শশাঙ্ক মণ্ডল
শিল্প-বাণিজ্য
তৃতীয় অধ্যায়
সুন্দরবন উঠিত করে নতুন কৃষিযোগ্য এলাকায় পরিণত করার কথা বিবেচনা করে সাগর আইল্যান্ড সোসাইটি-এর পক্ষ থেকে সাগরদ্বীপের বিভিন্ন এলাকাতে তুলা চাষের ব্যবস্থা করা হয়েছিল উনিশ শতকের মাঝামাঝি। ১৮৫০-৬০ খ্রীষ্টাব্দে উঁচু জমিতে অক্টোবরে বীজ লাগিয়ে পরের বছর মার্চ মাসে তুলা খেত থেকে তোলা হচ্ছে। তুলার উন্নত মান সম্পর্কে প্রশংসা করে বলা হচ্ছে মিশরের এবং আমেরিকার উন্নতমানের তুলার সমকক্ষতা দাবি করতে পারে। সাগর আইল্যান্ড সোসাইটি সে যুগে উন্নতমানের বীজ আমেরিকা ও মিশর থেকে সংগ্রহ করে সুন্দরবনের সাগর সন্নিকটবর্তী এলাকায় তুলা চাষের চেষ্টা চালাল। কিন্তু এ প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি।
তার পিছনে কারণগুলি হল: অক্টোবর-নভেম্বর মাসে জমিতে জল থাকার জন্য তুলা চাষ করার জন্য বেশি জমি পাওয়া গেল না। সুন্দরবনের পশ্চিমপ্রান্তে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ডায়মন্ডহারবার এলাকায় কৃষিযোগ্য জমিতে সহজে নদীর জল উঠতে পারে কারণ জমি অনেকটা নিচু। এ ছাড়া গ্রীষ্মের শুরুতে অসময়ের বর্ষা তুলা চাষের ক্ষেত্রে অসুবিধা সৃষ্টি করতে লাগল। সাগর আইল্যান্ড সোসাইটি ১৮৬০-৭০ এর দিকে তুলা চাষ বন্ধ করে জমি প্রজা বিলি করার দিকে মনোনিবেশ করলেন। সুন্দরবনের বিভিন্ন প্রান্তের নবসৃষ্ট জমিতে তুলা চাষ করার ব্যাপারে উনিশ শতকের মাঝামাঝি সরকার এবং ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেবার আরও কতকগুলি ঘটনা আমরা লক্ষ করি। (১২)
– তাঁতিদের মজুরি সম্পর্কে বিভিন্ন সময়ের যে সব তথ্য জানা যাচ্ছে সেগুলি হল সে যুগের জীবনযাত্রার পক্ষে তাঁতের কাজ লাভজনক ছিল। সমগ্র উনিশ শতক জুড়ে এ ছবি সুন্দরবনের বিভিন্ন তাঁতি অধ্যুষিত এলাকায় তা লক্ষ করা যায়। উনিশ শতকের শেষের দিকে তাঁতিদের জীবনে বেশ সঙ্কট আসে। অনেকে এ পেশা ত্যাগ করে কৃষিকাজের দিকে ঝুঁকে পড়তে বাধ্য হয়। বসিরহাটের পিফা গ্রামের এক ব্যবসায়ী বছির মোল্লার হিসাবের খাতা থেকে জানা যাচ্ছে-তাঁতিদের এক কুড়ি গামছার মজুরি হিসাবে সুতা ও টাকায় তা মিটিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
তাঁতিদের যে সুতা দেওয়া হচ্ছে তাতে সে যুগের হিসাব অনুযায়ী দুই আনার মত সুতা থেকে যাচ্ছে আর মজুরি হিসাবে পাচ্ছে মোট মজুরি ২০ খানা গামছার জন্য ১ টাকা ২ আনা। ১৮৯০ সালে একজন কৃষিশ্রমিক সারাদিন কাজ করলে ২ আনা মজুরি পেত। তাঁতে দুজন শ্রমিক তিনদিনের পরিশ্রমে ৪০ খানা ভাল গামছা তৈরি করতে পারে। দুজন তাঁতশ্রমিক তিনদিন পরিশ্রম করে ২ টাকা ৪ আনা উপার্জন করত। তাঁতির জীবনে প্রতিনিয়ত দুঃখ-দারিদ্র্য তাকে সমাজের তলার মানুষ হিসাবে চিহ্নিত করেছিল। ১৮৫৭ সালে ২৪ পরগনার হাড়োয়া ভাঙর এলাকার দুটি গ্রাম পর্যবেক্ষণ করেন Ralph Smith। তাঁর রিপোর্টে জানা যাচ্ছে একটি বাড়ির চার জন মিলে ধুতি চাদর তৈরি করছে এবং তারা সুতা নিজের হাতে কেটে নিচ্ছে।