মরা মানুষের শত্রু নেই-লোকে বলে। কিন্তু আবিদ আলী হাজীর ছিল। যদি না-ই থাকবে তবে তাঁর অপঘাত মৃত্যুর খবর শুনে লোকে হাসাহাসি করবে কেন? হাসাহাসি শুধু নয়, তাঁর মৃতদেহ দাফন নিয়ে যে রকম ঝগড়া বেধেছে তাতে ঢাল-শড়কির তলব হওয়া বিচিত্র নয়।
ঝগড়া বেধেছে দুই দলে।
হাজী বাড়ির দল বলে, হাজী বাবার অছিয়ত মত তাঁর মাজারেই কবর দিতে অইব।
ফকির বাড়ির দল বলে, না কিছুতেই না। বোম্বাই হাজীকে হাবীবাবার মাজারে কবর দেওয়া চলব না।
হাজী বাড়ির কয়েকজন মাজারে কবর খুঁড়তে শুরু করেছিল। ফকির বাড়ির দল লাঠি-ঠ্যাংগা নিয়ে মার-মার করে এগিয়ে গেলে তারা খোন্তা-কোদাল ফেলে পালিয়ে যায়।
ফকির বাড়ির লোকজন মাজার পাহারায় লেগে যায়। তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে:
-দ্যাখলা তো মিয়ারা, পাপ পাপের বাপেরেও খাতির করে না, হ্যাঁ হুঁ-হ্যাঁ! তাল কি আর জায়গা পাইল না পড়নের! পড়বি তো পড় এক্কেবারে বোম্বাই হাজীর মাথায়!
গাঁয়ের ডাকসাইটে মোড়ল বাদশা সরদার গিয়ে হাজির হয় মাজারে। তিনি কথার লেজ ধরে শুরু করেন,-আল্লার মাইর, দুনিয়ার বাইর। আল্লায় না মারলে কি আর এমুন ঠিক ঠিক মাথার তালুতে তাল পড়ে? তোমরা কিন্তু হুঁশিয়ার! হোল্লাম, ওরা সাজাসাজি করতে আছে। সাবেদ মোড়ল যোগ দিছে ঐ দলে। আমিও দেইখ্যা নিমু, বাদশা বাঁইচ্যা থাকতে হাজীবাবার মাজারের মর্তবা নষ্ট করে কোন ব্যাডা! আমি যাই, লোকজনরে খবর দিয়া রাখি গিয়া।
-মোড়ল ঠিক কথাই কইছেন। বোম্বাই হাজীরে এইখানে কবর দিলে হাজীবাবার মাজারের মর্তবা আর থাকব না কিছু।
-একেবারেই বরবাদ অইয়া যাইব। এই মাজারে ধন্না দিলে মানুষের কত মুশকিল আসান অইয়া যায়!
-তোমরা তো জান, আমার খালু শ্বশুর মহী লস্কররে খুন কইর্যা খালাস পাইছিল। কিন্তু কার উছিলায়, তা তো তোমরা জান না। সে যখন হাজতে, তখন বাবার মাজারে নাঁচ ট্যাহা সোয়া পাঁচ আনা আর এক শ’ একটা মোমবাতি মানত করছিল। তারপর জজের কি ক্ষমতা তারে ফাঁসীতে লটকায়। জম তবে হোন আর এক বিত্তান্ত। নলডাঙ্গার রহিমুদ্দিরে তো চিন তোমরা। ওর দাদা আছিল আঁটকুড়া। এই মাজারে আইসা কান্দাকাটার পর যাইট বছর বয়সে এই রহিমুদ্দির বাপের জন্ম হয়।
এ রকম অশ্রুত ও বহুশ্রুত অনেক মুশকিল আসান মনোবাঞ্ছা পূরণ ও দুরারোগ্য ব্যারাম-ব্যাধি মুক্তির কথা বলাবলি হয়। হাজীবাবার মাজারে হত্যে দিয়ে গুলাপ্ত কুষ্ঠরোগী ভালো হয়েছে, অন্ধ চক্ষু ফিরে পেয়েছে, এরকমও শোনা যায়। একই বংশের দুই অংশ দুই বিবদমান দল। আর দুই দলেরই মূল হাজীবাবা।
হাজীবাবা এ বংশের ঊর্ধ্বতন ষষ্ঠ পুরুষ। তিনি ছিলেন কামেল ফকির। দুনিয়া ও আখেরাতের এলেম-কামাল, শরীয়ত-মারেফত; বালা-মুসিবতের তাবিজ-কবচ, ভুক তাক ইত্যাদি অনেক গুণ-কেরামতি হাসিল করেছিলেন তিনি। মানুষের মোখালিফ ভূত- পেত্নী, জিন-পরী, দেও-দানো ছিল তাঁর হুকুমের গোলাম। লোকের মুখে মুখে শোনা যায় তাঁর অলৌকিক কাহিনী। পূর্ব বঙ্গের এমন কোন জায়গা নেই যেখানে তাঁর দু’চার ঘর মুরীদ ছিল না। মৃত্যুকালে তিনি অছিয়ত করে যান বয়োজ্যেষ্ঠ হলেই তাঁর বংশধরদের মধ্যে কেই তাঁর গদির উত্তরাধিকার লাভ করবে না। গদিনশীন হতে হলে অবশ্যই হজ করে আসতে হবে। আর হজ করবার সৌভাগ্য যাদের হবে, তারা হাজীবাবার সমাধিক্ষেত্রে শেষ শয্যা গ্রহণের সৌভাগ্যও লাভ করবে।
হাজীবাবার বড় ছেলে হাজী হেদায়েতুল্লাহ। হঠাৎ ইন্তেকাল হওয়ায় তিনি তাঁর বড় বিবির ঘরের বড় ছেলে কেরামতুল্লাহকে ফকিরালির সব কিছু শিখিয়ে যেতে পারেন নি। তবুও কেরামতুল্লাহ্ ফকিরের সাগরেদমুরীদ ছিল অনেক। হাজীবাবার উরস শরীফ উপলক্ষে যে নজরানা পাওয়া যেত, তা দিয়ে বেশ জাঁক-জমকের সাথেই চলে যেত। পঞ্চাশ বছর বয়সে তিনি মক্কাশরীফ যান। কেউ বলে, তিনি মক্কাশরীফ যাওয়ার পথে ইন্তেকাল করেন। কেউ বলে, তিনি পাঁচ বছর মক্কাশরীফ থাকার নেয়াত করে গেছেন। পাঁচ বছর পরে ফিরে আসবেন।
কেরামতুল্লাহ্ ফকিরের দুই ছেলে-আলী নেওয়াজ ও গুল নেওয়াজ। জ্যেষ্ঠ আলী নেওয়াজ পিতার ফকিরী বিদ্যার সামান্য কিছু পেয়েছিলেন। গুণ-কেরামতি শিখিয়ে না গেলেও কেরামতুল্লাহ্ ফকির ছেলেদের জন্যে চার কলসী মোহর ও সোনা-গয়না মাটির নিচে পুঁতে রেখে গিয়েছিলেন। মক্কাশরীফ যাওয়ার আগে দুই ছেলেকে বাঘমারা ভিটায় নিয়ে গিয়ে দেখিয়েও ছিলেন। গাবগাছের দশ হাত পশ্চিমে ও তেঁতুল গাছের সাত হাত দক্ষিণে মোত্রা ঝোপের মধ্যে জায়গাটা।
পিতা ইন্তেকাল করেছেন-বিশ্বাস করেন আলী নেওয়াজ। এবার হজ করে গদিনশীন হওয়া দরকার। তিনি একদিন গুল নেওয়াজকে বলেন,-চল, এইবার কলসীগুলো তুইল্যা ফেলি। খোদায় বাঁচাইয়া রাখলে আগামী বছরেই মক্কাশরীফ যাওয়ার নেয়াত আছে ইনশাল্লাহ।
গুল নেওয়াজ বলেন, আব্বা হুজুরের তো কোন সঠিক খবর পাইলাম না। তা ছাড়া আল্লার বেশাতরা কেউ এখনো সিয়ানা হয় নাই। ওরা লায়েক হউক। বিয়া-শাদী দ্যান। তারপর ওরা সংসারের ভার-ভাবনা বুইঝা নিয়া যখন আপনারে খালাস দিব, তখন নির্ভাবনায় হজে যান। ভাবনা-চিন্তার মন লইয়া হজে গেলে কি তা কবুল হইব খোদার দরগায়?
দিকথাগুলো মনে ধরে আলী নেওয়াজ ফকিরের। তিনি বলেন, ভাল কথাই কইছ। এখন হজ কইরা আসলে তো আর সংসারের পর খেয়াল থাকব না। আর হজ করার পর সংসার ছাইড়া খোদার এবাদত-বন্দেগীতে মন দিলে বাচ্চা-কাচ্চাগুলো কেউকেউ ফেউফেউ কইর্যা মরব।
তারপর পাঁচ বছর চলে যায়। একদিন গুল নেওয়াজই বড় ভাইকে হজে যাওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেন।
বা আলী নেওয়াজ বলেন, হ্যাঁ, এইবার সংসারের বোঝা মাথার থিকা নামাইছি। চল, আইজ রাত্রে বাঘমারার ভিটায়।
হ্যাঁ, চলেন। গভীর রাত্রে খোন্তা-কোদাল হাতে দুই ভাই গিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে খুঁড়তে আরম্ভ করেন। কিন্তু আশ্চর্য! চারটে কলসীর একটাও পাওয়া যায় না। দুই ভাই মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েন। রাতারাতি তাঁরা সারা ভিটে খুঁড়ে ফেললেন। কিন্তু কলসী চারটে পাওয়া গেল না তো পাওয়াই গেল না!
গ্রামে জানাজানি হয়ে যায় ব্যাপারটা। কেউ কেউ বলে, ‘যক্ষে লইয়া গেছে টাকার কলসী।’
গুল নেওয়াজ বড় ভাইকে বলেন, আমার মনে হয় যক্ষেই লইয়া গেছে। শুনছি, মাটির নিচে বেশি দিন থাকলে কলসীর পা গজায়।
আলী নেওয়াজ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন। বলেন, কি জানি, গায়েবের মালিক আল্লাহ্, আল্লাই জানে।
আলী নেওয়াজ ফকিরের আর হজে যাওয়া হল না। হজে যাবেন কি! ছেলে- মেয়েদের বিয়ে-শাদীতে বে-আন্দাজ খরচ করে তিনি সর্বস্বান্ত হয়ে বসে আছেন। যে ভরসায় ছিলেন তা যে এভাবে হাওয়া হয়ে যাবে, তা কে জানত? অন্য দিকে গুল নেওয়াজ ফকিরের টাকার দবদবি স্পষ্ট বোঝা যায়। দাদার আমলের ঘর-দোরের জায়গায় তিনি কোঠাবাড়ি তুললেন। হাজীবাবা ও অন্যান্য পূর্ব পুরুষদের জরাজীর্ণ মকবরাগুলোর মেরামত করালেন। তাঁর এ কাজে অনেকেই খুশি হয়। আবার কানাকানিও শুরু করে কেউ কেউ। তারপর তিনি যখন হজ করে এসে গদিনশীন হন, তখন গাঁয়ের লোক, এমন কি সাদাসিধে আলী নেওয়াজও বুঝতে পারেন, কলসীগুলো কোন্ যক্ষের সিন্দুকে গিয়ে উঠেছে।
বুড়ো আলী নেওয়াজ সহ্য করেন। কিন্তু তাঁর জোয়ানমর্দ ছেলেগুলো ফুলে-ফুঁসে ওঠে আক্রোশে। রাগে-ক্রোধে তারা গুল নেওয়াজ হাজীর নাম দেয় কলসী পীর। দুই ভাই-এর ছেলেদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ বেধে যায় তুমুল। দু’-এক দফা কিলাকিলি- চিলাটিলিও হয়। আলী নেওয়াজ ফকির দেখলেন, এ বাড়িতে থাকলে আর পারি হবে মা কোন দিন। জীবনের শেষ কটা দিন পারিতে কাটাবার জন্যে তিনি আর শাস্তি হবে নতুন বাড়ি করলেন। এই থেকেই হাজীবাবার বংশ হাজীবাড়িও কিরিবাঘমারা ভিটায় হয়ে যায়।
কলসী পীরের ছেলে আবিদ আলী হাজী। হজ করে আসার ছয় মাসের মধ্যে তাঁরও যেতাষ একটা জুটল। একদিন এক বিয়ের মজলিসে মক্কা-মদীনার নারসের সহ্য তিনি নাকি গোলমাল করে ফেলেছিলেন। যে হাজী মক্কার জমজমকের মদীনার রসূলুল্লাহর রওজা শরীফকে মক্কায় নিয়ে ফেলতে পারেন আর জেদ্দা বন্দর ফোরাত নদীর তীরে অবস্থিত বলে বর্ণনা দিতে পারেন, তাকে যদি কেউ বৌমাই কাজী বলে তবে তার দোষ দেয়া যায় না।
এই ঘটনার পর বোম্বাই হাজী (আসল নাম এখন চাপা পড়ে গেছে) আর কোন দিন কোন মজলিস-দরবারে যান না। কারো সাথে চোখ তুলে কথা বলনে না। মুখে যাদের লাগাম নেই তারা তাঁকে দেখলেই শুনিয়ে শুনিয়ে বলে,এই রে, আইজ যাত্রাভাই খারাপ! ইস্কুলের ছেলেরা পর্যন্ত তাঁকে দেখলে একজন আর একজনকে জিজ্ঞেস করে, ওরে মতি, বল দেখি জেদ্দা বন্দর কোন্ নদীর তীরে অবস্থিত?’
এ আর জানি না! ফোরাত নদীর তীরে। – এ সব ঠাট্টা-টিটকারি যাহোক সহ্য করার মতো। কিন্তু ফকির বাড়ির লোক পুরাতন আক্রোশে যা গালাগাল আর টিটকারি দেয় তা বলতে গেলে না পোড়ে আগুনে, না গলে পানিতে। বোম্বাই হাজীর ভক্ত মুরীদ অনেকেই খারিজ হয়ে গেছে। যারা এখনো যাওয়া- আসা করে, তারা এ সব শুনে বলে, হুজুর, আপনার হুকুমের একটু হুঁ পাইলে দেইখ্যা নিতাম, ওদের জবানের শায়েস্তা করতে পারি কি না।
বোম্বাই হাজী তাদের বুঝ দেন, উহু, জান না তোমরা। ওরা আমার বেহেশতের পথের কাঁটা সাফ করতে আছে। আর ঐ কাঁটা বিছাইয়া দিতেছে নিজেগ রাস্তায়।
এমনি করে বোম্বাই হাজী অসীম ধৈর্যের সাথে চোখ-কান বুজে হজম করেন অনেক গালাগাল আর টিটকারি। মুখ ফুটে প্রতিবাদ করেন নি। মাঝে মাঝে দুনিয়াদারীর ওপর বিতৃষ্ণা এসেছে। দুঃখ-বেদনায় কখনো বা মনে মনে মৃত্যু পর্যন্ত কামনা করেছেন।
বোম্বাই হাজীর প্রত্যাশিত মৃত্যু আসে, কিন্তু আসে অপ্রত্যাশিত ও
অস্বাভাবিকভাবে। ভাদ্র মাস। সুবেহ সাদেকের সময় মসজিদের দিকে যাচ্ছিলেন তিনি। পথে ছিল এক তাল গাছ। উঁচু গাছ থেকে চার আঁটিওলা তাল তাঁর মাথার তালুসই হয়ে পড়ে। ভোরবেলায় দেখা যায়, তাঁর মৃতদেহ পড়ে আছে তাল গাছের নিচে।
‘এ রকম মৃত্যু সহানুভূতি জাগিয়ে তোলা দূরে থাক, শত্রুপক্ষের মনে টিটকারির দুর্বার লোভ জাগিয়ে দেয়। তারা রসিয়ে রসিয়ে বলে, ‘লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। পীর হওনের কী লালচ! হায়-হায়-হায়! তোর বাপ গদির লোভে বোচকা মাইর্যা হাজী অইল। তুই আমাগ চউখে ধূলা দিতে গেছিলি। আল্লা কয়, সবুর, এমুন গজব দিয়া তোরে মারমু, মরণকালে না পাবি মাগ-পোলার মুখ দ্যাখতে, না পাবি এক ফোঁডা পানি!’
শেষ পর্যন্ত ঢাল-শড়কির তলব হয়। ফকির বাড়ির পক্ষে বাদশা সরদার আর হাজী বাড়ির সাবেদ মোড়ল জুটে গেছেন।
ভর পক্ষের রদার তার লোকজনদের উদ্দেশ্যে বলেন, তোমার কাছে পুরান কথা আর কি কইমু। বেবাক মানুষ জানে, এই ফকিরেরা অইতেছে হাজীবাবার গদির আসল হজাদার। হাজীবাড়ির ওরা কলসী মাইর্যা বড় অইছে। ঐ কলসী পীরের পোলা বোম্বাই হকদার এই মাজার শরীফে কবর দিলে মাজারের ফজিলত বরবাদ অইয়া যাইব। এই হাজীবে ওই এই মাজারের মাডি তাবিজ কইর্যা মাজায় দিলে শাস্তিতে গব্ব খালাস অয়। রাস, বাত, শূল বেদনা কমে, গলায় দিলে হাঁপি কাশ আরাম অয়। এই রকম আরো কত ব্যারাম-আজারে যে ফল অয় তার শুমার নাই। এমুন পাক মাডি আমাগ চউখের সামনে নাপাক অইব, আর আমরা ভেড়ী-বকরীর মত হাঁ কইর্যা চাইয়া দেখমু, এইডা কি অইতে পারে?
সকলেই সায় দেয়, না, এইডা কিছুতেই অইতে পারে না।
একজন কিছু সাহস সঞ্চয় করে বলে, একটা কথা কই সরদারের পো। মরা মানুষ লইয়া এই রহম কাইজ্যা-কিরিঙ্কাল করনডা কি ভালো অইতে আছে? এইডা আপসে মীমাংসা করণ যায় না?
-আপস! তোমার কি মাথা খারাপ অইছে, অ্যাঁ? ঐ রহম মরা মানুষ শিয়াল কুত্তায় খাইলে কি অয়?
-না-না, এইডা কি কন সরদারের পো? পীরের আওলাদ-
-পীরের আওলাদ এই বোম্বাই হাজী! তোর দেখছি মাথার মধ্যে ক্যাড়া ঢুকছে।
এই কে আছে, ওরে খালের পানিতে গোট্টাচারি চুব দিয়া আন দেখি।
-থাক, থাক। আমি আর কথা কইমু না। আমার চুক অইছে।
-হুঁ, মনে থাকে যেন।
বাদশা সরদার গলা এক পর্দা চড়িয়ে আবার শুরু করেন, আমার কথায় কান দিও। আইজ আমরা বর্তমান থাকতে যদি হাজীবাবার মাজারের অসমান অয়, তবে আমাগ কি দশা অইব, কও দেখি তোমরা?
-কি দশা অইব আবার! বোম্বাই হাজীর যেই দশা অইছে, হেই দশা অইব।
একজন বলে। -হ, ঠিক কথাই কইছ। হেই দশা অইব। খোদার গজব পড়ব। তাই তোমরা পশ্চিমমুখী অইয়া কিরা কর। তোমরা বাঁইচ্যা থাকতে যেন এমুন বিপরীত কাজ না অয়।
-ঠিক ঠিক। সকলেরই এক রায়।
আলিমুদ্দিন ফকির বলে, কই, ওনাগ তো কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। আমাগ হামকি-ধমকির চোটে ওরা ভয় পাইছে বুঝিন!
সত্যি সত্যি ভয় পেয়েছে হাজী বাড়ির দল। তাদের প্রধান সাবেদ মোড়ল বিপক্ষ দলের খবর সংগ্রহের জন্যে পাঠিয়েছিলেন জাহিদ লস্করকে। সে চুপিচুপি ফকির বাড়ির পেছনের জঙ্গলে গিয়ে উঁচু গাব গাছে উঠে বসেছিল কিছুক্ষণ। ওদের সাজাসাজি দেখে ফিরে এসে সে বলে, অনেক মানুষ জমা অইছে ফকির বাড়ি। ঢাল-শড়কি, লাঠি-ঠ্যাঙ্গা যোগাড় করছে বেশুমার।
সাবেদ মোড়ল বলেন, হুঁ, বুঝতে পারছি, আমার দলের অনেকেই এখন উত্তা পাগড়ি বান্দছে। নাম লেখাইছে ঐ দলে।
তারপর নিজের ভীতি গোপন করে সবাইকে সাহস দেন, তোমরা ঘাবড়াইও না। ওদের অনেক মানুষ, তাতে কি অইছে? আল্লার নাম ইয়াদ কর। আল্লা পক্ষে থাকলে মারামারির সময় ওদের শড়কির গুতায় ওদেরই পেডের ঝুলি বাইর অইব।
সাবেদ মোড়ল ছিলিমের পর ছিলিম টেনে চলেছেন। এক সময়ে বোম্বাই হাজীর বড় ছেলে জাহানজেব এসে চোখ মুছতে মুছতে বলেন, আর ঝগড়া-ফ্যাসাদ কইর্যা কি হইব মোড়লের পো? আব্বাজানকে শিমুলতলার গোরস্থানেই মাটি দেই।
সাবেদ মোড়ল মনে মনে বিরক্ত হন। বলেন,- আইচ্ছা, আপনে যদি চান তবে তাই অইব। কিন্তু তা অইলে কি গদি রাখতে পারবেন? বেবাক খুয়াইতে অইব। ইজ্জত যেডুক বাঁইচ্যা আছে তাও থাকব না।
জাহানজেব আর কোন কথা বলেন না। তিনি জানেন মাজারের আয়ে এখনো বেশ সুখে স্বাচ্ছন্দেই চলছে সংসার। এ আয় বন্ধ হয়ে গেলে যে কি উপায় হবে, ভেবে পান না তিনি।
সদরুদ্দিন শেখ মামলাবাজ। সে বলে, আমার বুদ্ধি যদি নেন তবে ফকির গুষ্ঠিরে দিনে দুফরে আমাবস্যা দ্যাখাইয়া দিতে পারি।
-কি বুদ্ধি আপনের। সাবেদ মোড়ল জিজ্ঞেস করেন।
-থানায় গিয়া খুনের ‘কেস’ লাগাইয়া দিয়া আসি এক নম্বর।
-খুন! সকলে চমকে ওঠে।
-হুঁ, ফকির বাড়ির আলিমুদ্দিন ও জহীরুদ্দিন আসামী আর বাদশাহ্ সরদার হুকুমের আসামী।
-কিন্তু কি ভাবে খাড়া করবেন মামলাডা?
-কিভাবে? কইতে আছি। জাহানজেব মিয়া থানায় গিয়া কইব, হাজী সায়েব ফজরের নামাজ পড়বার জন্যে মসজিদে যাইতেছিলেন। ঐ সময় আসামীরা ইটা-মুগুর দিয়া তাঁর মাথায় বাড়ি মারে।
সাবেদ মোড়ল পরামর্শটা বিবেচনা করে দেখেন। কিছুক্ষণ পর বলেন, উহ, এই ভাবে মামলা খাড়া করণ যাইব না। সাক্ষী-সাবুদে গোলমাল পাকাইয়া ফালাইব। শ্যাষে উণ্ডা ফাডকে যাইতে অইব আমাগই।
সাবেদ মোড়ল হুঁকোর নল টেনে নেন আবার। চোখ বুজে তামাক টানতে টানতে তিনি চিন্তা করছেন। তাঁর কপাল কুঞ্চিত হয়ে ওঠে। এক সময়ে তিনি গা ঝাড়া দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। ঝাঁকির চোটে কল্কের আগুন ছড়িয়ে পড়ে এদিক ওদিক! নিজেকে সামলে নিয়ে মোড়ল উপস্থিত সকলকে বলেন, তোমরা যার যার বাড়ি যাও এহন।
কাজ কাম সাইব্যা জোহরের নামাজের পর চইল্যা আইস। এর মইদ্যে একটা ফয়সালা অইয়া যাইব ইনশাল্লাহ্। ইয়া বলেই চলে যায়। মোড়ল জাহানজেবকে নিচু গলায় বলেন, সব মানুষ ফির্যা আইতে তিন-চার ঘণ্টা লাগব। এর মইদ্যেই সব ঠিক করতে আছি।
তারপর জাহানজেবের কানের কাছে মুখ নিয়ে কিছু বলেন মোড়ল। জাহানজের মাথা নাড়েন।
থা নাড়েন আবার বলেন, খবরদার, কাউয়া-শালিকে দিখুন আপনার বাপপারে। আপনারে গদিতে বসাইতে না পারি তো আমি হাতে চুড়ি দিমু। আপনার বাপজানের আমলে অনেক মুরিদান চইল্যা গেছিল। দ্যাখবেন তারা আবার আপনের মুরীদ অইছে। *একটু থেমে মোড়ল আবার বলেন, উরুসের সময় তো আজকাল আর তেমন আয় হয় না। আমি এমুন ব্যবস্থা করতে আছি, দ্যাখবেন উরুসের আয় তিন ডবল বাইড়্যা গ্যাছে। জাহানজেব বলেন,- আগে তো দাফনের ব্যবস্থা করেন, তারপর-
-সব অইব, সব অইব। তবে একটা আর্জি, মেলার খাজনা আদায়ের ভার দিতে অইব আমারে। যেই ট্যাকা আদায় অইব তার দশ আনা আপনার আর….। কথা শেষ করেন না মোড়ল।
উরসের সময় এখানে মেলা বসে। আগের দিনে জমজমাট মেলা বসত। দোকানপাটে ছেয়ে যেত মোহনপুরের ময়দান। আসত সার্কাস, ভোজবাজি, ঘোড়া- চক্কর, রাধা-চক্কর। দশ দিনেও মেলা ভাঙত না। কিন্তু সেই দিন আর নেই। তিন দিন পরেই মেলা ভেঙে যায় এখন। খাজনা আদায় হয় খুবই সামান্য।
জাহানজেব ভেবে নেন কিছুক্ষণ। তারপর বলেন,- আচ্ছা, দশ আনা-ছয় আনাই ঠিক। আপনি ছয় আনাই পাইবেন।
-আপনার মেহেরবানী। এইবার নিয়া আসেন। দেরি অইয়া যাইতে আছে।
জাহানজেব ঘরে যান। কিছুক্ষণ পড়ে মোড়লকেও ডেকে নিয়ে যান ঘরে। একটু পরে একটা মোড়ক পকেটে পুরতে পুরতে বেরিয়ে আসেন মোড়ল। বলেন, আমি একটু ঘুইরা আসি। বেবাক মানুষ আইলে আমারে একটা খবর দিয়েন।
জোহরের নামাজের পর আবার লোকজন এসে জড় হয় হাজী বাড়ি। সাবেদ মোড়লকে খবর দিয়ে আনা হয়। তিনি বলেন, আগাম পীর সা’বরে আর হাজীবাবার মাজারে রাখতে পারলাম না। একটুও রহম অইল না ওগ দিলে।
সকলের কথাবার্তায় আপসোস ফুটে ওঠে।
মোড়ল আবার বলেন, কি আর করি! না-হক খুনাখুনি কইর্যা দেখছি কোন ফল অইব না। উপরে আল্লা আছে, আল্লায় বিচার করব। তোমরা কয়েকজন শিমুলতলার গোরস্থানে চইল্যা যাও। কবর খোদা শুরু কর গিয়া। আর বিলম্ব কইর্যা কোন ফায়দা অইব না।
চার-পাঁচ জন লোক খোস্তা-কোদাল নিয়ে চলে যায়। সাবেদ মোড়ালের নির্দেশে যোগাই হাজীর গোছলের বন্দোবস্ত করতে লেগে যায় কয়েকজনবদ
জানাজা শুরু হয়েছে। কাতার বেঁধে দাঁড়িয়ে গেছে লোকজন। কেউ নিয়ত পড়ছে, কেউবা তহিনা বেঁধে ফেলেছে। ইমামের কণ্ঠে তত্ত্বীর উচ্চারিত হয় প্রথমবার, ‘আল্লাহু আকবর।’
এমন সময় কোথা থেকে বহু লোক এসে শামিল হয় জানাজায়। শেষ কাতারের পেছনে আরো আট-দশ কাতার পড়ে যায়।
জানাজার শেষে সবাই বিস্মিত হয় এত লোক সমাগম দেখে। তারা আরো বিস্মিত হয় যখন দেখে, বাদশা সরদার গিয়ে দাঁড়িয়েছেন জাহানজেব মিয়ার সামনে। তাঁর পেছনে একজন অপরিচিত হাজী।
বাদশা সরদার জাহানজেবের হাত ধরে একরকম কেঁদে ফেলেন, আমারে মাপ কইর্যা দিয়েন, মিয়াসাব। কোন দায়-দাবী রাইখেন না আমার উপর। আমি জাহিল । মানুষ অপরিচিত হাজী সায়েব বলেন, আহ্-হা, আমি এত দূরদেশ থেইকা আইছিলাম এত আরজু লাইয়া। কিন্তু খোদার এমন মর্জি, হাজী সা’বের সাথে আর দেখা হইল না। এমন পরহেজগার খোদাপাবন্দ লোক ছিলেন হাজী সা’ব!
হাজী সায়েব তাঁর কাঁধের জাফরানী রঙের রুমালে চোখ মোছেন। আবার বলেন তিনি, তবু আল্লার কাছে হাজার শোকর, তাঁর জানাজায় শরীক করবার জন্যে আইজ আমারে টানতে টানতে লইয়া আইছে এইখানে।
জাহানজেবের সাথে মুসাফা করে হাজী সায়েব বলেন,- আমার বাড়ি মমিনসিং জিলা। হাজীসা’ব আর আমি একই বছর মক্কাশরীফ যাই। এক কমজাত মোয়াল্লেম আমার ট্যাকা-পয়সা লইয়া ভাইগা যায়। তখন এই হাজীসা’ব আমাকে পাঁচ শ’ ট্যাকা দেন। এই ট্যাকা না পাইলে আমি আর দেশে ফিরা আসতে পারতাম না। এতদিন ট্যাকা যোগাড় করতে পারি নাই বুইল্লা আইতে পারি নাই। আহ্-হাহা! দুইডা দিন আগেও যদি আইতে পারতাম।
হাজী সায়েব চোখ মুছতে মুছতে জুব্বার জেব থেকে একটা মোড়ক বার করেন। মোড়ক খুলে এক তাড়া নোট জাহানজেবের হাতে দিয়ে বলেন, যাঁর কাছে দায়িক ছিলাম তাঁর হাতে দিতে পারলাম না। এই আপসোস আমার যাইব না কোন দিন! তবু আল্লার কাছে হাজার শোকর, তাঁর ফরজন্দের কাছে দিয়া যাইতে পারলাম।
বাদশাহ সরদার বলেন, হাজীসা’ব বিচারাইতে বিচারাইতে হাজীবাবার মাজারে আসছিলেন। আমারে পাইয়া জিগাইলেন,- আবিদ আলী হাজী সা’বের বাড়ি কোন্ দিগে? তখন তাঁর কাছ থিকা এত কথা জানতে পারলাম।
একটু থেমে আবার বলেন সরদার, হাজীবাবার মাজারে কবর খুঁড়বার বন্দোবস্ত কইর্যা আইছি।
ব্যা আই শিমুলতলায় যে গোর খোদা অইয়া গ্যাছে! সেইডার কি অইব ? সাবেদ মোড়ল বলেন। -রাইখ্যা দেও ওইডা। ওইডার মধ্যে আমারে কবর দিও।
বিরাট শবযাত্রা চলেছে হাজীবাবার মাজারের দিকে। মুর্দার খাটে আরো কয়েক জনের সাথে কাঁধ লাগিয়েছেন সাবেদ মোড়ল ও বাদশা সরদার।
৩ রাজার দেউড়ি, ঢাকা
৯ ফাল্গুন, ১৩৬০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৪
Leave a Reply