ভাষা আন্দোলনের তাত্ত্বিকগুরু ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ যে তাত্ত্বিক দিকগুলো বিশ্লেষণ করে বাংলাভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহন করার যুক্তিগুলো মানুষের সামনে আনেন- তার ভেতর দুটি দিক ছিলো। প্রথমে রাষ্ট্রভাষা কেন বাংলাকে করতে হবে। দ্বিতীয়ত, বাংলা ভাষার সঙ্গে সকল বাঙালি ধর্মীয় গোষ্টির যোগ।
ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর এই শেষের দিকটি চিহ্নিত করার ভেতর দিয়ে এ ভুখন্ডের সচেতন কিছু মানুষের চেতনায় খুব বড় একটি নাড়া দেয়। তারা বুঝতে পারে, একটি জাতি গোষ্টি বা একটি রাষ্ট্রের নরগোষ্টিকে কখনই ধর্মীয় বিভাজন দিয়ে বিভক্ত করা যায় না। কারণ, ওই নরগোষ্টি তার ওই ভূখন্ডের সংস্কৃতির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। আর মানুষ তার পারলৌকিক জীবনের জন্যে সকল কর্ম পালন করার পরেও তার ইহজাগতিক জীবন সম্পূর্ণরূপে আপন জম্মভূমির সংস্কৃতি দ্বারা পরিচালিত। এমনকি আরো স্পষ্ট করে বলা যায়, আধুনিক যে রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছে, এর মূল শক্তি সকল সংস্কৃতির ঐক্যের ওপর ভিত্তি। কোন পারলৌকিক ধর্ম কখনই রাষ্ট্র’র ও রাজনীতির বিষয় নয়।
যদিও বলা হয় পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিলো ধর্মের নামে; বাস্তবে এর গভীরে মূল কারণ ছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর অর্থনৈতিক কলোনীর কনসেপ্টকে মাথায় রেখে। তারপরেও দৃশ্যত মানুষ তখন ধর্মের নামে নিজেকে চেনার চেষ্টা করছিলো। অর্থাত বিদেশী শক্তির কূট চালে এখানে ধর্ম ব্যবসায়ীদের হাতে ধর্মের ভুল ব্যাখা তুলে দিয়ে- রাষ্ট্রকে ধর্মের নামে দুর্বল করার পথটি তৈরি করা হয়। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ সেখান থেকে রাষ্ট্রকে তার আপন সংস্কৃতির ওপর দাঁড়ানোর তাত্ত্বিক দিকটি পরোক্ষভাবে এ দেশের মানুষের চেতনায় নিয়ে আসেন, ভাষা বিষয়ক আলোচনার ভেতর দিয়ে।
আর সেই থেকে শুরু হয় সংস্কৃতি-ভিত্তিক যাত্রা এ ভূখন্ডে। আর তার ভেতর দিয়েই শুরু হয় রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের নাগরিককে ধর্ম ব্যবসায়ীদের হাত থেকে বের করে আনার যাত্রা। তাই একুশ মানে সব সময়ই ধর্ম ব্যবসায়ীদের হাত থেকে মানুষ ও রাষ্ট্রকে বের করে আনার সংগ্রাম।