দেবি শাস্ত্রি
ভ্যালেন্টাইন’স ডে মূলত প্রেমিক-প্রেমিকাদের জন্যই উদযাপিত হয়—কিন্তু রোমান্টিক সঙ্গী না থাকলেও এই দিনটি উদযাপন করা যেতে পারে।
এই দিনটি সুযোগ করে দেয় ভাবতে যে, জীবনে পরিবার, বন্ধু, পোষ্য, প্রতিবেশী কিংবা সম্প্রদায়ের কাছ থেকে পাওয়া ভালোবাসার কতই না বৈচিত্র্য ও সুফল রয়েছে।
তিনজন বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন কীভাবে আমাদের চারপাশের সব ধরনের ভালোবাসা লালন করা যায়, বিশেষত এমন সময়ে যখন একাকীত্বকে “মহামারী” বলা হচ্ছে, রাজনীতি মানুষকে বিভক্ত করে রাখছে, আর বাস্তব জীবনের সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার বদলে প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে যাওয়া অনেক সহজ হয়ে উঠছে।
আপনার জীবনে কেবল “একজন” ভালোবাসার মানুষই যথেষ্ট নয়
রোমান্টিক ভালোবাসা—অন্য একজন মানুষ বা একাধিক মানুষের সঙ্গে গভীর ও ঘনিষ্ঠ সঙ্গ—জীবনের একটি মূল্যবান দিক। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, আমাদের জীবনে সংযোগের একাধিক উৎস থাকা দরকার।
“বিশেষ করে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা বুঝতে পারি, একটা মাত্র সম্পর্ক সবকিছু দিতে পারে না,” বলছিলেন মিকাইলা ফ্রিসেল, ইউটি হেলথ অস্টিনের একজন সোশ্যাল ওয়ার্কার।
ভালোবাসা এমন কিছু নয়, যা সহজে একক সংজ্ঞা বা একটি কাজের মাধ্যমে বোঝা যায়।
‘ক্রিয়া’ হিসেবে ভালোবাসার মধ্যে দুটি দিক কাজ করে বলে মনে করেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যান ফ্লারিশিং প্রোগ্রামের পরিচালক ও মহামারী-বিশেষজ্ঞ টাইলার ভ্যান্ডারউইল। এটি হতে পারে “যুক্তিমূলক” — অর্থাৎ যাকে বা যেটিকে আপনি ভালোবাসেন, তার কাছে থাকতে চান, তাকে আকাঙ্ক্ষা করেন; আবার হতে পারে “অবদানমূলক”— মানে আপনি আপনার প্রিয়জনের মঙ্গলে অবদান রাখতে চান। এটি একসঙ্গে দুটি দিকই ধারণ করতে পারে বা যেকোনো একটিও থাকতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, ভালোবাসার সংজ্ঞা বিস্তৃত হলে এবং তার বহুমাত্রিক রূপকে স্বীকার করলে আমাদের “যুক্তিমূলক” ও “অবদানমূলক” অনুভূতি কাদের প্রতি প্রত্যক্ষ হতে পারে, তার পরিসরও বড় হয়ে যায়।
ভালোবাসা, একাকীত্ব ও স্বাস্থ্যের মধ্যে সংযোগ
২০২৩ সালে, তৎকালীন মার্কিন সার্জন জেনারেল বিবেক মার্থি একাকীত্বকে একটি জনস্বাস্থ্য মহামারী হিসেবে ঘোষণা করেন।
তার প্রতিবেদনে বলা হয়, অর্ধেক আমেরিকান কখনো না কখনো একাকীত্বের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন এবং এটি এমনই ক্ষতিকর যে দিনে ১৫টি সিগারেট খাওয়ার মতো স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে। আরও উঠে আসে, যাদের সামাজিক সম্পর্ক দুর্বল তাদের স্ট্রোক ও হৃদরোগের ঝুঁকি বেশি, এবং বিচ্ছিন্নতা মানুষের মধ্যে বিষণ্নতা, উদ্বেগ ও ডিমেনশিয়ার আশঙ্কা বাড়ায়।
ফ্রিসেল বলছেন, ভালোবাসার শক্তিশালী সামাজিক সংযোগ, বন্ধন ও সহায়তা আমাদের মস্তিষ্ককে সংকেত দেয় যে আমরা নিরাপদে আছি, ফলে স্নায়ুতন্ত্র “লড়াই বা পালাও” অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে পারে। গবেষণা বলছে, প্রিয়জনের সঙ্গে থাকলে রক্তচাপ কমে, স্ট্রেস হরমোন কমে, দেহের প্রদাহ হ্রাস পায়—এমনকি ঘুমের উন্নতি হয় এবং ব্যথা নিয়ন্ত্রণেও সহায়ক হয়।
দীর্ঘমেয়াদি হার্ভার্ড স্টাডি অব অ্যাডাল্ট ডেভেলপমেন্ট, যা “দ্য গুড লাইফ” বইটির মূল ভিত্তি, আজীবন সম্পর্কের গুরুত্বকে তুলে ধরেছে।
নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির দ্য ফ্যামিলি ইনস্টিটিউটের প্রধান একাডেমিক কর্মকর্তা ও মনোবিজ্ঞানী অ্যান্থনি চেম্বার্স জানান, ওই গবেষণায় দেখা গেছে যাদের সম্পর্ক ৫০ বছর বয়সে সবচেয়ে সুখকর ছিল, তাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য ৮০ বছর বয়সে সবচেয়ে ভালো ছিল।
“ফলাফল? অর্থবহ ও সন্তোষজনক সম্পর্ক গড়ে তোলা আমাদের স্বাস্থ্য ও মঙ্গল নিশ্চিত করার মূল চাবিকাঠি,” বলছিলেন চেম্বার্স, যিনি তার ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে ওই গবেষণায় কাজ করেছেন।
কীভাবে ভালোবাসা লালন করা যায়?
সহজভাবে বললে, সচেতনভাবে সরাসরি মুখোমুখি যোগাযোগের পথ খুঁজুন, বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
পরিকল্পনাটি বাস্তবে সহজ নয়। ব্যস্ত বন্ধুকে নিয়ে ডিনারের দিনক্ষণ ঠিক করতে কিংবা খুব বেশি কথা না থাকা ভাই-বোনকে ফোন করতে গেলে অস্বস্তি হতেই পারে। এমনকি আগে পরিচয় না থাকা প্রতিবেশী বয়স্ক মানুষটির সঙ্গে কথা বলা বা নতুন কোনও সফটবল দলে যোগ দেওয়াও প্রথমে অস্বস্তির বিষয় হয়ে উঠতে পারে।
ফ্রিসেল পরামর্শ দেন, এই সব মুহূর্তে আমাদের মনে যে সংশয় বা ভয় কাজ করে, সেগুলোকে স্বীকার করে সেগুলো নিয়ে ভাবতে হবে। কেন খুঁজতে দ্বিধা হচ্ছে, সেটা বোঝার চেষ্টা করতে হবে।
অন্যদের ভালোর জন্য কিছু করা—যদিও তাদের খুব ভালোভাবে না চিনে থাকি—এটিও ভালোবাসাকে লালন করার একটি উপায়। ফ্রিসেল প্রতিদিন কাউকে অন্তত একবার প্রশংসা করার এবং যখন কেউ প্রশংসা করে, সেটা বিনয়ীভাবে গ্রহণ করার অনুশীলন করার চ্যালেঞ্জ দেন। তিনি বলেন, ভালোবাসা দেওয়া ও পাওয়া—দুটোর উপকারিতাই সমান।
ভ্যান্ডারউইল এমন একটি অনুশীলনের কথা বলেন, যা তিনি নিজে করেন: ছয় সপ্তাহের জন্য, সপ্তাহে একটা দিন বেছে নিন এবং সেদিন পাঁচটি সদয় কাজ করুন। এটি আপনাকে পরিকল্পিতভাবে ও সচেতনভাবে দয়া বা সদয় আচরণের অগ্রাধিকার দিতে শেখাবে, যেভাবে অন্য কোনো দৈনন্দিন কাজে মনোযোগ দেন।
ভালোবাসা গড়ে তোলে স্থিতিস্থাপকতা
এই ভ্যালেন্টাইন’স ডে-তে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক-একজন মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের গণ্ডি পেরিয়ে আপনার সম্প্রদায় ও বিশ্বের প্রতি যে দায়বদ্ধতা, সেটার কথাও ভাবুন। কোনও লক্ষ্য বা গোষ্ঠীর প্রতি আপনার প্রতিশ্রুতি মনের স্থিতিস্থাপকতা তৈরি করে।
“আমরা সবাই চাই কেউ আমাদের বুঝুক এবং সমর্থন করুক, বিশেষ করে কঠিন সময়ে। আর সম্পর্কই সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা, যেখানে আমরা আবেগগত নিরাময় পেতে পারি,” বলছিলেন চেম্বার্স। “যখন চারপাশের দুনিয়া বিশৃঙ্খল মনে হয় অথবা আমরা একাকী বোধ করি, সম্পর্কই আমাদেরকে স্বীকৃতি ও সমর্থন দেওয়ার সুযোগ করে দেয়।”
ভ্যান্ডারউইল আরও বলছেন, এমনকি “শত্রুর প্রতিও ভালোবাসা” থাকা গুরুত্বপূর্ণ— যাদের সঙ্গে আমাদের মতের অমিল বা বিরোধ রয়েছে, তাদের দিকেও।
“আমরা অন্যদের প্রতি কীরকম ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা দেখাই, প্রতিবেশীদের প্রতি কীরকম আচরণ করি, সেটাই আমাদের সমাজের চালচিত্র নির্ধারণ করে,” তিনি বলেন।