ধীরেনদের বাসায়
শহরের সব লোকে বলিত, শ্রীশবাবুর মতো এমন কৃপণ লোক কেহই নাই। ফরিদপুর লোন অফিসের মজুত প্রায় সমস্ত টাকাই শ্রীশবাবুর। কিন্তু তিনি খরচ করেন না। তিনি লোকদের দেখাইয়া কাউকে কিছু দান করিতেন না। দূর-সম্পর্কের গরিব আত্মীয়েরা মাঝে মাঝে সাহায্য চাহিয়া তাঁহার নিকট পত্র লিখিত। সপ্তাহে অন্তত দুই-তিনদিন তিনি পাঁচ টাকা, দশ টাকা, বিশ টাকা করিয়া মনিঅর্ডার করিতেন। এই টাকা কাহারা পাইত, বাড়ির কেহই তাহার সন্ধান জানিত না। সেই অগণিত সাহায্যপ্রাপ্ত লোকদের মতো তাঁহার এই গোপন দানও চিরকালই লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকিয়া যাইত।
শুনিয়াছি, ছাত্র-বয়সে তিনি নানা অভাব-অভিযোগের মধ্য দিয়া নিজেকে গড়িয়া তুলিয়াছিলেন। সেইজন্যই বোধহয় পরিণত বয়সে তিনি সাংসারিক খরচপত্রের বিষয়ে খুব মিতব্যয়িতা অবলম্বন করিতেন।
ছেলেদের মধ্যে কিরণদাদা তাঁর বড় প্রিয়পাত্র ছিলেন। প্রেসিডেন্সী কলেজ হইতে তিনি ফিলোসফিতে অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস পাইয়াছিলেন। এই ছেলেটিকে লইয়া শ্রীশবাবু মনে মনে অনেক আকাশ-কুসুম রচনা করিতেন। কিন্তু মানুষ যাহা ভাবে তাহা হয় না। কলিকাতায় অধ্যয়নের সময় মাঝে মাঝে তিনি রামকৃষ্ণ মিশনে যাতায়াত করিতেন। একদিন হঠাৎ সেখানে যাইয়া তিনি সন্ন্যাসী হইয়া বসিলেন। সন্ন্যাসীদের আপনজনের প্রতি মায়া করিতে নাই। মায়ের কান্দন, বাপের কান্দন কোনো দিকেই তিনি ভ্রূক্ষেপ করিলেন না।
আগেই বলিয়াছি, এই গম্ভীর প্রকৃতির লোকটিকে আমি কোনোদিন কোনো দুঃখে নত হইতে দেখি নাই। কোনো আনন্দে মশগুল হইতেও দেখি নাই। মহা মহীরুহের মতো সাংসারিক সমস্ত ঝড়-ঝঞ্ঝা আপদ-বিপদের মধ্যে তিনি অচল-অটলভাবে দণ্ডায়মান থাকিতেন। সবাই তাঁহাকে ভয় করিত। তিনি কাহাকেও ভয় করিতেন না। তাঁহার নিকটে অনুগ্রহপ্রার্থীরা আসিয়া তাঁহাকে ভক্তি করিত, তিনি কাহারও অনুগ্রহপ্রার্থী ছিলেন না-তিনি কাহাকেও ভক্তি করিতেন না। এই বিরাট পুরুষটিকে দেখিয়া আমার মনে হইত, এই লোকটি যেন আর কোনোখানের। আমাদের হাসি-তামাশা, দুঃখ-বেদনাভরা পৃথিবীর ইনি যেন কেহ নন।
কিন্তু কিরণদাদার সন্ন্যাসী হওয়ার পর হইতেই তিনি একেবারে ভাঙিয়া পড়িলেন। দুই-দুইটি মেয়ের মৃত্যুতে যাঁর চক্ষু হইতে একফোঁটা অশ্রু পড়ে নাই, আজ তিনি বালকের মতো কাঁদিয়া আকুল হইলেন। চোখের জলে বুক ভাসাইয়া যাকে দেখেন তারই গলা জড়াইয়া ধরিয়া বলেন, “আমার কিরণকে আনিয়া দাও।” এই খবর হয়তো কিরণদাদার কাছেও পৌঁছিত কিন্তু সেই নির্মম একদিনও সেদিকে ফিরিয়া তাকাইলেন না। শুনিয়াছি রামকৃষ্ণ মিশনের সাধুরা পরের দুঃখে জীবন উৎসর্গ করেন। কিন্তু নিজের পিতা-মাতার দুঃখ যে-ছেলে বুঝিল না, পরের দুঃখ সে কেমন করিয়া অনুভব করিবে, ইহা আজও আমার বোধের অগম্য। কিরণদাদার সঙ্গে আবার যদি দেখা হয়, এই প্রশ্ন তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিব।
এই আঘাতে ধীরে ধীরে শ্রীশবাবু ভাঙিয়া পড়িলেন। ছেলেরা তাঁহাকে পুরী লইয়া গেল। কিন্তু স্বাস্থ্য আর তাঁহার ফিরিল না। একদিন সেই মহা মহীরুহ মাটিতে ভাঙিয়া পড়িল। মরিবার আগে তিনি একটি উইল করিয়া গিয়াছিলেন। পিতৃহারা তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র রাসমোহনদাদা তাঁহার বাড়িতে থাকিয়া পড়াশুনা করিতেন। নিজের ছেলেদের মতো তাঁকেও তিনি তাঁর সম্পত্তির সমান ভাগী করিয়া উইলে লিখিয়া দিয়া গেলেন।
চলবে…