০৪:৫০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

চীনে, একজন শ্রমিক-কবি স্বপ্ন তার একটি ভালো জীবনের

  • Sarakhon Report
  • ১২:৩০:৪৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  • 12

সারাক্ষণ ডেস্ক

১. একটি বিরাট অভিবাসনের চিত্র

১৯৮০-এর দশক থেকে শুরু করে, প্রায় ৩০ কোটি মানুষ চীনের গ্রামাঞ্চল ছেড়ে বড় শহরগুলোতে পাড়ি জমিয়েছেন। শিল্প-কারখানা ও নির্মাণক্ষেত্রে কাজ করার জন্য তারা শহরের উন্নয়নে অসামান্য ভূমিকা রাখলেও, অনেকেরই এখনো সেই প্রশাসনিক স্বীকৃতি বা ‘হুকৌ’ নেই যা তাদের সম্পূর্ণ স্থানীয় নাগরিক মর্যাদা দেবে।

২. হুকৌ ব্যবস্থা: একটি অভ্যন্তরীণ পাসপোর্ট

চীনের হুকৌ ব্যবস্থা কার্যকরভাবে একজন নাগরিককে তার জন্মস্থান বা সরকারি নিবন্ধনসংলগ্ন এলাকায় সংযুক্ত করে রাখে।

  • শহরের হুকৌ থাকলে ভালো স্কুল ও স্বাস্থ্যের মতো সরকারি সুবিধা বেশি মেলে, এমনকি চাকরি পেতেও অগ্রাধিকার পাওয়া যায়।
  • যাদের শহরের হুকৌ নেই, তারা সেই এলাকার চোখে ‘বহিরাগত’। তাদের সন্তানদের স্থানীয় সরকারি স্কুলে ভর্তি করা কঠিন হয়ে পড়ে; অনেক সময় বাবা-মায়ের কাজ শহরে হলেও সন্তানদের গ্রামেই রেখে আসতে হয়।
  • রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং ‘সাধারণ সমৃদ্ধি’র যে আদর্শিক লক্ষ্য তুলে ধরেছেন, অনেক বিশ্লেষকের মতে হুকৌ ব্যবস্থা পুরোপুরি শিথিল না হলে সেটি অর্জন কঠিন হবে। ছোট শহরে কিছুটা সহজ হলেও বড় শহরে এই নিয়ম এখনো বেশ কড়া।

৩. উ জিয়া: স্বপ্নবাজ একজন শ্রমিক-কবি

শিশুকাল থেকেই লেখালেখির প্রতি ঝোঁক ছিল উ জিয়ার। কিশোরী বয়সে, যখন তিনি অন্য ১১ জন শ্রমিকের সঙ্গে কারখানার ডরমিটরিতে থাকতেন, তখনই তার ইচ্ছা হয়েছিল একজন প্রকাশিত লেখক হওয়ার এবং ঐ এসেম্বলি লাইনের একঘেয়েমি পেছনে ফেলে দেওয়ার।

  • ১৯৯০-এর দশকে, যখন চীন আগুয়ান পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, সেই সময়ে উ জিয়া প্রতিদিন অজস্র লেখা তৈরি করতেন।
  • তিনি বিশ্বাস করতেন, অক্লান্ত লেখালেখি তাকে প্রতিষ্ঠিত কবি ও লেখকদের কাতারে নিয়ে আসবে।
  • একসময় তিনি শ্রমিকজীবী নতুন প্রজন্মের এক উল্লেখযোগ্য কণ্ঠস্বর হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন।

৪. শহুরে স্বীকৃতির লড়াই

বর্তমানে ৪২ বছর বয়সী উ জিয়া শেনজেনে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে থাকছেন। কিন্তু তার হুকৌ কাগজপত্র এখনও সিচুয়ান প্রদেশের গ্রামাঞ্চলে রয়ে গেছে।

  • এই শহরে প্রায় ১৪ মিলিয়ন অভিবাসীর মতো তিনিও শহর-হুকৌ ছাড়া বসবাস করছেন।
  • বাচ্চাদের ভালো শিক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য উ জিয়ার কাছে শহরের হুকৌ পাওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সরকারি স্কুলে ভর্তি হতে স্থানীয় হুকৌ বা বাড়তি খরচের বিকল্প ব্যবস্থা দরকার হয়।
  • শেনজেনের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় হুকৌ পেতে তাকে একটি পরীক্ষায় পাস করতে হবে, আর শহরের কর্তৃপক্ষ মূলত উচ্চশিক্ষিত বা যারা বাড়ির মালিক অথবা নির্দিষ্ট পরিমাণ কর প্রদানকারী—তাদের অগ্রাধিকার দেয়।

৫. পরীক্ষায় ব্যর্থতা ও নতুন আশার অনুসন্ধান

উ জিয়া দিনরাত পড়াশোনা করে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন, কিন্তু শেষ মুহূর্তে দেখা গেল নিয়ম আরও কঠিন হয়ে গেছে।

  • পরীক্ষার ফলাফলে তিনি ব্যর্থ হন, যা তার শহরের হুকৌ পাওয়ার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
  • সময়ও দ্রুত বয়ে যাচ্ছে, কারণ ৪৫ বছর বয়স পার হওয়ার পর শেনজেনে আর হুকৌর আবেদন করা যায় না। তাই পরিবারের ভবিষ্যতের জন্য তার এখনো চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

৬. লেখালেখির মূল্যে স্বপ্ন

যদিও সাহিত্যচর্চা তাকে মানসিক শান্তি দেয়, এর আর্থিক সুফল হাতে গোনা।

  • উ জিয়ার ব্যক্তি-জীবনের চড়াই-উতরাই, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সংঘাত বা হুকৌ পাওয়ার সংগ্রাম নিয়ে প্রকাশকরা তেমন আগ্রহ দেখায় না।
  • তবু তিনি লেখালেখি চালিয়ে যাচ্ছেন, কারণ সেটিই তাকে স্বপ্নের সঙ্গে সংযুক্ত রাখে।

উ জিয়া বলেন, “বড় কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা আমার নেই। লেখালেখি আমার জীবনের মূলধারা বদলে দেবে না, কিন্তু এই লেখাগুলো আমাকে এখনো সামনে এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করে।”

চীনে, একজন শ্রমিক-কবি স্বপ্ন তার একটি ভালো জীবনের

১২:৩০:৪৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

সারাক্ষণ ডেস্ক

১. একটি বিরাট অভিবাসনের চিত্র

১৯৮০-এর দশক থেকে শুরু করে, প্রায় ৩০ কোটি মানুষ চীনের গ্রামাঞ্চল ছেড়ে বড় শহরগুলোতে পাড়ি জমিয়েছেন। শিল্প-কারখানা ও নির্মাণক্ষেত্রে কাজ করার জন্য তারা শহরের উন্নয়নে অসামান্য ভূমিকা রাখলেও, অনেকেরই এখনো সেই প্রশাসনিক স্বীকৃতি বা ‘হুকৌ’ নেই যা তাদের সম্পূর্ণ স্থানীয় নাগরিক মর্যাদা দেবে।

২. হুকৌ ব্যবস্থা: একটি অভ্যন্তরীণ পাসপোর্ট

চীনের হুকৌ ব্যবস্থা কার্যকরভাবে একজন নাগরিককে তার জন্মস্থান বা সরকারি নিবন্ধনসংলগ্ন এলাকায় সংযুক্ত করে রাখে।

  • শহরের হুকৌ থাকলে ভালো স্কুল ও স্বাস্থ্যের মতো সরকারি সুবিধা বেশি মেলে, এমনকি চাকরি পেতেও অগ্রাধিকার পাওয়া যায়।
  • যাদের শহরের হুকৌ নেই, তারা সেই এলাকার চোখে ‘বহিরাগত’। তাদের সন্তানদের স্থানীয় সরকারি স্কুলে ভর্তি করা কঠিন হয়ে পড়ে; অনেক সময় বাবা-মায়ের কাজ শহরে হলেও সন্তানদের গ্রামেই রেখে আসতে হয়।
  • রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং ‘সাধারণ সমৃদ্ধি’র যে আদর্শিক লক্ষ্য তুলে ধরেছেন, অনেক বিশ্লেষকের মতে হুকৌ ব্যবস্থা পুরোপুরি শিথিল না হলে সেটি অর্জন কঠিন হবে। ছোট শহরে কিছুটা সহজ হলেও বড় শহরে এই নিয়ম এখনো বেশ কড়া।

৩. উ জিয়া: স্বপ্নবাজ একজন শ্রমিক-কবি

শিশুকাল থেকেই লেখালেখির প্রতি ঝোঁক ছিল উ জিয়ার। কিশোরী বয়সে, যখন তিনি অন্য ১১ জন শ্রমিকের সঙ্গে কারখানার ডরমিটরিতে থাকতেন, তখনই তার ইচ্ছা হয়েছিল একজন প্রকাশিত লেখক হওয়ার এবং ঐ এসেম্বলি লাইনের একঘেয়েমি পেছনে ফেলে দেওয়ার।

  • ১৯৯০-এর দশকে, যখন চীন আগুয়ান পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, সেই সময়ে উ জিয়া প্রতিদিন অজস্র লেখা তৈরি করতেন।
  • তিনি বিশ্বাস করতেন, অক্লান্ত লেখালেখি তাকে প্রতিষ্ঠিত কবি ও লেখকদের কাতারে নিয়ে আসবে।
  • একসময় তিনি শ্রমিকজীবী নতুন প্রজন্মের এক উল্লেখযোগ্য কণ্ঠস্বর হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন।

৪. শহুরে স্বীকৃতির লড়াই

বর্তমানে ৪২ বছর বয়সী উ জিয়া শেনজেনে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে থাকছেন। কিন্তু তার হুকৌ কাগজপত্র এখনও সিচুয়ান প্রদেশের গ্রামাঞ্চলে রয়ে গেছে।

  • এই শহরে প্রায় ১৪ মিলিয়ন অভিবাসীর মতো তিনিও শহর-হুকৌ ছাড়া বসবাস করছেন।
  • বাচ্চাদের ভালো শিক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য উ জিয়ার কাছে শহরের হুকৌ পাওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সরকারি স্কুলে ভর্তি হতে স্থানীয় হুকৌ বা বাড়তি খরচের বিকল্প ব্যবস্থা দরকার হয়।
  • শেনজেনের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় হুকৌ পেতে তাকে একটি পরীক্ষায় পাস করতে হবে, আর শহরের কর্তৃপক্ষ মূলত উচ্চশিক্ষিত বা যারা বাড়ির মালিক অথবা নির্দিষ্ট পরিমাণ কর প্রদানকারী—তাদের অগ্রাধিকার দেয়।

৫. পরীক্ষায় ব্যর্থতা ও নতুন আশার অনুসন্ধান

উ জিয়া দিনরাত পড়াশোনা করে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন, কিন্তু শেষ মুহূর্তে দেখা গেল নিয়ম আরও কঠিন হয়ে গেছে।

  • পরীক্ষার ফলাফলে তিনি ব্যর্থ হন, যা তার শহরের হুকৌ পাওয়ার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
  • সময়ও দ্রুত বয়ে যাচ্ছে, কারণ ৪৫ বছর বয়স পার হওয়ার পর শেনজেনে আর হুকৌর আবেদন করা যায় না। তাই পরিবারের ভবিষ্যতের জন্য তার এখনো চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

৬. লেখালেখির মূল্যে স্বপ্ন

যদিও সাহিত্যচর্চা তাকে মানসিক শান্তি দেয়, এর আর্থিক সুফল হাতে গোনা।

  • উ জিয়ার ব্যক্তি-জীবনের চড়াই-উতরাই, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সংঘাত বা হুকৌ পাওয়ার সংগ্রাম নিয়ে প্রকাশকরা তেমন আগ্রহ দেখায় না।
  • তবু তিনি লেখালেখি চালিয়ে যাচ্ছেন, কারণ সেটিই তাকে স্বপ্নের সঙ্গে সংযুক্ত রাখে।

উ জিয়া বলেন, “বড় কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা আমার নেই। লেখালেখি আমার জীবনের মূলধারা বদলে দেবে না, কিন্তু এই লেখাগুলো আমাকে এখনো সামনে এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করে।”