জীবনকথা
তিনি খবর পাইলেন বাজান স্কুলে নাছেরা ইংরেজের ভাষা শিক্ষা করিতেছেন। এর চাইতে বড় অপরাধ তাঁর জামাতের লোকদের মধ্যে আর কিছুই ছিল না। সুতরাং বাজানকে ইংরেজি পড়া ছাড়িয়া দিতে হইল। তিনি বাংলা ছাত্রবৃত্তি স্কুলে যাইয়া ভর্তি হইলেন। সেই ছাত্রবৃত্তি স্কুলের যা পাঠ্যবই তা এন্ট্রান্স ক্লাসের বইএর চাইতে কম কঠিন ছিল না। যোগেন্দ্রনাথ সরকারের আত্মোৎসর্গ, কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারকৃত হাফেজের অনুবাদ-সম্ভাবশতক, নবীন সেনের পলাশীর যুদ্ধ, মাইকেলের মেঘনাদবধ এবং যাদবের গণিত তখন ছাত্রবৃত্তির পাঠ্য ছিল। বাজান যদি ইংরেজি স্কুলে পড়িতেন তবে ডেপুটি হইতে পারিতেন, উকিল হইতে পারিতেন। আমাদের ছোট সংসারে কোনো প্রকারের অর্থকষ্ট থাকিত না।
বাজান ছাত্রবৃত্তি পাশ করিয়া বাড়ি বসিয়া জমিজমার তদারক করিতেছিলেন। বাজানের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক রাজমোহন পণ্ডিত মহাশয় ফরিদপুরে হিতৈষী এম,ই, স্কুল নামে একটি নূতন বিদ্যালয় খোলেন। তিনি বাজানকে ডাকিলেন সেই স্কুলের শিক্ষকতা করিতে। সামান্য বেতন। মাসে মাত্র পাঁচ টাকা। গুরুর আদেশে বাজান যাইয়া এই স্কুলে চাকরি লইলেন। ইহাকে চাকরি বলা যায় না। তিনি শিক্ষকতার কাজে নিজেকে উৎসর্গ করিলেন। শুনিয়াছি সেকালের সর্বজনের আকাঙ্ক্ষার বস্তু পুলিশের চাকরি বাজানকে দেওয়ার প্রস্তাব হইয়াছিল কিন্তু শিক্ষকতার কাজ ছাড়িয়া তিনি তাহা গ্রহণ করেন নাই। তিনি বলিতেন, শিক্ষকতার কাজ বড়ই সম্মানের। দেশের সেবা করিতে ইহার চাইতে বড় কিছু নাই। এই স্কুলের কাজেই তিনি প্রায় সারাজীবন কাটান।
একবার এই স্কুলের খড়ের আটচালা ঘর আগুনে পুড়িয়া গেল। ফরিদপুর বাজারের একটি গুদামঘরে স্কুলের নূতন আবাস হইল। ছাত্রসংখ্যা কমিতে কমিতে ৮/১০ জনে পরিণত হইল। বেতন না পাইয়া স্কুলের অন্যান্য শিক্ষকেরা স্কুল ছাড়িয়া গেলেন। কিন্তু স্কুলের হেডমাস্টার বাবু সুরেশচন্দ্র বসু আর বাজান স্কুল ছাড়িলেন না। একটি কাঠের উপরে কালো রং করিয়া সাদা কালিতে বড় বড় অক্ষরে লেখা ছিল, ফরিদপুর হিতৈষী এম, ই, স্কুল। সেই তক্তাখানা স্কুলের সামনে লটকাইয়া দুই শিক্ষক অপেক্ষা করিতে লাগিলেন নতুন নতুন ছাত্রের। যে কয়জন ছাত্র ছিল তাহাদের লইয়াই বিদ্যাদানের তপস্যা আরম্ভ করিলেন। সে কি ঘোর তপস্যা। ছাত্র-বেতন হইতে মাসে ৩/৪ টাকার বেশি উঠিত না। তাহাই দুইজনে ভাগ করিয়া লইতেন। সুরেশবাবু থাকিতেন শহরে। আমাদের মতো কোনো জমিজমার আয় ছিল না। কি করিয়া যে সংসার চালাইতেন তা খোদাই জানেন। কিন্তু দুই শিক্ষকের স্কুলের কাজে বিরাম ছিল না। প্রতিদিন ঘণ্টা বাজাইয়া যথাসময়ে স্কুল বসিত। সেই ঘণ্টা হেডমাস্টার মহাশয় নিজেই বাজাইতেন। রুটিন অনুসারে দুই শিক্ষক যার যার ক্লাসে পড়াইয়া যাইতেন। ছুটি হইলে দুইজনে বসিয়া স্কুলের ভবিষ্যৎ চিন্তা করিতেন। কোন ছাত্রটি ভালো পড়াশুনা করে না, কি করিয়া তাহাকে পড়াশুনায় মনোযোগী করা যায় সেজন্য নতুন শিক্ষাপদ্ধতি অনুসন্ধান করিতেন। স্কুলটি শুধু একটি নাম নয়, একটি প্রতিষ্ঠান, হিন্দুর দেবালয় বা মুসলমানের মসজিদের মতো ইহা পবিত্র।
এই দুইজন পূজারি এই প্রতিষ্ঠানকে বাঁচাইয়া রাখিতে তিলে তিলে নিজদিগকে দান করিতে লাগিলেন। যতদূর মনে পড়ে সেবার দেশে আকাল পড়িয়াছিল। ব্রহ্মদেশ হইতে আতপ চাউল আমদানি হইয়া দশটাকা মণ দরে বিক্রয় হইত। এই সময়ে আমরা চাউল কিনিয়া খাইতাম। বিনা বেতনে চাকরি করিয়া বাজান কি করিয়া সংসার চালাইতেন ভাবিয়া পাই না। এত সব অসুবিধার মধ্যে স্কুলের কাজ সমানভাবেই চলিতে লাগিল। দুই শিক্ষক একত্র হইয়া কেবল ভাবিতেন, কি করিয়া স্কুলের ছাত্র বাড়ানো যায়। কিন্তু ছাত্রসংখ্যা বাড়ে না। বাজারের মধ্যে গুদামঘরে স্কুল বসে। মাত্র দুইজন শিক্ষক। কে চাহে নিজের ছেলেকে এই স্কুলে দিতে। আমি তখন এই স্কুলে পড়িতাম। অন্য স্কুলের ছেলেরা আমাদিগকে দেখিয়া খেপাইত।
হিতৈষী স্কুলের ভেড়ি, কানকাটা মেড়ি।
ইহার জবাব আমরা দিতে পারিতাম না। অন্যান্য স্কুলে কত শান-শওকত। খেলার মাঠ, দপ্তরি, লাইব্রেরি আরও কত কিছু। আমাদের স্কুলের আধা-ভাঙা কয়েকখানা টুল, আর শিক্ষকদের বসিবার দু’খানা চেয়ার, তাহাও শিক্ষকদের দারিদ্র্যের মতোই জীর্ণ অবয়বটা কোনোরকমে খাড়া করিয়া আছে। আমরা এই গালির কোনোই জবাব দিতে পারিতাম না। নীরবে তাহাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য হজম করিতাম।
যে মহাজন তাঁর গুদামঘরে স্কুলের স্থান করিয়া দিয়াছিলেন তিনি কোথাও গুদাম ভাড়ার ব্যবস্থা করিয়া হেডমাস্টারকে অন্যত্র স্কুল লইয়া যাইতে হুকুম করিলেন। দুই শিক্ষক আবার পরামর্শ করিতে বসিলেন, কি করিয়া স্কুলটি বাঁচাইয়া রাখিবেন। কোথায় কোন জায়গায় স্কুল লইয়া যাইবেন।
(চলবে)
Leave a Reply