শ্রী নিখিলনাথ রায়
তাঁহার জীবিতকাল হইতে বর্তমান সময় পর্যন্ত তাঁহার চরিত্রের উপর এক দিকে অসংখ্য কশাঘাত পড়িয়াছে, আবার অন্য দিকে সুস্নিগ্ধ প্রলেপে সে আঘাত দূর করিবার চেষ্টা করাও হইয়াছে। তাঁহার সময়ে যত ইতিহাস’ ‘বাঁ বিবরণ দেখিতে পাওয়া যায়, তাহার প্রায় সমস্তই তাঁহার শত্রুপক্ষের কল্পিত। কি মুসল্মান লেখক, কি ইংরেজ ঐতিহাসিক, সকলেই একবাক্যে তাঁহার দোষ কীর্তন করিয়া জগতের সমক্ষে বাঙ্গালী জাতিকে অত্যন্ত হেয় করিয়া তুলিয়াছেন।
কোন কোন ইংরেজ লেখক নন্দকুমারের সহিত সমগ্র বাঙ্গালী জাতির উপর এরূপ গালিবর্ষণ করিয়াছেন যে, তাহা শ্রবণ করিলে প্রায়শ্চিত্ত করার আবশ্যক হইয়া উঠে। আবার কেহ কেহ সেই নন্দকুমারকে “Great Rajah Nundcomar” বলিয়াছেন এবং তাঁহার প্রভুভক্তি ও স্বদেশের স্বত্বা- ধিকারের প্রতি অনুরাগই সমগ্র ব্রিটিশ জাতির গালিবর্ষণের কারণ বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন।মহারাজ নন্দকুমারের জীবনের প্রত্যেক কার্য্য সমালোচনা করিয়া প্রকৃত সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে হইলে, অনেক স্থান’ও সময়ের আবশ্যক।
বর্তমান প্রবন্ধে তাহার সম্পূর্ণ আলোচনা অসম্ভব। তবে আমরা এ কথা সাহস করিয়া বলিতে পারি যে, বাস্তবিকই মহারাজ নন্দকুমার তৎকালীন প্রবঞ্চক ইংরেজ কোম্পানীর হস্ত হইতে তাঁহার প্রভুর ও স্বদেশের স্বত্বরক্ষার জন্য আপনার জীবন বলি দিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। তাঁহার উদ্দেশ্য অতি মহৎ, ছিল; সে বিষয়ের কোন বিরুদ্ধ তর্ক আমাদের মনে স্থান পায় না। তবে তাঁহার সেই উদ্দেশ্য যে একেবারে স্বার্থণুক্ত ছিল, সে কথাও সাহস করিয়া বলিতে পারা যায় না। শিবাজী বা রাজসিংহের ন্যায় তাঁহার উদ্দেশ্য মহত্তর বা নিৰ্ম্মলতর না হইতে পারে, তথাপি সেরূপ উদ্দেশ্যেরও যে যথেষ্ট মূল্য আছে ইহাও অনায়াসে স্বীকার করিতে পারা যায়।
বিশেষতঃ অষ্টাদশ শতাব্দীর বঙ্গদেশে অন্যান্য বাঙ্গালীর ন্যায় বৈদেশিকের পদ- লেহন না করিয়া, তিনি যে স্বদেশের স্বত্বস্থাপনের চেষ্টা করিয়াছিলেন, ইহা অল্প প্রশংসার কথা নহে। জগতে নিঃস্বার্থ হিতৈষিতা অল্পই দেখিতে পাওয়া যায়। শিবাজী প্রভৃতি দেবচরিত্রেও তাহার অভাব লক্ষিত হয়। ফলতঃ মানবচরিত্র একেবারে স্ফটিক-নির্মূল হওয়া কঠিন।