০৩:৫৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ১০ নভেম্বর ২০২৫
স্লো-লিভিং: শহরের ছোট বদলে বড় স্থিতি ঢাকায় দিনের আলোয় গুলিতে নিহত একজন স্ট্রিমিং যুগে হলিউড: নাম নয়, কারিগরি ও ধারাবাহিকতা শিক্ষায় সরলীকৃত চীনা: অনমনীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রয়োজন বাস্তব সংস্কার মাইক্রো-ড্রামা: ছোট পর্বে পূর্ণ কাহিনি সমাধিক্ষেত্রের পদচিহ্নে ইতিহাস ও কল্পনার ছায়া যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে উঠছে ট্রাম্পের ‘গোল্ডেন ডোম’ — ভবিষ্যতের প্রতিরক্ষা ঢাল নাকি এক মহাকল্পনার সাম্রাজ্য? তানজিন তিশা: আলো, প্রতিভা আর আত্মনির্ভরতার দীপ্ত গল্প জাপানের ট্রেডিং হাউসগুলো ট্রাম্পের শুল্ক চুক্তি অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ বৃদ্ধির কথা বলছে অ্যানথ্রপিকের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবসা: ভবিষ্যতের প্রবৃদ্ধি ও উদ্বেগ

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৩৩)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:২২ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  • 60

ধীরেনদের বাসায়

এই ভদ্রমহিলা ছিলেন কলিকাতার মেয়ে। তাঁর দেশে হয়তো মুচি মোছলমান কথাটি একসঙ্গে ব্যবহৃত হইত। সেই অভ্যাসমতোই তিনি উহা বলিতেন। প্রথা হিসাবে ছোঁয়াছুঁয়ির কঠোরতা তিনি মানিতেন সত্য কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে তিনি মুসলমানদের ঘৃণা করিতেন না। তাঁহার স্বাভাবিক স্নেহপ্রবণ মাতৃ-হৃদয় এত ছোঁয়াছুঁয়ি সত্ত্বেও আমার মতো আরও কয়েকটি মুসলমান ছেলেকে আপন করিয়া লইয়াছিল। আজকাল ছোঁয়াছুঁয়ি মানে না এরূপ বহু হিন্দুর মধ্যে যে কঠোর সাম্প্রদায়িকতা দেখা যায় তখনকার দিনে এই ছুতমার্গগ্রস্ত হিন্দুদের মধ্যে তাহা ছিল না। বাহিরের এই নানারকমের প্রথা ও নিষেধের বেড়া ভাঙিয়া মাঝে মাঝে কাহারও কাহারও স্নেহ-মমতা শত ধারায় অপরের প্রতি প্রবাহিত হইত। আমার এই মাটি তাঁহাদেরই একজন ছিলেন।

কেন জানি না, সেদিন আমি প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলাম, নিজের সেবাযত্ন দিয়া এই মহিলাটিকে শুধু আমি ছুতমার্গ হইতে মুক্ত করিব না, একদিন তিনি আমার হাতে খাদ্য পর্যন্ত গ্রহণ করিবেন।

সেই সুযোগ পাইতে বেশি দিন দেরি হইল না। একবার মায়ের খুব জ্বর হইল। যে-ঘরে মা থাকিতেন সে-ঘরে আমার যাওয়া নিষেধ ছিল। আমি দরজার সামনে বসিয়া মায়ের কাতরানি শুনিতাম।

তিনি ঘরের মেঝেয় শয়ন করিতেন। উপরে পালঙ্কের উপর তাঁর স্বামী শ্রীশবাবু থাকিতেন। তিনি মোটেই ছুতমার্গ মানিতেন না। একদিন তিনি আমাকে দরজার সামনে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া বলিলেন, “সাধু! তুমি ভিতরে আস। দরজার কাছে বসিয়া আছো কেন?” সেদিন হইতে আমি ভিতরে যাইবার হুকুম পাইলাম। আমি মায়ের পাশে বসিয়া একখানা হাত-পাখা লইয়া মাকে বাতাস করিতে লাগিলাম।

এ-বাড়িতে অসুখে-বিসুখে কেহ কাহাকে বড় একটা দেখাশুনা করিত না। তাঁহার এই অসুখে ছেলেমেয়েরা কেহই মায়ের কাছে আসিয়া সেবা-শুশ্রূষা করিল না। জ্বরের ঘোরে মা আমাকে দেখিতে পাইয়া বড়ই খুশি হইলেন। আমাকে বলিলেন, “সাধু! তুমি আসিয়াছ। আমার মাথাটা ভীষণ ধরিয়াছে। তুমি একটু টিপিয়া দাও।” আমি মায়ের মাথাটা আস্তে আস্তে টিপিয়া দিতে লাগিলাম। ইতিপূর্বে সেবা-সমিতির বন্ধুদের সঙ্গে আরও বহু রোগীর সেবা করিয়া সেবার হাত আমার বেশ পাকা হইয়া উঠিয়াছিল। দক্ষ হাতে মাথা টিপিয়া অল্প সময়ের মধ্যেই মায়ের মাথাব্যথা সারাইয়া দিলাম।

রাত্রে মায়ের বিছানার পাশে বসিয়া আছি। দারুণ জ্বরের ঘোরে মা কাঁপিতেছেন। আর ঘন ঘন পিপাসা হইতেছে। এতদিন তিনি উঠিয়া কলসি হইতে পানি গড়াইয়া লইতে পারিতেন। আজ আর পারিতেছেন না। মা আমাকে বলিলেন, “বাবা সাধু! তুই আমার পরজনমের ছেলে ছিলি। অথবা আমিই তোর মেয়ে ছিলাম। তোর হাতে জল খাইলে আমার জাতি যাইবে না। তুই কলসি হইতে জল ঢালিয়া আমার মুখে দে।” আমি নিকটের কলসি হইতে পানি ঢালিয়া মায়ের মুখে দিলাম। টেম্পারেচর লইয়া দেখিলাম, জ্বর ১০৫-এ উঠিয়াছে। বালতি ভরিয়া পানি আনিয়া মায়ের মাথা ধোয়াইয়া দিলাম। তারপর নেকড়া ভিজাইয়া মাথায় জলপট্টি দিতে লাগিলাম।

চলবে…

জনপ্রিয় সংবাদ

স্লো-লিভিং: শহরের ছোট বদলে বড় স্থিতি

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৩৩)

১১:০০:২২ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

ধীরেনদের বাসায়

এই ভদ্রমহিলা ছিলেন কলিকাতার মেয়ে। তাঁর দেশে হয়তো মুচি মোছলমান কথাটি একসঙ্গে ব্যবহৃত হইত। সেই অভ্যাসমতোই তিনি উহা বলিতেন। প্রথা হিসাবে ছোঁয়াছুঁয়ির কঠোরতা তিনি মানিতেন সত্য কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে তিনি মুসলমানদের ঘৃণা করিতেন না। তাঁহার স্বাভাবিক স্নেহপ্রবণ মাতৃ-হৃদয় এত ছোঁয়াছুঁয়ি সত্ত্বেও আমার মতো আরও কয়েকটি মুসলমান ছেলেকে আপন করিয়া লইয়াছিল। আজকাল ছোঁয়াছুঁয়ি মানে না এরূপ বহু হিন্দুর মধ্যে যে কঠোর সাম্প্রদায়িকতা দেখা যায় তখনকার দিনে এই ছুতমার্গগ্রস্ত হিন্দুদের মধ্যে তাহা ছিল না। বাহিরের এই নানারকমের প্রথা ও নিষেধের বেড়া ভাঙিয়া মাঝে মাঝে কাহারও কাহারও স্নেহ-মমতা শত ধারায় অপরের প্রতি প্রবাহিত হইত। আমার এই মাটি তাঁহাদেরই একজন ছিলেন।

কেন জানি না, সেদিন আমি প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলাম, নিজের সেবাযত্ন দিয়া এই মহিলাটিকে শুধু আমি ছুতমার্গ হইতে মুক্ত করিব না, একদিন তিনি আমার হাতে খাদ্য পর্যন্ত গ্রহণ করিবেন।

সেই সুযোগ পাইতে বেশি দিন দেরি হইল না। একবার মায়ের খুব জ্বর হইল। যে-ঘরে মা থাকিতেন সে-ঘরে আমার যাওয়া নিষেধ ছিল। আমি দরজার সামনে বসিয়া মায়ের কাতরানি শুনিতাম।

তিনি ঘরের মেঝেয় শয়ন করিতেন। উপরে পালঙ্কের উপর তাঁর স্বামী শ্রীশবাবু থাকিতেন। তিনি মোটেই ছুতমার্গ মানিতেন না। একদিন তিনি আমাকে দরজার সামনে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া বলিলেন, “সাধু! তুমি ভিতরে আস। দরজার কাছে বসিয়া আছো কেন?” সেদিন হইতে আমি ভিতরে যাইবার হুকুম পাইলাম। আমি মায়ের পাশে বসিয়া একখানা হাত-পাখা লইয়া মাকে বাতাস করিতে লাগিলাম।

এ-বাড়িতে অসুখে-বিসুখে কেহ কাহাকে বড় একটা দেখাশুনা করিত না। তাঁহার এই অসুখে ছেলেমেয়েরা কেহই মায়ের কাছে আসিয়া সেবা-শুশ্রূষা করিল না। জ্বরের ঘোরে মা আমাকে দেখিতে পাইয়া বড়ই খুশি হইলেন। আমাকে বলিলেন, “সাধু! তুমি আসিয়াছ। আমার মাথাটা ভীষণ ধরিয়াছে। তুমি একটু টিপিয়া দাও।” আমি মায়ের মাথাটা আস্তে আস্তে টিপিয়া দিতে লাগিলাম। ইতিপূর্বে সেবা-সমিতির বন্ধুদের সঙ্গে আরও বহু রোগীর সেবা করিয়া সেবার হাত আমার বেশ পাকা হইয়া উঠিয়াছিল। দক্ষ হাতে মাথা টিপিয়া অল্প সময়ের মধ্যেই মায়ের মাথাব্যথা সারাইয়া দিলাম।

রাত্রে মায়ের বিছানার পাশে বসিয়া আছি। দারুণ জ্বরের ঘোরে মা কাঁপিতেছেন। আর ঘন ঘন পিপাসা হইতেছে। এতদিন তিনি উঠিয়া কলসি হইতে পানি গড়াইয়া লইতে পারিতেন। আজ আর পারিতেছেন না। মা আমাকে বলিলেন, “বাবা সাধু! তুই আমার পরজনমের ছেলে ছিলি। অথবা আমিই তোর মেয়ে ছিলাম। তোর হাতে জল খাইলে আমার জাতি যাইবে না। তুই কলসি হইতে জল ঢালিয়া আমার মুখে দে।” আমি নিকটের কলসি হইতে পানি ঢালিয়া মায়ের মুখে দিলাম। টেম্পারেচর লইয়া দেখিলাম, জ্বর ১০৫-এ উঠিয়াছে। বালতি ভরিয়া পানি আনিয়া মায়ের মাথা ধোয়াইয়া দিলাম। তারপর নেকড়া ভিজাইয়া মাথায় জলপট্টি দিতে লাগিলাম।

চলবে…