মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান
মধ্য অক্টোবরে জোছনার আলো ছড়িয়ে আছে এলাকা জুড়ে। টাঙ্গুয়ার হাওরের স্থির জলে প্রতিবিম্ব পড়ছে চাঁদের আলোর। এক অপার্থিব পরিবেশ তৈরি হয়েছে চারপাশে। বিশাল জলরাশির মাঝে ছোট একটি বোটে নিজেকে খুব ক্ষুদ্র মনে হতে পারে। কিন্তু বিশাল প্রকৃতির অংশ হিসেবে ভাবলে বিস্ময়কর এক আনন্দ এসে ঘিরে ধরে চারপাশ থেকে।
অফুরন্ত প্রাকৃতিক মিষ্টি বা মিঠাপানির উৎস এই দেশ। বাংলাদেশের কৃষির প্রধান নির্ভরতা নদীর মিঠাপানি। বিশ্বে প্রাকৃতিক মিঠাপানির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। তবে আয়তনের তুলনায় পরিমাণে এতো বড় প্রাকৃতিক মিঠাপানির উৎস বিশ্বে আর কোথাও নেই। বলা হয়ে থাকে আগামীতে যদি কোনো বিশ্বযুদ্ধ হয় তবে তা হবে এই প্রাকৃতিক মিঠাপানি নিয়ে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় হাওর হিসেবে পরিচিত হাকালুকি হলো এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম মিঠাপানির জলাভূমি। এর মোট আয়তন ১৮,১৫৫ হেক্টর। এর মধ্যে জলাধারের পরিমাণ ৪,৪০০ হেক্টর। মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা, কুলাউড়া এবং সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ এবং বিয়ানীবাজার জুড়ে এর অবস্থান।
বাংলাদেশের বিভিন্ন হাওর ও জলাধারকে কেন্দ্র করে শীতের সময় দেখা যায় লাখো পরিযায়ী পাখি। টাঙ্গুয়ার হাওরেই প্রায় ২০০ প্রজাতির পাখি আসে। হাকালুকি, টাঙ্গুয়ার হাওর বিশেষ করে এসব এলাকার রৌয়ার বিল, গজারিয়ার বিল, আলমের ডোয়ার, ফইল্লার বিল, রূপাড়ুই, কালাপানি, বাইয়াগজুয়া, কৈয়ারকোনা বিলে পাখিরা তাদের কলরবময় আশ্রয় গড়ে তোলে।
শ্রীমঙ্গলের শত হেক্টরের বাইক্কা বিল অন্তত ১৬০ জাতের পাখির আবাসে পরিণত হয়। এর পাশাপাশি রাজশাহীতে পদ্মার চর, চাপাইনবাবগঞ্জ মহানন্দা নদীর চর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাস, বরিশালের দুর্গাসাগর, সিরাজগঞ্জের হুরা, নীলফামারীর নীলসাগর, উপকূলীয় অঞ্চল সোনাদিয়া, নিঝুম দ্বীপসহ বিভিন্ন স্থানে পরিযায়ী পাখি অবস্থান নেয়। প্রকৃতির এক বিস্ময়কর সূত্র মেনে সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া, হিমালয়, চায়না, রাশিয়া, ভারতসহ বিভিন্ন এলাকার হাজার হাজার মাইল দূর থেকে এই সব পাখি বংশানুক্রমিক ভাবে এখানে উড়ে আসে। সাধারণত ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত তাদের অবস্থান হয় বাংলাদেশে। তবে গবেষকরা বলছেন, পাখিদের বাংলাদেশে অবস্থানের তুলনামূলক মেয়াদ বাড়ছে।
কোনো কোনো পাখি ছয় মাসেরও বেশি সময় থাকছে। ২০১৯ সালের পাখি শুমারিতে টাঙ্গুয়ার হাওরসহ নির্বাচিত পাঁচটি এলাকায় ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬৫টি পরিযায়ী পাখি গণনা করা হয়েছে।
২.
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের সাতটি জেলা কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মূলত হাওরগুলো অবস্থিত। ৪২৩টি হাওর ছড়িয়ে আছে এসব অঞ্চলে। সিলেট ও মৌলভীবাজারে অবস্থিত হাকালুকি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় হাওর। সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর আছে দ্বিতীয় অবস্থিত। হাওরগুলো যেমন মিঠা পানির বিশাল উৎস তেমনি অজ- প্রজাতির মাছের বিকাশস্থল এই এলাকা। হাওর কেন্দ্রিক অর্থনীতিতে মাছের পাশাপাশি গরু, মহিষ, হাঁস, মুরগি উৎপাদনও হয় এখানে। ভ্রমণের জন্য বৈচিত্রপূর্ণ হাওরের নাম টাঙ্গুয়ার হাওর। সুনামগঞ্জ জেলা কর্তৃপক্ষ তাদের ওয়েবসাইটে টাঙ্গুয়ার সম্পর্কে জানাচ্ছে, “টাঙ্গুয়ার হাওর বাংলাদেশের বৃহত্তম গ্রুপ জলমহালগুলোর অন্যতম। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা এবং তাহিরপুর উপজেলায় জীববৈচিত্রে সমৃদ্ধ মিঠা পানির এ হাওর বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার এলাকা। ভারতের মেঘালয়ের খাসিয়া, জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে সারি সারি হিজল-করচ শোভিত, পাখিদের।
কলকাকলি মুখরিত টাঙ্গুয়ার হাওর মাছ, পাখি এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর এক বিশাল অভয়াশ্রম। বর্তমানে মোট জলমহাল সংখ্যা ৫১টি এবং মোট আয়তন ৬,৯১২.২০ একর। তবে নলখাগড়া বন, হিজল করচ বনসহ বর্ষাকালে সমগ্র হাওরটির আয়তন দাঁড়ায় প্রায় ২০,০০০ একর। টাঙ্গুয়ার হাওর প্রকৃতির অর্পণ দানে সমৃদ্ধ। এ হাওর শুধু একটি জলমহাল বা মাছ প্রতিপালন, সংরক্ষণ ও আহরণেরই স্থান নয়। এটি একটি মাদার ফিশারী। হিজল করচের দৃষ্টিনন্দন সারি এ হাওরকে করেছে মোহনীয়। এ ছাড়াও নলখাগড়া, দুধিলতা, নীল শাপলা, পানিফল, শোলা, হেলঞ্চা, শতমূলি, শীতলপাটি, স্বর্ণলতা, বনতুলসী ইত্যাদি সহ দু’শ প্রজাতিরও বেশি গাছগাছালী রয়েছে এ প্রতিবেশ অঞ্চলে। জেলা প্রশাসনের কার্যকর ও টেকসই ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে বর্তমানে এ হাওরে রয়েছে ছোট বড় ১৪১ প্রজাতির ২০৮ প্রজাতির পাখি, এক প্রজাতির উভচর প্রাণী, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ৬ প্রজাতির কচ্ছপ, ৭ প্রজাতির গিরগিটি এবং ২১ প্রজাতির সাপ। নলখাগড়া বন বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুণ। শীত মৌসুমে অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙ্গে ব্যাপক পাখির আগমন ও অবস্থানে মুখরিত হয় টাঙ্গয়ার হাওর। বিলুপ্ত প্রায় প্যালাসেস ঈগল, বৃহদাকার গ্রে-কিংষ্টর্ক, শকুন এবং বিপুল সংখ্যক অতিথি পাখি ছিল টাঙ্গুয়ার হাওরের অবিস্মরণীয় দৃশ্য। স্থানীয় জাতের পাখি পানকৌড়ি, কালেম, বৈদর, ডাহুক নানা প্রকার বালিহাঁস, গাংচিল, বক, সারস প্রভৃতির সমাহারও বিস্ময়কর। সাধারণ হিসাবে বিগত শীত মৌসুমের প্রতিটিতে ২০/২৫ লক্ষ পাখি টাঙ্গুয়ার হাওরে ছিল বলে অনুমান করা হয়। কোনো কোনো স্থানে কয়েক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে শুধু পাখিদের ভেসে থাকতে দেখা যায়। টাঙ্গুয়ার হাওর মাছ-পাখি এবং উদ্ভিদের পরস্পর নির্ভরশীল এক অনন্য ইকোসিস্টেম। মাছের অভয়াশ্রম হিসাবে এর গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি।”
৩.
বাংলাদেশের জলাধার হিসেবে হাওরগুলো পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে হাওর ভিত্তিক পর্যটনের বিকাশ ঘটেছে। অনেকে পরিবার নিয়ে এখন হাওর ভ্রমণে আসছেন। কয়েক শ বোট এখন হাওরের পানিতে ভেসে বেড়ায়। তবে এই পর্যটন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থান এখনো গড়ে তুলতে পারে নি। হাওরের বিশাল জগতে যদি পরিকল্পিত ভাবে পর্যটনকে গড়ে তোলা যায়, সেখান থেকে অর্থ আয়ের পাশাপাশি পরিবেশ সম্পর্কে মানুষ ধারণা পাবে। হাওর আমাদের মাছের বড় উৎস। কোনো ভাবেই এর পথ বন্ধ করা যাবে না। কিশোরগঞ্জ এলাকায় হাওরের মাঝে পথ তৈরি করে পানির গতিপথে বাধা দেয়া হয়েছে। পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণের নামে পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি করা হয়েছে।
হাওরের মানুষ বছরের ছয় মাস বা কোথাও কোথাও তারও বেশি সময় পানির মধ্যে থাকেন। চারদিকে পানি, মাঝে হয়তো কিছুটা শুকনো জায়গা। সেখানেই অনেক মানুষের বাস। হাওর নিয়ে অনেক কর্মসূচি বা হাওর বোর্ড থাকলেও বাস্তবে হাওরের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে তা কতোটাকু ভূমিকা রাখছে সেটা বিবেচনা করা প্রয়োজন। হাওর এলাকায় কমপক্ষে দুই কোটি মানুষ থাকেন। তাদের শিক্ষা, কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে এলাকার বৈশিষ্ট্যকে প্রাধান্য দেয়া প্রয়োজন। হাওর নিয়ে সমন্বিত পরিকল্পনা প্রয়োজন।
8.
হাওর এলাকায় ভৈরব থেকে মোহনগঞ্জের কাছে সাচনা এলাকা পর্যন্ত একটি লঞ্চযাত্রা ছিল। অতি ছোট্ট এই লঞ্চটি ১৮ ঘণ্টা সময় নিয়ে পুরো এলাকা ঘুরে, গ্রামে গ্রামে থেমে গন্তব্যে পৌঁছাতো। হাওর এলাকার জনজীবন দেখার জন্য এই লঞ্চযাত্রা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পুরো ১৮ ঘণ্টা যাত্রা করেন হাতে গোনা কয়েকজন। ফলে লঞ্চের সারেং ও অন্যান্যদের সাথে একটা সম্পর্ক হয়ে যায়। জানা যায় অনেক ধরনের তথ্য। প্রায় ১২ বছর আগে এক পূর্ণিমার রাতে এই লঞ্চে চড়ার সুযোগ হয়েছিল এক বন্ধুসহ। অনেক মানুষ ও চারপাশ দেখে রাত পেরিয়ে দিন হলো, পরের সারাদিন চলার পর সন্ধ্যায় সাচনা পৌঁছালো লঞ্চ। সেই রাতে ফেরার কোনো উপায় নেই। পুরো গ্রামে কোনো হোটেল নেই। স্থানীয় গ্রামীণ ব্যাংকের ম্যানেজারের সাথে পরিচয় হলো। উদার মনে তিনি তার এক রুমের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। রাতের খাবারের ব্যবস্থাও করলেন। চমৎকার সময় কাটলো। আমাদের রেখে ম্যানেজার বাইরে চলে গেলেন।
মাঝ রাতে হঠাৎ দরজায় খট খট শব্দ। দরজা খুলে দেখা গেল ম্যানেজার আর তার সাথে আরো দু’জন লোক! কিছুটা অবাক হয়ে তাকাতেই ম্যানেজার বিনয়ের সাথে অনুরোধ করলেন তাদের সাথে যেতে। আমরা দু’জন গেলাম। একটি বড় ঘর। তার ভেতর লোক ভর্তি। এদের কেউ রিকশা চালান। কেউ মাছ ধরেন। কেউ বা নৌকার মাঝি। কিন্তু এখানে সবার পরিচয় তারা শিল্পী অথবা গানের -প্রোতা। হাওর অঞ্চলের অনেক গান বিখ্যাত হয়ে আছে। বিশেষ করে প্রয়াত লেখক হুমায়ূন আহমেদ তার নাটকে বারী সিদ্দিকী, কুদ্দুস বয়াতীকে দিয়ে অনেক গান করেছেন। ভাটি অঞ্চলে শাহ আবদুল করিম একজন কিংবদন্তী শিল্পীতে পরিণত হয়েছেন।
সেই ঘরে থাকা এই সাধারণ মানুষগুলো গানের আয়োজন করেছিলেন। সেটা আমাদের সম্মানে। সারা রাত তারা আমাদের গান শোনালেন। হাওরের বুকে ছড়িয়ে পড়ে গানের সুর। জীবনের খুব আনন্দময় একটি রাত উপহার দিয়েছিলেন হাওরের মানুষগুলো। যাদের সাথে আর কখনো দেখা হবে কি না জানি না!
লেখক পরিচিতি: সাংবাদিক ও গবেষক।