাকে একবার দেখেচি। জানলার ওপরকার কাঠে সেটা পোকামাকড় বা জোনাকি ধরছে-এ তারই শব্দ।

কথাটা মনে হতেই মনের মধ্যে সাহস আবার ফিরে এল। উঃ, ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে গেল যেন! শরীর অসুস্থ থাকলে কত সামান্য কারণ থেকে ভয় পায় মানুষ! পাশ ফিরে এবার ঘুমুবার চেষ্টা করলুম স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। কিন্তু আমার এ ভাব বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। এ-ধারণা আমার মন থেকে কিছুতেই গেল না যে, আজ রাত্রে আমি একা নই-আরও কে এখানেই আছে! নিদ্রাহীন চোখে সে আমার ওপর খরদৃষ্টি দিয়ে পাহারা রেখেচে-আমায় সে নিরাপদে বিশ্রাম করতে দেবে না আজ।…

বার বার ঘুম আসে, আবার তন্দ্রা ছুটে যায়, অমনি জেগে উঠি; কিন্তু চোখ চাইতে, বা বিছানার ওপর উঠে বসতে সাহস হয় না…আর সেই শব্দটা মাঝে মাঝে জানলার গরাদের ওপর হতে শুনি-খুব মৃদু করাঘাতের শব্দ যেন! যেন শব্দটা বলচে-“চেয়ে দেখ… পেছন

ফিরে জানলার দিকে চেয়ে দেখ…”

ঘামে দেখি বিছানা ভেসে গিয়েচে, ভাদ্রের গুমট গরম কিনা! এই অবস্থায় ভোর হল। দিনের আলো ফুটলে, লোকজনের শব্দ কানে যেতে রাত্রের ভয়টা মন থেকে কোথায় গেল মিলিয়ে! নিশ্চিন্ত মনে বেলা ন’টা পর্যন্ত পড়ে ঘুম দিলুম। তার পর উঠে, চা খেয়ে, পাড়ায় বেড়াতে বার হওয়া গেল।

এই সময় একটা ঘটনা ঘটলো তখন আমি তার বিশেষ কোন মূল্য দিই নি-কিন্তু পরে সব কথা মনে মনে আলোচনা করে দেখে সেটা ভারি আশ্চর্য বলেই মনে হয়েছিল। ও-পাড়ার পথে আমার সেই জ্যাঠামশাইয়ের সঙ্গে দেখা, তাঁকে দেখাবার জন্যে আমি মেডেলটা কাল রাত্রে সঙ্গে নিয়েই বেরিয়েছিলুম-কিন্তু বৃন্দাবনদের বাড়িতে নিমন্ত্রণের জন্যে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারি নি・・・

আমায় দেখে তিনি বললেন, “এই যে সুরেন, ভালো আছ? কাল তুমি এসেচ দেখলুম, তখন অনেক রাত, তা আর ডাকলুম না। বোধ হয় বৃন্দাবনের বাড়ি থেকে ফিরছিলে? আমি তখন ছাদে পায়চারি করচি, যে গরম গিয়েচে বাবা কাল রাত্তিরে… তোমার সঙ্গে লোক রয়েচে দেখে আরও ডাকলুম না। ও লোকটি কে? খুব লম্বা বটে-যেন শিখ কি পাঞ্জাবীর মতো লম্বা-তোমার বন্ধু বুঝি? বাঙালীর মধ্যে এমন চেহারা-বেশ, বেশ!”

আমি অবাক হয়ে জ্যাঠামশায়ের মুখের দিকে চেয়ে বললুম, “আমার সঙ্গে লম্বা লোক কাল রাত্তিরে! সে কি জ্যাঠামশায়?”

জ্যাঠামশায় আমার চেয়েও অবাক হয়ে বললেন, “তোমার সঙ্গে লোক ছিল না বলচো? একা যাচ্ছিলে? আমার চোখের দৃষ্টি একেবারে কি এত খারাপ হয়ে যাবে বাবা…”

আমি হেসে বললুম, “তাই হবে, জ্যাঠামশায়। চোখে কি রকম ঝাপসা দেখে থাকবেন। বয়েস হয়েচে তো?..আমার সঙ্গে কেউ ছিল না, তা ছাড়া আপনাদের বাড়ির সামনের আমগাছটার ছায়া-কি রকম আলো-আঁধার দেখেচেন চোখে… অমন ভুল হয়।”

জ্যাঠামশায় যেন রীতিমত হতভম্ব হয়ে গেলেন! বললেন, কি আশ্চর্য কাণ্ড? এতটা ভুল হবে চোখে? আমগাছের এদিকে যখন তুমি টর্চ জ্বাললে, তখন দেখলুম তুমি আর তোমার পেছনে একজন লম্বা মতো লোক-তার পর তুমি টর্চ নিবিয়ে আমগাছের ছায়ার মধ্যে ঢুকলে, তখনও জ্যোৎস্নার আলো আর আমগাছের ছায়ার অন্ধকারে আমি বেশ দেখতে পেলুম লোকটি তোমার পেছনে পেছনে যাচ্ছে তোমার মাথার চেয়েও যেন এক হাত লম্বা তোমার একেবারে ঠিক পেছনে-তবে খুব ভালো তো দেখতে পেলুম না–অতদূর থেকে আর আলো-অন্ধকারের মধ্যে স্পষ্ট কিছু দেখা গেল না তো? এমন কি একবার এ পর্যন্ত মনে হল তোমায় ডেকে জিজ্ঞেস করি তোমার বন্ধুটি কে?-একেবারে এত ভুল হবে চোখের?”

জ্যাঠামশায়কে পুনরায় বুঝিয়ে বললুম, আমার সঙ্গে কাল কেউ ছিল না। আমি একাই ছিলুম, সুতরাং তাঁর দৃষ্টিশক্তির গোলমাল ছাড়া এ-ব্যাপারের অন্য কোনও সিদ্ধান্ত করা চলে না।

সারাদিন বৃন্দাবনের সঙ্গে আড্ডা গিয়ে কাটানো গেল। গতকাল রাত্রের ভয়ের ব্যাপার দিনের আলোয় এত হাস্যকর বলে আমার নিজের কাছেই মনে হল যে, বৃন্দাবনকে সে কথাটা বলিও নি।

রাত্রের ট্রেনে কলকাতায় ফিরবো। বৃন্দাবনদের বাড়ি থেকে চা খেয়ে বাড়ি এসে সুটকেসটা নিয়ে স্টেশনের দিকে রওনা হয়েচি, তখনই সন্ধ্যার অন্ধকার বেশ নেমেচে। বাউরিপাড়ার বড় বাগানটার মধ্যে দিয়ে আসচি-বাগানটা পার হতে প্রায় পাঁচ-ছ মিনিট লাগে-মস্ত বড় বাগান।

বাগানের ঠিক মাঝামাঝি এসে হঠাৎ পেছন ফিরে চাইলুম কি ভেবে। সঙ্গে সঙ্গে আমার সারা দেহে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। আচমকা ভয়ে আমার সর্বশরীর কাঠ হয়ে গেল।

কে ওটা ওখানে দাঁড়িয়ে।

রাস্তা থেকে একটু পাশে আগাছার জঙ্গলের মধ্যে আধ-অন্ধকার এক অদ্ভুত মূর্তি! খুব লম্বা, তার মাথায় ঘোড়ার বালামচির সেই এক লম্বা ধরনের টুপি, পাতলা লোহার চেন দিয়ে থুতনির সঙ্গে বাঁধা-ছবিতে গোরা সৈনিকদের মাথায় যে ধরনের টুপি দেখা যায়?-মুর্তিটা যেন নিশ্চল নিস্পন্দ অবস্থায় আমার দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে! আমার কাছ থেকে মাত্র দশ গজ কি তারও কম দূরে! মরীয়ার মতো আর একটু এগিয়ে গেলুম। এই ভয়ানক কৌতূহল আমাকে চরিতার্থ করতেই হবে যেন! মূর্তি নড়ে না চড়ে না, যেন নিশ্চল পাথরের মূর্তি! কিন্তু বেশ স্পষ্ট দেখচি সাত আট গজ মাত্র দূরে তখন মূর্তিটা। আর ঘোড়ার বালামচির লম্বা

টুপি ও ইস্পাতের চেনের স্ট্র্যাপ্ স্পষ্ট দেখতে পেলুম। আমার পা ঠক্ করে কাঁপতে লাগলো, সারা দেহ কেমন অবশ হয়ে আসচে, মাথাটা হঠাৎ বড় হালকা হয়ে গিয়েচে! বোধ হয় আর আধ মিনিট এ-ভাবে থাকলে মূর্ছিত হয়ে পড়ে যেতুম-কারণ সেই ভীষণ মূর্তিটার মুখোমুখি আমি দাঁড়িয়ে-আমার পা দুটো বেজায় ভারী হয়েচে-নড়বার উপায় নেই মূর্তির সামনে থেকে…

কিন্তু ঠিক সেই সময়ে বাউরিবাগানের পথে লণ্ঠন নিয়ে কারা ঢুকলো। দু-তিন জন লোকের গলার শব্দ শুনে আমার সাহস ফিরে এল। আমি ওদের ডাক দিলুম চিৎকার করে। ওরা ছুটে এল। আমায় ওখানে বনের মধ্যে দেখে তারা খুব আশ্চর্য হয়ে বললে, “ওখানে কি বাবু? কি হয়েচে?”

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024