৫৪ বছর পরে যখন দেশ ও জাতি শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করছে তখনও বুকে হাত দিয়ে কেউ বলতে পারবে না, ১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার ফলে দেশে যে বুদ্ধিবৃত্তির সংকট হয় তা জাতি কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। বরং বাস্তবতা হচ্ছে যে উদ্দেশ্যে বুদ্ধিবীবিদের পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা হত্যা করেছিলো তাদের সে উদ্দেশ্য এখনও অবধি সফল।
যারা হত্যা করেছিলো তারা কেন এভাবে সফল হলো এবং ৫৪ বছরে দেশ ও জাতি কেন তা কাটিয়ে উঠতে পারলো না বরং আরো বেশি বুদ্ধিবৃত্তির সংকটে পড়ে গেলো -এ নিয়ে নিঃসন্দেহে গবেষণার দাবী রাখে। তবে পরিপূর্ণ গবেষণার আগেও একটা বিষয় নিশ্চিতভাবে বলা যায়, বাঙালির যে স্বাধিকার আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রাম বাইশ বছর ধরে গড়ে উঠেছিলো তার শুরুটা হয়েছিলো সংস্কৃতির ওপর পা রেখে। ভাষা আন্দোলনের তাত্ত্বিকগুরু ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ যে আন্দোলনের ভিত্তি রচনা করে দিয়েছিলেন, তা ছিলো সম্পূর্ণ রূপে সংস্কৃতির ওপর দাঁড়ানো। আর তারই ধারাবাহিকতায় যে স্বাধিকার ও স্বাধীনতার সংগ্রাম ধীরে ধীরে এগিয়ে একটি জাতি রাষ্ট্র তৈরি হয় স্বাভাবিকই সেটা মূলত সংস্কৃতির ওপর দাঁড়িয়ে হয়েছিলো।
কিন্তু স্বাধীনতার পর পরই নতুন রাষ্ট্র ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকে তার সংস্কৃতির ওপর দাঁড় করানো হয়নি। বাস্তবে সংস্কৃতি’র সীমা অনেক ব্যপক। এবং সে ব্যপকতাকে ধারণ করা ও বিকশিত করার মতো যে বুদ্ধিজীবি শ্রেণী ছিলেন তাদের একটি বড় অংশকে হত্যা করা হয়। বাকী যারা ওই অংশ ধারণ করতেন- তাদেরকে রাষ্ট্র ও জাতি বির্নিমানে কখনই কাজে লাগানো হয়নি। আবার অনেকে নিজের চিন্তা চেতনার পরিবর্তন করে ফেলেন। সব মিলে সংস্কৃতি বিকাশ সংকটে পড়ে। আর কোন জাতির সংস্কতির বিকাশ সংকটে পড়লে ওই জাতি বা ওই নরগোষ্টি’র শিক্ষাসহ যাবতীয় বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয় যা সংস্কৃতি বিকাশের মূল স্তম্ভ হিসেবে কাজ করে তার সবই সংকুচিত হতে থাকে। আর শুদ্ধ বায়ু সংস্কুচিত হলে দুষিত বায়ু স্বাভাবিকই সেই স্থান দখল করে। তখন বিদ্যা ও অবিদ্যা’র পার্থক চেনার দৃষ্টি শক্তি সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে কমে যায়।
কোন রাষ্ট্রে শুদ্ধ বায়ু কমে গেলে তখন মুক্ত চিন্তা সবখানেই কমে যায়। রাষ্ট্রের চরিত্র আর মুক্ত বা অবাধ থাকে না। বরং কঠোর হয়ে ওঠে। রাষ্ট্র যত কঠোর হয় ততই ওই রাষ্ট্রে বুদ্ধিবৃত্তির সংকট শুরু হয়। অর্থাৎ উদার চিন্তা ও সহস্র চিন্তার সন্নিবেশ সেখানে পাশাপাশি ঘটে না।
শহীদ বুদ্ধিজীবি দিবসে আমরা শহীদদের স্মরণ করি, বুদ্ধিজীবিদের স্মরণ করি। কিন্তু স্মরণ যেমন শ্রদ্ধার সঙ্গে করতে হয় তেমনি তার থেকেও বেশি শ্রদ্ধার সঙ্গে তাদের চিন্তা ও চেতনাকে চর্চা করতে হয়। যা সত্যি অর্থে ৫৪ বছরেও শুরু হয়নি।
পৃথিবীর কোন আত্মত্যাগ কখনই বৃথা যায় না। ব্যক্তি জীবনে, সরকারের সময় সীমা রেখার মাপে- ৫৪ বছর অনেক দীর্ঘ সময়। তবে জাতির জীবনে ৫৪ বছর কখনই দীর্ঘ সময় নয়। এ দেশের মাটি খুড়লে বা যে কোন ফসলের কাছে গেলেই বোঝা যায়- এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাজার হাজার বছর। তাই এখানে সাময়িক কোন বিষয় নিয়ে হতাশার কিছু থাকে না। কোন এক প্রজম্মে ঠিকই মরুভূমি মরুদ্যান হয়ে ওঠে। হয়তো তাতে কয়েক শত বছর কেঁটে যায়। কিন্তু একটি জাতির জীবনের জন্যে তা খুবই কম সময়।