০২:১৯ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৯ জুন ২০২৫
ডেমোক্র্যাটদের নীতির ব্যর্থতা যেভাবে মামদানিকে জয়ী করল মার্কো রুবিওর উপস্থিতিতে ডিআরসি-রুয়ান্ডা শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর কংগ্রেসের বহু নেতা ইন্দিরা জি ও জেপি-র সংলাপ চেয়েছিলেন, তবে তাঁর ঘনিষ্ঠ মহল তা হতে দেয়নি হিউএনচাঙ (পর্ব-১৩২) ট্রাম্পের বিপরীতে, প্রাচীন চীন এর শিক্ষার্থীদের স্বাগত জানানোর ঐতিহ্য রণক্ষেত্রে (পর্ব-৭৭) সমুদ্রের ওপার থেকে নতুন স্বপ্ন: তাইওয়ান তরুণদের ফুচিয়ানে নতুন জীবনগাঁথা ব্যর্থ কলম্বো, গলের লড়াই -এ বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কার ঘরে জয় কেন ? ‘আকাশ হয়ে যাই’ মিউজিক ভিডিতে প্রশংসিত পূর্ণিমা বৃষ্টি সাউথ চায়নান মর্নিং পোস্টের প্রতিবেদন: ইরান আক্রমনে লাভ ক্ষতি

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৩৩)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:২২ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  • 16

ধীরেনদের বাসায়

এই ভদ্রমহিলা ছিলেন কলিকাতার মেয়ে। তাঁর দেশে হয়তো মুচি মোছলমান কথাটি একসঙ্গে ব্যবহৃত হইত। সেই অভ্যাসমতোই তিনি উহা বলিতেন। প্রথা হিসাবে ছোঁয়াছুঁয়ির কঠোরতা তিনি মানিতেন সত্য কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে তিনি মুসলমানদের ঘৃণা করিতেন না। তাঁহার স্বাভাবিক স্নেহপ্রবণ মাতৃ-হৃদয় এত ছোঁয়াছুঁয়ি সত্ত্বেও আমার মতো আরও কয়েকটি মুসলমান ছেলেকে আপন করিয়া লইয়াছিল। আজকাল ছোঁয়াছুঁয়ি মানে না এরূপ বহু হিন্দুর মধ্যে যে কঠোর সাম্প্রদায়িকতা দেখা যায় তখনকার দিনে এই ছুতমার্গগ্রস্ত হিন্দুদের মধ্যে তাহা ছিল না। বাহিরের এই নানারকমের প্রথা ও নিষেধের বেড়া ভাঙিয়া মাঝে মাঝে কাহারও কাহারও স্নেহ-মমতা শত ধারায় অপরের প্রতি প্রবাহিত হইত। আমার এই মাটি তাঁহাদেরই একজন ছিলেন।

কেন জানি না, সেদিন আমি প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলাম, নিজের সেবাযত্ন দিয়া এই মহিলাটিকে শুধু আমি ছুতমার্গ হইতে মুক্ত করিব না, একদিন তিনি আমার হাতে খাদ্য পর্যন্ত গ্রহণ করিবেন।

সেই সুযোগ পাইতে বেশি দিন দেরি হইল না। একবার মায়ের খুব জ্বর হইল। যে-ঘরে মা থাকিতেন সে-ঘরে আমার যাওয়া নিষেধ ছিল। আমি দরজার সামনে বসিয়া মায়ের কাতরানি শুনিতাম।

তিনি ঘরের মেঝেয় শয়ন করিতেন। উপরে পালঙ্কের উপর তাঁর স্বামী শ্রীশবাবু থাকিতেন। তিনি মোটেই ছুতমার্গ মানিতেন না। একদিন তিনি আমাকে দরজার সামনে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া বলিলেন, “সাধু! তুমি ভিতরে আস। দরজার কাছে বসিয়া আছো কেন?” সেদিন হইতে আমি ভিতরে যাইবার হুকুম পাইলাম। আমি মায়ের পাশে বসিয়া একখানা হাত-পাখা লইয়া মাকে বাতাস করিতে লাগিলাম।

এ-বাড়িতে অসুখে-বিসুখে কেহ কাহাকে বড় একটা দেখাশুনা করিত না। তাঁহার এই অসুখে ছেলেমেয়েরা কেহই মায়ের কাছে আসিয়া সেবা-শুশ্রূষা করিল না। জ্বরের ঘোরে মা আমাকে দেখিতে পাইয়া বড়ই খুশি হইলেন। আমাকে বলিলেন, “সাধু! তুমি আসিয়াছ। আমার মাথাটা ভীষণ ধরিয়াছে। তুমি একটু টিপিয়া দাও।” আমি মায়ের মাথাটা আস্তে আস্তে টিপিয়া দিতে লাগিলাম। ইতিপূর্বে সেবা-সমিতির বন্ধুদের সঙ্গে আরও বহু রোগীর সেবা করিয়া সেবার হাত আমার বেশ পাকা হইয়া উঠিয়াছিল। দক্ষ হাতে মাথা টিপিয়া অল্প সময়ের মধ্যেই মায়ের মাথাব্যথা সারাইয়া দিলাম।

রাত্রে মায়ের বিছানার পাশে বসিয়া আছি। দারুণ জ্বরের ঘোরে মা কাঁপিতেছেন। আর ঘন ঘন পিপাসা হইতেছে। এতদিন তিনি উঠিয়া কলসি হইতে পানি গড়াইয়া লইতে পারিতেন। আজ আর পারিতেছেন না। মা আমাকে বলিলেন, “বাবা সাধু! তুই আমার পরজনমের ছেলে ছিলি। অথবা আমিই তোর মেয়ে ছিলাম। তোর হাতে জল খাইলে আমার জাতি যাইবে না। তুই কলসি হইতে জল ঢালিয়া আমার মুখে দে।” আমি নিকটের কলসি হইতে পানি ঢালিয়া মায়ের মুখে দিলাম। টেম্পারেচর লইয়া দেখিলাম, জ্বর ১০৫-এ উঠিয়াছে। বালতি ভরিয়া পানি আনিয়া মায়ের মাথা ধোয়াইয়া দিলাম। তারপর নেকড়া ভিজাইয়া মাথায় জলপট্টি দিতে লাগিলাম।

চলবে…

ডেমোক্র্যাটদের নীতির ব্যর্থতা যেভাবে মামদানিকে জয়ী করল

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৩৩)

১১:০০:২২ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

ধীরেনদের বাসায়

এই ভদ্রমহিলা ছিলেন কলিকাতার মেয়ে। তাঁর দেশে হয়তো মুচি মোছলমান কথাটি একসঙ্গে ব্যবহৃত হইত। সেই অভ্যাসমতোই তিনি উহা বলিতেন। প্রথা হিসাবে ছোঁয়াছুঁয়ির কঠোরতা তিনি মানিতেন সত্য কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে তিনি মুসলমানদের ঘৃণা করিতেন না। তাঁহার স্বাভাবিক স্নেহপ্রবণ মাতৃ-হৃদয় এত ছোঁয়াছুঁয়ি সত্ত্বেও আমার মতো আরও কয়েকটি মুসলমান ছেলেকে আপন করিয়া লইয়াছিল। আজকাল ছোঁয়াছুঁয়ি মানে না এরূপ বহু হিন্দুর মধ্যে যে কঠোর সাম্প্রদায়িকতা দেখা যায় তখনকার দিনে এই ছুতমার্গগ্রস্ত হিন্দুদের মধ্যে তাহা ছিল না। বাহিরের এই নানারকমের প্রথা ও নিষেধের বেড়া ভাঙিয়া মাঝে মাঝে কাহারও কাহারও স্নেহ-মমতা শত ধারায় অপরের প্রতি প্রবাহিত হইত। আমার এই মাটি তাঁহাদেরই একজন ছিলেন।

কেন জানি না, সেদিন আমি প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলাম, নিজের সেবাযত্ন দিয়া এই মহিলাটিকে শুধু আমি ছুতমার্গ হইতে মুক্ত করিব না, একদিন তিনি আমার হাতে খাদ্য পর্যন্ত গ্রহণ করিবেন।

সেই সুযোগ পাইতে বেশি দিন দেরি হইল না। একবার মায়ের খুব জ্বর হইল। যে-ঘরে মা থাকিতেন সে-ঘরে আমার যাওয়া নিষেধ ছিল। আমি দরজার সামনে বসিয়া মায়ের কাতরানি শুনিতাম।

তিনি ঘরের মেঝেয় শয়ন করিতেন। উপরে পালঙ্কের উপর তাঁর স্বামী শ্রীশবাবু থাকিতেন। তিনি মোটেই ছুতমার্গ মানিতেন না। একদিন তিনি আমাকে দরজার সামনে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া বলিলেন, “সাধু! তুমি ভিতরে আস। দরজার কাছে বসিয়া আছো কেন?” সেদিন হইতে আমি ভিতরে যাইবার হুকুম পাইলাম। আমি মায়ের পাশে বসিয়া একখানা হাত-পাখা লইয়া মাকে বাতাস করিতে লাগিলাম।

এ-বাড়িতে অসুখে-বিসুখে কেহ কাহাকে বড় একটা দেখাশুনা করিত না। তাঁহার এই অসুখে ছেলেমেয়েরা কেহই মায়ের কাছে আসিয়া সেবা-শুশ্রূষা করিল না। জ্বরের ঘোরে মা আমাকে দেখিতে পাইয়া বড়ই খুশি হইলেন। আমাকে বলিলেন, “সাধু! তুমি আসিয়াছ। আমার মাথাটা ভীষণ ধরিয়াছে। তুমি একটু টিপিয়া দাও।” আমি মায়ের মাথাটা আস্তে আস্তে টিপিয়া দিতে লাগিলাম। ইতিপূর্বে সেবা-সমিতির বন্ধুদের সঙ্গে আরও বহু রোগীর সেবা করিয়া সেবার হাত আমার বেশ পাকা হইয়া উঠিয়াছিল। দক্ষ হাতে মাথা টিপিয়া অল্প সময়ের মধ্যেই মায়ের মাথাব্যথা সারাইয়া দিলাম।

রাত্রে মায়ের বিছানার পাশে বসিয়া আছি। দারুণ জ্বরের ঘোরে মা কাঁপিতেছেন। আর ঘন ঘন পিপাসা হইতেছে। এতদিন তিনি উঠিয়া কলসি হইতে পানি গড়াইয়া লইতে পারিতেন। আজ আর পারিতেছেন না। মা আমাকে বলিলেন, “বাবা সাধু! তুই আমার পরজনমের ছেলে ছিলি। অথবা আমিই তোর মেয়ে ছিলাম। তোর হাতে জল খাইলে আমার জাতি যাইবে না। তুই কলসি হইতে জল ঢালিয়া আমার মুখে দে।” আমি নিকটের কলসি হইতে পানি ঢালিয়া মায়ের মুখে দিলাম। টেম্পারেচর লইয়া দেখিলাম, জ্বর ১০৫-এ উঠিয়াছে। বালতি ভরিয়া পানি আনিয়া মায়ের মাথা ধোয়াইয়া দিলাম। তারপর নেকড়া ভিজাইয়া মাথায় জলপট্টি দিতে লাগিলাম।

চলবে…