সন্ন্যাসী ঠাকুর
আর একবার একটি অল্পবয়স্ক যুবককে পোড়াইতে আনা হইয়াছিল। তাহার যুবতী বধূর সে কি কান্না। শুনিলাম যুবকটির আর কোনো ভাই নাই। মাত্র ছয় মাস আগে বিবাহ হইয়াছিল। বিধবা হইয়া মেয়েটি কার কাছে আশ্রয় পাইবে? এই মেয়েটির কান্না দেখিয়া সন্ন্যাসী ঠাকুর ঘন ঘন চোখ মুছিতে লাগিলেন। স্বামীকে যখন চিতায় তুলিয়া দেওয়া হইল তখন মেয়েটি বারবার সেই চিতার আগুনে ঝাঁপাইয়া পড়িতে চেষ্টা করিতেছিল। দুই-তিন জন লোক তাহাকে জোর করিয়া ধরিয়া রাখিতে পারিতেছিল না।
স্বামীর চিতার আগুন নিবিলে আত্মীয়স্বজনেরা যখন তাহার হাত হইতে শঙ্খ ভাঙিয়া ফেলিল, কপাল হইতে সিঁদুর মুছিয়া ফেলিল তখন মেয়েটির কি কান্না। সেই কান্নায় আকাশ-বাতাস বিদীর্ণ হইতেছিল। কতকালের ঘটনা। আজও যেন সেই পতি-বিয়োগ-বিধুরা বউটিকে আমি চোখে দেখিতেছি।
আরও একদিন একটি বর্ষিয়সী হিন্দু মেয়েকে দাহন করিতে আনা হইল। আমারই বায়সের দুইটি ছেলে আসিয়াছে মায়ের মুখাগ্নি করিতে। তারা ভালোমতো বুঝিতেও পারে না, মাকে হারানো যে কি জিনিস। চিতা নিবিলে সেখানে পানি ঢালিয়া পরিষ্কার করা হইল। তারপর হারানো যে লোক ছেলেদের হাতে পাঁচটি কড়ি দিয়া তাহাদিগকে বলিতে বলিল, “মা এই পাঁচ কড়ার কড়ি দিলাম। ইহা দিয়া যাহা হয় কিনিয়া খাইও। আর বাড়ি ফিরিয়া যাইও না। তাহাই বলিয়া ছেলে দুইটি চলিয়া গেল। আর পিছনে ফিরিয়া চাহিল না। আমার বড়ই কষ্ট লাগিল। সত্যসত্যই যদি মা আবার অশরীরী-জীবন পাইয়া ছেলেদের দেখিতে যান তাকে কি এমন করিয়া বারণ করিয়া দিতে হয়।
* খামানে কতরকমের মড়াই না আসিত। বড়লোকদের কেহ মরিলে সঙ্গে কীর্তনের দল গান গাহিতে গাহিতে আসিত। সেই গানের সুরে আকাশ-বাতাস কাঁদিয়া উঠিত। একটি গানের পদ এখনও আমার মনে আছে, “ও তোর মোহন বাঁশি ধুলায় পড়ে রইল।” বিলম্বিত লয়ের এই গানটির সুর সমস্ত শাশান-প্রকৃতিকে ব্যথিত করিয়া তুলিত। কতদিন গভীর রাত্রে ঘুম ভাঙিয়া শ্মশান-যাত্রীদের মুখে কীর্তনের সুর শুনিয়া বুকের কোনখানটি যেন কেমন করিয়া উঠিত। এই শ্মশানঘাট তাই আমার কাছে একমাত্র ভয়েরই প্রতীক হইয়া রহিল না, মৃতদের করুণ কাহিনীর সহিত কীর্তনের বিলম্বিত সুর আমার বালকমনে বড়ই গভীর করিয়া দাগ কাটিয়া গেল।
সেদিন শ্মশানে যাইতে সন্ন্যাসী ঠাকুর বলিলেন, “আমি আগামী রবিবারে এখান হইতে চলিয়া যাইব।” অমনি আমার দুই চোখ বাহিয়া ফোঁটায় ফোঁটায় পানি গড়াইয়া পড়িতে লাগিল। তিনি আমাকে কাছে ডাকিয়া অনেক সান্ত্বনা দিলেন। আমি বলিলাম, “আপনি কোথায় যাইবেন?”
“সন্ন্যাসীর তা বলিতে নাই। হয়তো আবার হিমালয়ের পথে রওয়ানা হইব।” তিনি উত্তর করিলেন।
এই হিমালয়ের পথে তাঁর সঙ্গী হইবার জন্য কতদিন হইতে কতভাবে আমি কৃষ্ণসাধনা করিয়া আসিতেছি। মাছ, মাংস ছাড়িয়াছি-পেঁয়াজ, রসুন ছাড়িয়াছি। শীতকালে কোঁচার খোঁট গায়ে দিয়া সারারাত কাটাইয়াছি। বালিশহীন বিছানায় সামান্য মাদুর পাতিয়া ঘুমাইয়াছি। আজ সন্নাসী ঠাকুর কিনা আমাকে ফেলিয়া একাই হিমালয়ের পথে রওয়ানা হইবেন। আমি অনুনয় করিয়া তাঁহাকে বলিলাম, “আমি আপনার সঙ্গে যাইব। আপনি যদি আমাকে ফেলিয়া যান আমি আর প্রাণে বাঁচিব না। জানেন তো বাড়িতে আমার বড় ভাই আমার উপর অকথ্য অত্যাচার করে। আমি একমাত্র শান্তি পাই আপনার এখানে আসিলে। সেই আপনি যদি চলিয়া যাইবেন, আমি কেমন করিয়া জীবন ধারণ করিব?” এই বলিয়া আমি কাঁদিয়া ফেলিলাম। তিনিও চোখের পানি মুছিলেন। তারপর তিনি কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া বলিলেন, “আচ্ছা। তুমি আমার সঙ্গে যাইও। পথে কিন্তু অনেক কষ্ট। তোমাকে আমি সাপের বাঘের পথে লইয়া যাইতেছি। অল্প আহার, অনাহারের পথে লইয়া যাইতেছি। একথা মনে থাকে যেন।”
চলবে…