ডাঃ মোঃ জাহিদুর রহমান
এক নীরব ঘাতক এর নাম উচ্চ রক্তচাপ বা হাই ব্লাড প্রেশার। দিনে দিনে এ ধরনের রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আজ আলোচনা করতে যাচ্ছি।
১) ৮০-৯০% উচ্চ রক্তচাপের রোগীর কোনো লক্ষণই থাকে না। এজন্য এটিকে সাইলেন্ট কিলার বলা হয়। সারা পৃথিবীতে কমবেশি ১.২ বিলিয়ন হাই প্রেশারের রোগী আছে। এরমধ্যে ৫০-৬০% জানে তাদের এই রোগটি আছে। বাকিরা জানেই না তাদের হাই প্রেশার। হাই প্রেশারকে মেডিকেল সায়েন্সের ভাষায় হাইপারটেনশান বলে।
২) বিশাল সংখ্যক মানুষ তাদের হাইপারটেনশানের ব্যাপারে জানতে পারে যখন ইতোমধ্যে এটি শরীরে বেশ কিছু বড়ো ক্ষতি করে ফেলেছে। যখন কিডনির সমস্যা দেখা দেয়, হার্টের সমস্যা দেখা দেয় কিংবা একটা স্ট্রোক হয়ে যায় তখনই ধরা পড়ে তার হাইপারটেনশান ছিল।
৩) প্রারম্ভিক পর্যায়ে হাইপারটেনশান নির্ণয় করতে–বিশের উপর বয়স হলে দুবছরে অন্তত একবার এবং ত্রিশের উপর বয়স হলে প্রতি বছরে অন্তত একবার ব্লাড প্রেশার পরিমাপ করা প্রয়োজন।
৪) ব্লাড প্রেশার যদি লাগাতার ১৪০/৯০ মিমি মার্কারি বা তার বেশি থাকে কিংবা শুধু সিস্টোলিক ১৪০ মিমি মার্কারি বা তার বেশি থাকে কিংবা শুধু ডায়াস্টোলিক ৯০ মিমি মার্কারি বা তার বেশি থাকে, সেটিকে হাইপারটেনশান হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। তবে আমেরিকাতে এখন বলছে ১৩০/৮০-এর বেশি হলেই সেটিকে হাইপারটেনশান হিসেবে ধরতে হবে।
৫) কারও কারও ক্ষেত্রে হাইপারটেনশানের কিছু লক্ষণ থাকতে পারে। যেমন : মাথাব্যথা, ঘাড়ে ব্যথা, ঝাপসা দৃষ্টি ও জোরে হাঁটলে বা একটু পরিশ্রমের কাজ করলে বুকে চাপ বা অস্বস্তি অনুভব করা। হাইপারটেনশান রোগীর হার্টকে অতিরিক্ত লোডের বিপরীতে পাম্প করে রক্ত সারা শরীরে পাঠাতে হচ্ছে, তাই এক্ষেত্রে বুকে চাপ বা অস্বস্তি অনুভূত হতে পারে। আগে সহজেই ৪ তলা সিঁড়ি বেয়ে উঠে পড়া যেতো, এখন উঠতে গেলে বেশ কষ্ট হয়ে যায়–অনির্ণীত বা অনিয়ন্ত্রিত হাইপারটেনশানের একটি বহিঃপ্রকাশ এটি হতে পারে। এমন লক্ষণ ইশকেমিক হার্ট ডিজিজেও থাকে।
৬) হাইপারটেনশানের চিকিৎসায় দক্ষ ও অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন চিকিৎসকগণ অনেকক্ষেত্রেই কম্বিনেশান ওষুধ (একাধিক ওষুধ) ব্যবহার করতে পছন্দ করেন। কম্বিনেশান ওষুধগুলোতে ব্যবহৃত ওষুধগুলো সাধারণত কম ডোজের হয়। ফলে একাধিক ওষুধের ভালো দিকের সুবিধা যেমন পাওয়া যাচ্ছে আবার সাইড ইফেক্টও কম হচ্ছে। আবার একাধিক ওষুধের সাইনারজিস্টিক একশানে ব্লাড প্রেশার নিয়ন্ত্রিত থাকার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।
৭) বিটা ব্লকার এখন আর মোটেও হাইপারটেনশান চিকিৎসার প্রথম সারিতে নেই। এর পেছনে অনেকগুলো কারণ আছে। কিন্তু রোগীর হাইপারটেনশানের সঙ্গে যদি হার্ট ডিজিজ থাকে তাহলে বিটা ব্লকার সোজা এক নাম্বার পছন্দে চলে আসবে। হার্ট যদি কাজ না করে ব্লাড প্রেশার কন্ট্রোল হলেই কী আর না হলেই কী! হাইপারটেনসিভ রোগীর যদি মাইগ্রেন থাকে সেক্ষেত্রে পছন্দের শীর্ষে আবারও বিট ব্লকার উঠে আসবে।
৮) এমন কিছু রোগী পাওয়া যায় যারা ব্রঙ্কিয়াল এজমা বা হাঁপানি রোগের চিকিৎসাও নিচ্ছে আবার একই সাথে বুক ধড়ফরের জন্য ইন্ডিভারও (প্রপ্রানলল) খাচ্ছে। এটি একটি ভয়াবহ কম্বিনেশন। প্রপ্রানলল জাতীয় নন-সিলেক্টিভ বিটা ব্লকার হাঁপানি বাড়িয়ে দিতে পারে। শুধু তা-ই নয়, এমনও হতে পারে বিটা ব্লকার খাবার পর রোগী বুকে চাপ চাপ অনুভব বা কিছুটা এজমার লক্ষণও নিয়ে আসতে পারে যার কোনোসময় এজমা ছিল না। ইতিহাস খুঁজতে গেলে হয়তো দেখা যাবে তার পরিবারের কারও এ ধরনের এজমার সমস্যা ছিল। অর্থাৎ তার জেনেটিক প্রপেনসিটি ছিল, বিটা ব্লকার দেওয়ার পর এজমাটিক টেন্ডেন্সি আনমাস্কিং হচ্ছে। শুধু এই বিটা ব্লকারটি পাল্টে অন্য একটি এন্টিহাইপারটেন্সিভ দিলে দেখা যাবে রোগীর এই সমস্যাটি চলে গেছে। বিটা ব্লকার ব্যবহারের আগে রোগীর এজমা বা সিওপিডি আছে কি-না এ ব্যাপারে অত্যন্ত নিশ্চিত হয়ে নেয়া উচিত।
৯) সিওপিডি বা এজমার জন্য রোগীরা ব্রঙ্কোডায়ালেটর, স্টেরয়েড, থিওফাইলিন গ্রুপের ওষুধ সাধারণত পেয়ে থাকে। এর সবগুলোই পটাশিয়াম লস করতে পারে। এছাড়া এরা সবাই হার্ট রেট বাড়িয়ে দিতে পারে। সিওপিডি রোগীদের প্রায় সকলেই ধূমপায়ী বা ধূমপানের সংস্পর্শে থাকে দীর্ঘদিন। এ কারণেও এদেরও হার্ট রেট বেশি থাকে। সুতরাং এ ধরনের রোগীদের ক্ষেত্রে এমন প্রেশারের ওষুধ নির্বাচন করা শ্রেয় যারা হার্ট রেট কমাতে পারে। এতে রোগী অনেকটাই স্বস্তি পাবে। নন-ডাইহাইড্রোপাইরিডিন ক্যালশিয়াম চ্যানেল ব্লকার যেমন : ডিলটিয়াজেম, ভেরাপামিল এক্ষেত্রে ভালো পছন্দ হতে পারে। তারা ব্লাড প্রেশারও কমাবে, হার্ট রেটও কমাবে।
এখন সাথে যদি হার্টের সমস্যা থাকে (Left ventricular dysfunction), তাহলে বিটা ব্লকার ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়বে। হার্ট ফেইলিওরে ক্যালশিয়াম চ্যানেল ব্লকার দেওয়া যাচ্ছে না। এসব ক্ষেত্রে কম ডোজে বিসোপ্রলল বা নেবিভলল উপযুক্ত ওষুধ হতে পারে। এসব ওষুধের ব্রঙ্কোস্পাজম করার সম্ভাবনা তুলনামূলক কম থাকে। এগুলো সিলেক্টিভ বিটা-ওয়ান ব্লকার। কার্ভিডেলল কিন্তু নন-সিলেক্টিভ বিটা ব্লকার। এতে ব্রঙ্কোস্পাজম হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
এজমা/সিওপিডি রোগীর তাহলে বিভিন্ন কারণে একই সাথে হাইপোক্সিয়া, ইশকেমিয়া ও পটাশিয়াম লস হতে পারে। এই তিন মিলে এরিদমিয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিতে পারে। ফলে কম ডোজে স্পাইরোনোল্যাকটোন বা এপলিরেনোন (মিনারেলোকর্টিকয়েড রিসেপ্টর এন্টাগনিস্ট) যোগ করে দেওয়া এক্ষেত্রে ভালো সিদ্ধান্ত হতে পারে। এরা ব্লাড প্রেশার কমাতে সাহায্য করবে, আবার পটাশিয়ামও রিটেইন করে, ফলে এরিদমিয়ার চান্স কমায়।
১০) হাইপারটেনশানের জন্য এখনও গ্রামেগঞ্জে এটেনোলোল (টেনোলক/টেনোরেন) জাতীয় ওষুধ অহরহ ব্যবহৃত হচ্ছে। এই ওষুধ হাইপারটেনশানের রোগীদের স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। কারণ কী? এটেনলল সেন্ট্রাল এওর্টিক প্রেশার কমাতে পারে না, এটি শুধু পেরিফেরাল প্রেশার কমায়। তবে নতুন যুগের বিটা ব্লকারগুলোর এ ধরনের সমস্যা নেই। স্ট্রোকের ঝুঁকিতে আছে কিংবা আগে স্ট্রোক বা ট্রানজিয়েন্ট ইশকেমিক এটাক হয়েছে এমন রোগীদের সেন্ট্রাল এওর্টিক প্রেশার কমায় যেসব ওষুধ, সেগুলো ব্যবহার করা উত্তম। যেমন : থায়াজাইড ডাইইউরেটিক্স, এ সি ই-ইনহিবিটর, এনজিওটেনসিন রিসিপ্টর ব্লকার এবং ক্যালশিয়াম চ্যানেল ব্লকার। এসব ক্ষেত্রে মার্কেটে এভেইলেবল ডাইইউরেটিক্স এবং এনজিওটেনসিন রিসেপ্টর ব্লকার একটি ভালো চয়েস হতে পারে। হাইড্রোক্লোরোথায়াজাইড এবং লোসারটান/ভালসারটান কম্বিনেশনটি বেশি ব্যবহৃত হয়। এ ধরনের রোগীদের যদি একই সাথে হার্ট ডিজিজও থেকে থাকে তবে বিটা ব্লকার দিতে হচ্ছে। সেক্ষেত্রে বিটা ব্লকারের সঙ্গে থায়াজাইড কম্বিনেশান দেওয়া যেতে পারে।
১১) হাইপারটেনশানের ওষুধ প্রতিদিনই খেতে হয়। এর কিছু ওষুধ বেশ ব্যয়বহুল, অনেকেরই সাধ্যে কুলায় না। এমন ওষুধ না দেওয়াই শ্রেয় যে ওষুধ রোগী ২/৩ সপ্তাহ কষ্টেসৃষ্টে খেয়ে কিনতে না পেরে খাওয়া বাদই দিয়ে দেয়। রোগীর বেশি ভালো করতে গিয়ে রোগীকে অর্থনৈতিকভাবে অক্ষম করে দেওয়া যাবে না। তার জন্য কম দামি ওষুধটি বাছাই করাই উপযুক্ত সিদ্ধান্ত।