মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান
শপাহলিক (Shopaholic) শব্দটির সঙ্গে আমরা খুব বেশি পরিচিত না হলেও এই শব্দটি যাদের জন্য তৈরি হয়েছে তারা অনেকেই আমাদের পরিচিত। প্রয়োজন এবং অপ্রয়োজনে যিনি সারাক্ষণ শপিং করতে ভালোবাসেন তাকে অ্যালকোহলিকের মতো শপাহলিক বা শপিংয়ে আসক্ত হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এই আসক্তি বর্তমানে অনেক বেশি ছড়িয়ে গিয়েছে। এক সময় শপিং মলে বা মার্কেটে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটানোতে বিষয়টি আর সীমাবদ্ধ নেই। এখন মোবাইল ফোনে একের পর এক ই-কমার্স সাইট সেই কাজটি অনেক সহজ করে দিয়েছে। ঘরের ভেতর বসেই এখন সারা দুনিয়ার শপিং মলে ঘুরে বেড়ানো সম্ভব হচ্ছে।
প্রয়োজনীয় কেনাকাটা জরুরি। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রয়োজন পরিণত হচ্ছে আসক্তিতে। যা শুধু অপচয় ডেকে আনছে। ক্রেতাদের আকর্ষণ করার জন্য ছাড়া হয় নানামুখী অফার। মানুষ আগের চেয়ে অনলাইনে বেশি কেনাকাটা করেন। ঈদেও অনলাইন শপগুলোতে বেড়েছে বিক্রি। আর ফেসবুক পেজগুলোতে কম খরচে ব্যবসা করা যায়। কী পাওয়া যায় না অনলাইন শপগুলোতে? সূচ থেকে শুরু করে শাড়ি, জামা, সানগ্লাস, ক্রোকারিজ, মোবাইলসহ সবকিছুই। অনলাইনে বিক্রি হওয়া ৭৩ শতাংশই হয় বিভিন্ন ফেসবুক পেজ থেকে।… প্রথম সারির কয়েকটি অনলাইন শপের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দারাজ ডটকম, আজকের ডিল, বাগডুম, পিকাবো, ক্লিকবিডি, রকমারি, চালডাল, অথবা, কায়মো, আমি কিনি, প্রিয় শপ, বিডি হাট, বিডি শপ ইত্যাদি। দারাজ-এর সাইটে মেয়েদের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সালোয়ার-কামিজ, শাড়ির বিপুল সমাহার। সালোয়ার-কামিজ ব্র্যান্ড অনুসারে ১৫৫ থেকে ৮০০০ টাকা ও শাড়ি ১৮০০ থেকে ৬০০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। এ ছাড়া বিকাশ পেমেন্ট, সিটি ব্যাংক, আমেরিকান এক্সপ্রেস কার্ডে ২০ শতাংশ ক্যাশব্যাকের অফার রয়েছে এসব সাইটে। ঢাকার ভেতরে ঈদের আগের দিন পর্যন্ত ডেলিভারির অফারও দিচ্ছে অনলাইন শপগুলো।
বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে বেশি ব্যবসা করছে যে ই-কমার্স সাইটটি সেটি হলো দারাজ ডট কম। ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত এই ই-কমার্স সাইটটি দক্ষিণ এশিয়ায় বেশ জনপ্রিয়। জার্মান ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানি রকেট ইন্টারনেটের অর্থায়নে প্রথমে পাকিস্তানে শুরু হলেও পরবর্তীতে বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলংকা এবং মায়ানমারে তাদের ব্যবসা শুরু করে। এই পাঁচটি দেশে ৪৬০ মিলিয়ন জনসংখ্যার শতকরা ৬০ ভাগেরই বয়স ৩৫-এর নিচে। যা তাদের মার্কেটের সবচেয়ে বড সম্ভাবনা হিসেবে দেখছে দারাজ। গত বছর ২০১৮ সালের মে মাসে দারাজকে কিনে নেয় চায়নিজ ই-কমার্স জায়ান্ট আলিবাবা। এর মাধ্যমে অলিবাবা বাংলাদেশে ব্যাপক ভাবে জায়গা করে নিয়েছে। পাশাপাশি অর্থ লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠান বিকাশ-এর শতকরা ২০ ভাগ মালিকানা আলিবাবা কিনে নেয়ায় বাংলাদেশে তাদের ভিত্তি অনেক শক্ত হয়ে গিয়েছে। এরই মধ্যে ই-কমার্স জায়ান্ট অ্যামাজন এবং মেগা চেইন শপ ওয়ালমার্ট বাংলাদেশে ব্যবসা করার প্রস্তুতি গুছিয়ে এনেছে। ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত ওয়ালমার্টের অফিস বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে বেশ কিছুদিন ধরে।
বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংক্রান্ত জাতিসংঘের সম্মেলন আঙ্কটাড প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয় বিশ্বব্যাপী ই-কমার্সের বিক্রি বেড়েছে ১৩ শতাংশ। সে হিসাবে বাংলাদেশে এর পরিমাণ তুলনা করলে তা দাঁড়ায় প্রায় দ্বিগুণে অর্থাৎ ২৫ শতাংশ। আঙ্কটাড আরো জানায়, বিদেশ থেকে পণ্য কেনার হার ই-কমার্স সাইটগুলোতে ক্রমেই বাড়ছে।
বাংলাদেশে ই-কমার্সের ক্রেতা দ্রুত বাড়ছে বলেই পৃথিবীর সব বড় কোম্পানিগুলো এখন বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে আসছে। যার ফলে এখন তারা ক্রেতাদের ওপর নজর দিচ্ছে। যেহেতু বাংলাদেশের মানুষ এখনো ক্যাশ বা নগদ টাকায় কেনাকাটা করতে পছন্দ করেন তাদেরকে ডিজিটাল মাধ্যমে বিশেষ করে ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড, অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ে বা মোবাইলে টাকা লেনদেনে অভ্যস্ত করানো হচ্ছে। যেন তারা কেনাকাটার বিষয়ে আরো বেশি ‘উদার’ হতে পারেন।
আমেরিকায় এক গবেষণায় জানা গিয়েছে, গড়ে একজন আমেরিকান তার জীবদ্দশায় কোনো পরিকল্পনা ছাড়া এবং অপ্রয়োজনে ৩ লাখ ২৪ হাজার ডলার বা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় দুই কোটি ৬০ লাখ টাকা ব্যয় করেন। এই অর্থে খাবারের আইটেম থেকে শুরু করে পোশাক, গৃহসামগ্রী আছে। কেনার সময় তাদের এগুলো প্রয়োজনীয় মনে হলেও আসলে তা অতিরিক্ত ও অপ্রয়োজনীয় হিসাবে বিবেচিত হয়। প্রতি সপ্তাহে গড়ে এমন তিনটি কেনাকাটা ধরে যা বছরে ১৫৬টি এবং সারা জীবনে নয় হাজার বার কেনাকাটা করার সমান। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান স্লিকডিলসের অর্থায়নে মার্কেট রিসার্চ প্রতিষ্ঠান ওয়ানপোল দুই হাজার আমেরিকানের ওপর জরিপ চালিয়ে এই তথ্য হাজির করে। আমেরিকানরা গড়ে ৪৫০ ডলার বা প্রায় ৪০ হাজার টাকা প্রতি মাসে অপচয় করেন। যা বছরে পাঁচ হাজার চারশ ডলার এবং গড়ে সারা জীবনে ৩ লাখ ২৪ হাজার ডলারের সমান।
এদের মধ্যে শতকরা ৭২ জন কোনো ডিপার্টমেন্ট স্টোর থেকে বের হওয়ার মুহূর্তে ক্যান্ডি কিনে থাকেন। যে অভ্যাস তারা এড়াতে পারেন না। শতকরা ৩২ জন কাছের রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার কেনেন কোনো প্রয়োজন ছাড়া। জরিপে দেখা গিয়েছে এই সব কেনাকাটা করার পর তাদের মনে আনন্দের পরিবর্তে বিষণœতা ও টেনশন ভর করে। অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটা সবচেয়ে বেশি তারা করেন ডিসেম্বর মাসে।
এই সব কেনাকেটায় ক্রেতা নিজেকেই বেশি ভালোবাসেন। শতকরা ৫৪ জন এই অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটা করেন শুধু নিজের জন্য। শতকরা ৬৪ জন কোনো কিছু কেনেন শুধু তাতে নানা অফার থাকে বলে। ইমেইলে দেয়া অফার শেষ হয়ে যাবে এই কারণে শতকরা ৪০ জন কেনাকাটা করেন। ওয়েবসাইট ব্রাউজ করতে গিয়ে কোনো কারণ ছাড়াই কেনাকাটা করেন শতকরা ২১ জন। এর বাইরে আরো একটা বড় অংশ অর্ডার দেয়ার পর তা বাতিল করেন ডেলিভারি চার্জ দিতে হবে সে কথা মনে পড়ায়। অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটায় সবচেয়ে বেশি শতকরা প্রায় ৭০ জন খাবার বা গ্রোসারি আইটেম কেনেন, শতকরা প্রায় ৫৩ জন পোশাক, শতকরা প্রায় ৩৩ জন কেনেন গৃহসামগ্রী, টেকআউট বা খাবার কিনে বাইরে যান শতকরা প্রায় ২৯ জন এবং জুতো কেনেন শতকরা প্রায় ২৮ জন।
অনেকে মনে করেন, কেনাকাটায় বুঝি নারীরা এগিয়ে। তবে আমেরিকায় আরেকটি জরিপ তাতে দ্বিমত পোষণ করছে। ব্লুমবার্গ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, বাজেট সেনস অ্যাপস ডট কম এক হাজার আমেরিকানের ওপর জরিপ চালিয়ে দেখা গিয়েছে নারীদের চেয়ে প্রতি সপ্তাহের শপিংয়ে পুরুষরা এগিয়ে আছেন। জরিপে দেখা যায়, পুরুষরা প্রতি সপ্তাহে গড়ে তিন ঘণ্টা দোকানে কাটান। যেখানে নারীরা কাটান আড়াই ঘণ্টা। নারীদের তুলনায় পুরুষরা দ্বিগুণ সময় অনলাইন শপিংয়ে ব্যয় করেন। কেনাকাটায় পুরুষরা প্রতি মাসে নারীদের চেয়ে গড়ে দশ ডলার বেশি ব্যয় করেন। নারী পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে শতকরা ৬২ জন জানান, তারা একা শপিং করতে ভালোবাসেন।
পণ্য আসক্তি ও ফলাফল
একজন পণ্য আসক্ত ব্যক্তিকে বর্তমান সময়ে ড্রাগ আসক্ত ব্যক্তির সঙ্গেই তুলনা করছেন মনোবিজ্ঞানীরা। কেননা এই ব্যক্তিরা কোনো কারণ ছাড়াই কেনাকাটা করেন এবং এতে কোনো বিরতি দেন না। এদের মনোভাব সম্পর্কে গবেষণাগুলোতে এভাবে বর্ণনা করা হচ্ছে:
১. মন খারাপ, রাগ বা বিরক্তি দূর করতে শপিং।
২. ঘরে বাইরে মানসিক অশান্তি তৈরি।
৩. ব্র্যান্ডের সামগ্রী না কিনলে নিজেকে ছোট মনে করা।
৪. অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটা করলেও অন্যের কাছে এর প্রয়োজন সম্পর্কে জোর গলায় ব্যাখ্যা দেয়া।
৫. ক্রেডিট কার্ড সঙ্গে না থাকলে নিজেকে অসহায় ভাবা।
৬. নগদ টাকার পরিবর্তে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করা।
৭. কেনাকাটার সময় এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হওয়া।
৮. বেপরোয়া ভাব চলে আসা।
৯. কেনার পর এক ধরনের লজ্জা, অস্বস্তি, অপরাধ বোধ কাজ করা।
১০. অনেক সামগ্রী কখনোই ব্যবহৃত হয় না।
১১. কী কিনলেন বা কতো খরচ করলেন সে সম্পর্কে অন্যকে মিথ্যা বলা।
১২. নিজের অর্থ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা না থাকা।
১৩. মাত্রাহীন সময় নষ্ট করা।
আমেরিকান বিশেষজ্ঞরা এই আসক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে কয়েকটি বিষয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন। এর মধ্যে আছে
১. ক্রেডিট কার্ড বাদ দেয়া।
২. শুধু নগদ টাকা বহন করা। ক্রেডিট কার্ডের চেয়ে নগদে মানুষ কম খরচ করে।
৩. উত্তেজনা দূর করা। যে সব জায়গায় গেলে খরচ হয়ে যায় সে সব জায়গায় না যাওয়া।
৪.ই-কমার্স সাইটে গিয়ে কেনাকাটা না করে প্রয়োজনীয় জিনিস নগদ টাকায় দোকান থেকে কেনা।
৫. কেনার আগেই তালিকা তৈরি করা। তালিকার বাইরে গিয়ে কিছু না কেনা।
৬. নিজের জীবনের বড় লক্ষ্যকে সামনে রাখা।
৭. টিভি বিজ্ঞাপন, সোশাল মিডিয়া থেকে যতোটা সম্ভব নিজেকে দূরে রাখা।
গবেষকরা কেনার সময় নিজেকে কিছু প্রশ্ন করার কথাও বলছেন। যেমন:
আমি কখন এগুলো ব্যবহার করবো?
এমন কি আমার আরো আছে?
কেনার পর কোথায় এটি রাখবো?
আমি কি নগদে কিনবো?
এটা কি ভালো না খারাপ?
না কিনে আমি কি অন্য কারো থেকে এনে অল্প সময়ের জন্য ব্যবহার করতে পারি?
কেনার জন্য আমি কি অরেকটু অপেক্ষা করতে পারি?
আমি কেন এটা কিনবো?
বিকল্প আছে কি না?
এটা কিনলে আমার সঙ্গী কী মন্তব্য করবে। সে কি খুশি হবে?
অপচয় নয়
‘আয় বুঝে ব্যয় কর’ ছোটবেলায় এ কথাটি শিখলেও তা বাস্তব জীবনে কম মানুষই ব্যবহার করেন। নানামুখী প্রলোভন আমাদেরকে অপচয়ের দিকে টেনে নিয়ে যায়। পবিত্র কোরআনে অপচয়কারীকে শয়তানের ভাইয়ের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। তাই নিজে সচেতন হওয়া ও পরিবারের সদস্যদের এই বিষয়ে সচেতন করা প্রয়োজন। পারিবারিক বাজেট করাটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। যদি হিসাব করে চলা যায় তবে অল্প টাকাতেও গোছানো জীবন কাটানো সম্ভব। তাই একজন মানুষের কী প্রয়োজন সেই বিবেচনা করা উচিত তার নিজের। কোনো টিভি বিজ্ঞাপন বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা পরিচিত জনের প্রলোভনে পড়ে কোনো কিছু কেনা উচিত নয়। কেননা অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটার পর যে সমস্যা বা আর্থিক সংকট দেখা দেবে সেটা টিভি বা সোশাল মিডিয়া কিংবা সেই ব্যক্তি পূরণ করতে আপনার পাশে এসে দাঁড়াবে না।
লেখক পরিচিতি: সাংবাদিক ও গবেষক