নাদিরা মজুমদার
নেপচুন হলো সৌরমণ্ডলের সর্বশেষ ও দূরতম গ্রহ। গাঢ়, কঠিণ হিমশীতল গ্রহ সে, এবং চাবুকের মতো নিরত সুপারসনিক হাওয়া প্রবাহিত হচ্ছে। আচরণে খু-উ-ব অ-বন্ধুসুলভ সে।
সূর্য থেকে প্রায় ৪.৪৭২১ বিলিয়ন কিলোমিটার (সূর্য-পৃথিবীর দূরত্ব মাত্র ১৫০.৭৯ মিলিয়ন কিলোমিটার) দূরে রয়েছে বলে খুব কম সূর্যালোক, অর্থাৎ কম শক্তি পাচ্ছে নেপচুন; তবুও বৃহস্পতির চেয়ে তিনগুণ এবং আমাদের পৃথিবীর তুলনায় নয় গুণ বেশি শক্তিশালী সুপারসনিক বায়ু সৃষ্টি করছে! সূর্যকে মাত্র একবার পরিক্রমণ করতে নেপচুনের প্রায় একশো পয়ষট্টি (১৬৫) বছর লাগে। অর্থাৎ পৃথিবীর কোনো মানুষের পক্ষেই জীবনে একবার অন্তত নেপচুনের পূর্ণ সৌর পরিক্রমণ দেখার সৌভাগ্য হয় না।
ভয়েজার ২-য়ের ’দেখা’ ও তোলা নেপচুন; সৌজন্যে : নাসা
আসলে, আমাদের সৌর মণ্ডলে নেপচুন হলো দ্রুততম গতি সম্পন্ন বায়ু প্রবাহের আখড়া। বায়ু প্রবাহের গতি বা স্পিড সর্বোচ্চ ঘন্টাপ্রতি দুইহাজার চারশো (২৪০০) কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। অর্থাৎ, পৃথিবীতে শব্দের গতি’র প্রায় দ্বিগুণ পরিমাণ হয়ে থাকে। একটি বাস্তবতা হলো যে নেপচুন সূর্য থেকে যে পরিমাণ শক্তি গ্রহণ করে – সেটির চেয়ে দুই দশমিক ছয়এক (২.৬১) গুণ বেশি পরিমাণ শক্তি সে নির্গত করছে বা বের করে দিচ্ছে। তার প্রচণ্ড তীব্র স্পিডধারি বায়ু প্রবাহের জন্য শক্তির যোগান আসছে সম্ভবত গ্রহের ভেতর থেকে বের করে দেয়া উত্তাপ থেকে। অবশ্য তার পেটের ভেতরে বিদ্যমাণ তাপ-উৎসের প্রকৃতি নিয়ে বিতর্ক চলছে।
ইউরেনাসের মতো নেপচুনও গ্যাস-দানব নয়, ’হিম-দানব গ্রহ’ বা জায়ান্ট-আইস প্ল্যানেট। কাঠামোগতভাবে এই দুই গ্রহ অভিন্ন, সদৃশ। ইউরেনাসের মতো – নেপচুন গ্রহের প্রায় আশি শতাংশ ভর উত্তপ্ত ঘন নিবিড় ’বরফাকৃত’ হিম ব¯তু – জল, মিথেন ও অ্যামোনিয়া দিয়ে গঠিত, এবং তা ছোটো শিলাজ মর্মস্থলকে ঘিরে রয়েছে। চার দানব-গ্রহের মধ্যে নেপচুনের ভরই সবচেয়ে ঘন নিবিড়তম। এ-তো মিল রয়েছে বলে দুই গ্রহ ইউরেনাস ও নেপচুনকে ’কাজিন’ বলা যায়। এখন পর্যন্ত ইউরেনাসের মতো, পৃথিবী থেকে পাঠানো একটিমাত্র নভোযান নেপচুনকে অনেকটা কাছ থেকে দর্শণ দিয়েছে। এক অর্থে, ইউরেনাসের মতো নেপচুন সম্বন্ধেও আমাদের চেনা-জানা সবচেয়ে কম, অথচ আমাদের সৌর মণ্ডলের চৌহদ্দি পেরিয়ে – মহাজগতে আমরা অন্য আরো যেসব জগতের সন্ধান পাচ্ছি, সেখানে নেপচুন-সাইজের ভিন্ন শ্রেণির গ্রহরা অন্যান্য নক্ষত্রদের চারদিকে পরিক্রমণ করছে। মহাবিশ্বের মহাকাশে আমাদের সৌরজগতের অনন্যতা নির্ধারণ করতে হলে অন্যান্য সৌরমণ্ডল সম্বন্ধে যেমন আমাদের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করতে হবে, একইভাবে নেপচুন নামক ঝরঝরে উজ্জ্বল নীল রঙের প্রচন্ড উত্তাল হাওয়ায় নিমজ্জিত গ্রহটিকে জানতে হবে।
বৃহস্পতি ও শনি গ্রহদুটোর মতো নেপচুনের বায়ুমণ্ডলও প্রধানত হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম দিয়ে গঠিত; তবে যৎসামান্য মিথেনও রয়েছে। এই মিথেন সূর্যালোকের লাল আলো শুষে নিচ্ছে ও নীল আলোকে বা রশ্মিকে প্রতিফলিত করছে; তাই গ্রহটি গভীর নীল রং ধারন করে আছে। তার বায়ুমণ্ডলের নিচেয় রয়েছে জল, অ্যামোনিয়া, মিথেন ইত্যাদির সংশ্রিণে সৃষ্ট সু-বি-শা-ল এক মহাসাগর। বায়ুমণ্ডলের তী-ব্র, সু-তী-ব্র চাপে মহাসাগরটি আধা-কঠিন অবস্থায় রয়েছে। তাই, আমাদের কাছে নেপচুন হিম-দানব নামে পরিচিতি পেয়েছে। অবশ্য হিম বা বরফ বলছি বটে তবে বাড়ির ফ্রীজারে যে বরফ আমরা বানিয়ে থাকি তার সঙ্গে নেপচুনের বরফ বা হিমের কোনো সাদৃশ্য নেই; এবং যদি কোনোদিন নেপচুনে যাত্রাবিরতি করতে হয়, সেখানে জলের সঙ্গে এই নেপচুন-বরফ খাওয়া বিপজ্জনক হবে। যাহোক, এই হিম বরফের তাপমাত্রা, প্রচণ্ড তীব্র চাপের কারণে – কয়েক হাজার ডিগ্রী হলেও হতে পারে; আশ্চর্য্য নয় কিন্তু! হিমশীতল অথচ উত্তপ্ত, এই হিম-উত্তপ্ত মহাসাগরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত বিদ্যুৎ কিšতু নেপচুনের শক্তিশালী এবং অস্বাভাবিক রকমের জটিল বিদ্যুৎ-ক্ষেত্র তৈরি করে থাকতে পারে; (নেপচুনের চুম্বক ক্ষেত্র পৃথিবীর চুম্বক ক্ষেত্রের চেয়ে সাতাশগুণ শক্তিশারী)। বিজ্ঞানীদের ধারণা যে গ্রহটির হিমশীতল মেঘের নীচে সুপার উত্তপ্ত জলের মহাসাগর থাকতে পারে, এবং অবিশ্বাস্য রকমের সু-তী-ব্র চাপের কারণে সেই মহাসাগরীয় জল টগবগিয়ে ফুটতে পারছে না!
আমরা যদি কোনোভাবে সুযোগমতো নেপচুনের মধ্যে ঝাঁপ দিতে বা ডুব দিতে পারি তো তার ’পেটের’ তাপমাত্রা এবং চাপ – দুইই দ্রুত বেড়ে যাবে। কমপিউটারে ’সিমুলিউশন’ করে দেখা গেছে যে প্রায় সাত হাজার কিলোমিটার গভীরে তাপ ও চাপের বিস্তার বা প্রসার এতোটাই বেড়ে যায় যে মিথেনের উপাদানগুলো আলাদা আলাদা হয়ে যায় এবং সৃষ্টি হয় : কার্বন ও হাইড্রো জেনের। হাইড্রোজেন ওজনে হালকা পাতলা বলে নেপচুনের বায়ুমণ্ডলের মধ্যে উঠে আসে, এবং পরিবেশগত কর্মকান্ডের মাধ্যমে কার্বন হীরক-কেলাসে (ক্রিস্টাল) পরিণত হয় ও গ্রহের মর্মস্থলের দিকে ক্রমশ নেমে আসতে থাকে।
শিল্পীর কল্পনায় : নেপচুনে হীরক-বৃষ্টি হচ্ছে; সৌজন্যে : সায়েন্সডটকম
(হীরক আসলে আমাদের পরিচিত ’কার্বন’ নামক মৌলিক উপাদান ছাড়া আর কিছু নয়। আমরা যে পেন্সিল দিয়ে লিখি, সেই পেন্সিলের লিখনকর্ম করতে ব্যবহার হচ্ছে ’গ্রাফাইট’ এবং গ্রাফাইটও ’কার্বন’। কার্বনের পারমাণবিক গঠণ ভিন্ন ভিন্ন হয়ে হীরক ও গ্রাফাইটের সৃষ্টি করেছে; কয়লাও কার্বন। পৃথিবীতে, হীরক হলো কঠিণতম প্রাকৃতিক ব¯তু, এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় রত্ন হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকে। তাছাড়াও, ড্রিলিং মেশিনসহ নানা ধরনের গুরুত্বপূর্ণ প্রায়োগিক শিল্পে হীরক ব্যবহার হয়ে থাকে।
নেপচুন গ্রহে কল্পনাতীত উচ্চ চাপ ও তাপজনিত কারণে হীরক-বৃষ্টি ঘটা যতো সহজ, পৃথিবীতে তা ঘটে না বা কখনো ঘটেছে বলে প্রমাণ নেই। পৃথিবীতে হীরক দুষ্প্রাপ্য বস্তু একটি। পৃথিবীতে যেসব প্রাকৃতিক হীরক পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলোর বয়স এক (১) বিলিয়ন থেকে সাড়ে তিন (৩.৫) বিলিয়ন বছর। এগুলোর বিরাট অংশই আবার সাধারণত পৃথিবীর পৃষ্ঠদেশ থেকে নিচে অভ্যন্তরে একশো পঞ্চাশ (১৫০) থেকে দুইশো (২০০) কিলোমিটার গভীরে সৃষ্টি হয় বটে, তবে সৃষ্টি সম্ভব কেবলমাত্র সেসব স্থানেই – যেখানে বিগত কয়েক বিলিয়ন বছর ধরে পৃথিবীর আদি মহাদেশ সুস্থিত অবস্থায় রয়েছে; এসব অঞ্চলকে বলা হয় ’ক্রেটন’ (পৎধঃড়হং)। প্রাকৃতিক হীরক সাধারণত ’কিম্বারলাইট’ নামক আগ্নেয় শিলায় পাওয়া যায়। অপরদিকে, আমাদের পরিচিত কয়লা পাওয়া যায় স্তরীভূত শিলায়।)।
১৯৮৯ সালে নেপচুনের কাছ দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় ভয়েজার ২ – গ্রহটির দক্ষিণ গোলার্ধে বিশাল ডিম্বাকৃতি ঝড় দেখেছিলো। ঝড়টি এ-তো-ই বিশাল ছিলো যে আমাদের পৃথিবীকে সম্পূর্ণ ঢেকে দিতে পারত। বৃহস্পতির বিখ্যাত ’গ্রেট রেড স্পট’-য়ের কথা স্মরণ করে বিজ্ঞানীরা নেপচুনীয় ঝড়টির নামকরণ করেন ’গ্রেট ডার্ক স্পট’।
ভয়েজার ২-য়ের তোলা নেপচুনের ’গ্রেট ডার্ক স্পট’; সৌজন্যে : নাসা
১৯৯৪ সালে হাব্ল্ স্পেস টেলিস্কোপের সাহায্যে ’গ্রেট ডার্ক স্পট’-য়ের ছবি নেয়ার চেষ্টা করা হলে দেখা যায় যে নেপচুনের এই গাঢ় স্পটটি আর নেই; মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় উধাও হয়ে গেছে তো গেছে, তার আর দেখা মেলেনি। তার মানে, এর স্থায়ীত্বকাল বৃহস্পতির লার রঙের স্পটের চেয়ে অনেক কম ছিলো। অবশ্য, একই সময়ে হাবল টেলিস্কোপ নেপচুনে ঘটে যাওয়া অনেক নতুন নতুন বিশাল বিশাল ঝড়বাদলার ছবি তুলেছে এবং বার বার তুলেছে।
আমাদেরকে চমৎকৃত করার মতো আরো কিছু বৈশিষ্ট্য নেপচুনের রয়েছে। যেমন : মঙ্গল ও পৃথিবীর মতো সে-ও সূর্যের চারদিকে অক্ষীয় পরিক্রমণের সময় সূর্যের আপেক্ষে আটাশ (২৮) ডিগ্রী পরিমাণ কাত হয়ে থাকে। কাত হয়ে থাকার অর্থ হলো যে পৃথিবীর মতো নেপচুনেও ঋতু-পরিবর্তন হয়। কিন্তু এই ঋতু-পরিবর্তনের ’প্রাকৃতিক’ সমস্যা হলো যে সূর্যকে একবার ঘুরে আসতে নেপচুন সময় নিচ্ছে, পৃথিবীর হিসেবে প্রায় একশো পঁয়ষট্টি (১৬৫) বছর বা ষাট হাজার একশো নব্বই দিন (পৃথিবী প্রায় ৩৬৫ দিনে একবার সূর্যের চারদিকে ঘুরে আসে)। তার মানে, নেপচুনের সুদীর্ঘ একটি বছরের চারটি ঋতুর প্রতিটির স্থায়ীত্ব চল্লিশ বছরেরও বেশি। আর ছয় ঋতুর দেশ বাংলাদেশের হিসেবে এক একটি ঋতুর স্থায়ীকাল সাতাশ (২৭) বছরেরও বেশি। সুদীর্ঘ নেপচুনীয় বছরের প্রতিটি ঋতুর মেয়াদ অত্যন্ত দীর্ঘ।
আবার কখনোবা নেপচুন সূর্য থেকে আ-রো দূরে সরে আসতে আসতে – এমনকি বামণ গ্রহ প্লুটোকেও পেরিয়ে দূরে চলে আসে। এমন পরিস্থিতিতে প্লুটো যা করতে পারে – তাই করে থাকে। সে তার অত্যন্ত অদ্ভুদ ইকসেন্ট্রিক, ডিম্বাকৃতির কক্ষপথ সমেত গুটিশুটি নেপচুনের কক্ষপথের ভেতরে গিয়ে আশ্রয় নেয়। প্লুটো এভাবে প্রায় বিশ বছর ধরে নেপচুনের আশ্রয়ে থাকে। ফলে, এভাবে আশ্রয়ে থাকাকালীন সময়ে নেপচুন নয়, প্লুটোই সূর্যের কাছাকাছি অবস্থান করে। সর্বশেষ, ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত প্লুটো সূর্যের সান্নিধ্য পেয়েছে। আমাদের পৃথিবীর হিসেবে, প্রতি দুইশো আটচল্লিশ বছর পর পর এই ঘটনাটি ঘটে। যাহোক, নেপচুন-প্লুটোর কাছাকাছি অবস্থানের জন্য, প্লুটো কি একদিন অভিকর্ষের চাপে ভেঙ্গে ধ্বসে নেপচুনের ওপরে হুমরি খেয়ে পড়বে না? না, সেরকম আশঙ্কা নেই। কারণ, সূর্যকে পরিক্রমণকালে নেপচুন যখন তিনটি অধিস্থাপন সৃষ্টি করে, প্লুটো তখন সৃষ্টি করে দুইটি অধিস্থাপন। প্যাটার্ণের এই পুনরাবৃত্তি নেপচুন ও প্লুটোকে নিকটবর্তী হতে দেয় না। তাই অভিকর্ষের প্রতাপে দুমড়ে মুচড়ে ধ্বসে পড়ার আশংকা প্লুটোর নেই।
বাকি তিন দানব-গ্রহের প্রতিটিরই কয়েকটি করে বড়ো সাইজের উপগ্রহ বা চাঁদসহ আরো কয়েকটি ছোটো সাইজের চাঁদ নিয়ে নিজস্ব উপগ্রহীয় বা চান্দ্র সংসার রয়েছে। কিšতু নেপচুনের সেরকম কিছু নেই। অবশ্য বলা হয় যে নেপচুনের চোদ্দটি (কখনোবা ষোলোটি) চাঁদ রয়েছে। আসলে নেপচুনের একটি মাত্র বড়ো সাইজের চাঁদ রয়েছে যেটির নাম হলো ’ট্রাইটন’ (ঞৎরঃড়হ)। আবার ট্রাইটনই হলো সৌর মণ্ডলের একমাত্র বড়ো সাইজের চাঁদ যেটি নাকি তার নিজের গ্রহ (নেপচুন) যে দিক বা পথ ধরে পরিক্রমণ করছে – সে তার বিপরীত পথ (রিট্রোগ্রেইড কক্ষপথ) ধরে পরিক্রমণ করছে। ট্রাইটনের এই স্বভাবগত বিপরীত আচরণ থেকে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন যে সুদূর অতীতে, সৌর মণ্ডলের একেবারে অন্য কোনো এলাকায় স্বাধীন সত্ত্বা হিসেবে ট্রাইটনের জন্ম হয়েছিলো। সেখান থেকে তাকে নেপচুনের অভিকর্ষ পাকড়াও করে নিয়ে আসে নেপচুনের আওতায়।
বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস যে ট্রাইটনকে হরণ পর্বকালে গ্রহের আদি উপগ্রহীয় বা চন্দ্র পরিবারটি সম্পূর্ণরূপে স্থিতিহীন হয়ে পড়েছিলো; কারণ অনিবার্যভাবেই একাধিক সাড়ম্বরপূর্ণ প্রবল সংঘর্ষ সংঘটনকালে নেপচুনের আদি অকৃত্রিম চাঁদগুলো ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো। অবশ্য পরবর্তী সময়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত চাঁদের ধ্বংসাবশেষ থেকে কয়েকটি ছোটো সাইজের চাঁদের জন্ম হয় যারা এখনো নেপচুনের চারদিকে পরিক্রমণ করে যাচ্ছে।
ট্রাইটন সৌর মণ্ডলের অত্যন্ত হিমশীতল একটি এলাকা, তাপমাত্রা প্রায় মাইনাস ২৩৫ (-২৩৫) ডিগ্রী সেলসিয়াস। কিন্তু ভয়েজার ২ আবিস্কার করে যে, হিমশীতল ট্রাইটনে গেইজার রয়েছে – সেই গেইজারগুলো দমকে দমকে নাইট্রোজেন উৎক্ষেপ করছে। তাই ধারনা করা হচ্ছে যে ট্রাইটনের পৃষ্ঠদেশের নীচে জলের বিশাল মহাসাগর রয়েছে। ট্রাইটনের পাতলা বায়ুমণ্ডলও ভয়েজার ২ আবিস্কার করে, এবং পরবর্তীকালে পৃথিবী থেকেও কয়েকবার তা সনাক্ত করা হয়।
যাহোক, নিজের চাঁদগুলোর বিনিময়ে নেপচুন যে ট্রাইটনকে হরণ করে নিয়ে আসলো, তাকে নিয়ে নেপচুন শেষ পর্যন্ত কি করবে? বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস যে নেপচুনের অভিকর্ষ ট্রাইটনকেও একদিন ছিন্ন ভিন্ন করে গুঁড়িয়ে ধ্বংস করে দেবে। তার সেই ধ্বংসাবশেষ থেকে – শনির আংটিগুলোর চেয়েও বিশাল বিশাল সাইজের আংটি জন্ম নেবে। অবশ্য এই হিংস্র ঘটনাটি যে আমাদের জীবদ্দশায় ঘটতে যাচ্ছে, তা নয় কিšতু। হিসেব করে দেখা গেছে আগামি প্রায় সাড়ে তিন কি তিন দশমিক ছয় (৩.৫/৩.৬) বিলিয়ন বছরের মধ্যে ঘটবে।
নেপচুন ও ট্রাইটনের কক্ষপথের তুলনা দেখানো হয়েছে; সৌজন্যে : উইকিপিডিয়া
তিন জোভিয়ান গ্রহের মতো চতুর্থ ও সর্বশেষ জোভিয়ান গ্রহ নেপচুনেরও রিং বা আংটি রয়েছে। পাঁচটি প্রধান রিং ও চারটি ’রিং আর্ক’ বা বৃত্তাকারের অংশ দিয়ে সৃষ্ট আংটিমালার অধিকারি নেপচুন। আংটিগুলো সম্ভবত তুলনামূলকভাবে তরুণ ও ক্ষণজীবি। আংটিগুলো গ্রহের বায়ুমণ্ডলের খুব কাছাকাছি অবস্থান করছে, ফলে দানবতুল্য গ্যাসের ঝলমলে উজ্জ্বলতায় তারা এতোটাই নিষ্প্রভ হয়ে থাকে যে তাদেরকে দেখতে পাওয়া খুব কঠিণ। ১৯৮৯ সালের আগস্ট মাসে নেপচুনকে ফ্লাইবাই করার সময় ভয়েজার ২ কয়েকটি আংটির সুন্দর স্বচ্ছ ছবি তুলে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলো।
ভয়েজার ২-য়ের তোলা নেপচুনের আংটি; সৌজন্যে : নাসা/ভয়েজার টীম
তবে ২০২২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর জেমস ওয়েব নভোটেলিস্কোপ তার লালচে অবলোহিত দৃষ্টির সাহায্যে নেপচুনের বেশ কয়েকটি উজ্জ্বল, সরু আংটির ছবি তো তোলেই সেই সঙ্গে মহাজগতীয় ধূলো দিয়ে তৈরি তার কিছু মলিন ক্ষীণতর বন্ধনীর ছবিও তোলে।
জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের তোলা নেপচুনের আংটি; পাবলিক ডমেইন
বৈজ্ঞানিক অনুমাণ হলো যে প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন (৪.৫ বিলিয়ন) বছর পূর্বে প্রবল প্রচণ্ড প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের সৌর মণ্ডলের সৃষ্টি কর্ম সম্পন্ন হয়।
সৌর মণ্ডলের সদস্য হিসেবে দুই গ্যাস-দানব – বৃহস্পতি ও শনি এবং দুই হিম-দানব – ইউরেনাস ও নেপচুনও ছিলো। এবং তারা সূর্যের খুব কাছাকাছিই ছিলো।
কিšতু প্রায় চার বিলিয়ন বছর পূর্বে অভিকর্ষের প্রচণ্ড শক্তি চারটি দানব-গ্রহকে সূর্যের সান্নিধ্য থেকে তাড়িয়ে ঠেলে সৌর মণ্ডলের বাইরের দিকে চলে যেতে বাধ্য করে। বিশালত্ব অনুযায়ী গ্রহগুলো যার যার তার তার কক্ষপথে আসীন হয়। প্রত্যেকটি গ্রহকে ঘিরে রয়েছে আংটির বাহার।
সূর্য থেকে অনেক দূরে অবস্থানরত বৃহস্পতি ও শনি এবং ইউরেনাস ও নেপচুন দুই শ্রেণির গ্রহের প্রতিনিধিত্ব করছে; অর্থাৎ, তারা যথাক্রমে গ্যাস-দানব ও হিম-দানব।
এপর্যন্ত, আমাদের সৌর মণ্ডলের ’পিছনের উঠানে’ কয়েক হাজার ’বহির্গ্রহ’ (বীড়ঢ়ষধহবঃং)-য়ের সন্ধান আমরা পেয়েছি। সাইজে সেগুলো ইউরেনাস ও নেপচুনের অনুরূপ। বৃহস্পতি বা শনি’র সাইজের কোনো গ্রহের সন্ধান মেলেনি। তাই বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস যে আমরা যদি ইউরেনাস ও নেপচুন সম্বন্ধে জ্ঞান ও উপলব্ধি অর্জন করতে পারি তবে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যে কোনো প্রান্তে অবস্থিত বিকাশমাণ ’সৌর মণ্ডল’কেও সম্যক উপলব্ধি করতে পারব।
নাদিরা মজুমদার
অনন্যা ও বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত, সিনিয়র সাংবাদিক