শশাঙ্ক মণ্ডল
সমাজের শ্রদ্ধেয় লোকদের কুৎসিত আচরণ-মানুষের মন থেকে এদের প্রতি শ্রদ্ধা কমে যায়। এদের মুখে ভালো ভালো কথার ওপর আর আস্থা রাখতে পারে না। এই জীবনাভিজ্ঞতা সে প্রকাশ করেছে- ‘মুখে একখান বুকে একখান; অথবা ‘ডুব দিয়া পানি খাই সারাদিন রোজা রই।’ পুরুষশাসিত সমাজে মেয়েরা তাদের জীবনের দুঃখ-যন্ত্রণা স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধাহীনতা এভাবে প্রকাশ করে-‘ ভাত দিবার ক্ষমতা নাই, কিলইবার ঠাউর।’ ‘ভাত দেয় না ভাতারে ভাত দেয় গতরে।’ আবার সেই সাথে স্ত্রীর প্রতি ভালবাসাও প্রকাশ পায়- ‘তোর নথ নাড়াটাও ভাল।
‘ বাংলার কৃষিজীবী সমাজে শাশুড়ির একটা ভূমিকা থাকে এবং, তা বধূর ক্ষেত্রে কিছুটা অসহনীয় অবস্থার সৃষ্টি করে। শাশুড়ি বৌ -এর প্রতি অপ্রসন্ন হয়ে বলে ‘বাজার ঘাট যেমন তেমন সিদুর আনা চাই।’ অপর দিকে শাশুড়ি জামাই-এর প্রতি ভীষণ মমতাময়ী তা সত্ত্বেও সে ঘোষণা করে ‘মেয়ে আছে তাই জামাই আদর নইলে জামাই গাছের বাঁদর’-অকপট স্বীকারোক্তি। বৃদ্ধা মা সংসারে অসহায় বোধ করে-ছেলে বৌ তাকে বুঝতে পারে না, সে নিজেও তাদের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে না, সে নিজের দুর্ভাগ্য এভাবে প্রকাশ করে ‘কপালে আছে ঘি না খেয়ে করব কি?’
নিজের মেয়ের সাথেও তার বিরোধ ঘটে-পুরানো অভ্যাস আচরণ হারিয়ে যাচ্ছে; নতুন কালের সঙ্গে মা নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছে না; বিভিন্ন ব্যাপারে মেয়ে মাকে শেখাতে চায়- মা অভিমানক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলে ওঠে-‘আমার প্যাটের ছাও তুমি আমারে খাইতে চাও?’ বৃদ্ধা তার দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে আজকের কালের মানুষদের আচার-আচরণ মেলাতে পারে না; তাই কিছুটা বিদ্রূপ করে বলে ওঠে ‘কত দেখব কত শোনবো বুড়ো হতি হতি / চোর মিন্সে ঢেকি নে যাবে মাটিত রাখতি রাখতি।’ সামন্ততান্ত্রিক সমাজ পরিবেশে শোষণ বঞ্চনা তার নিত্য-অভিজ্ঞতা; অত্যাচারীরা একে একে সব কিছুই গ্রাস করতে চাইছে, লোভের ব্যগ্র বাহু ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে-এই অভিজ্ঞতার প্রকাশ ঘটেছে- ‘উড়ে এল চিল জুড়ে নি। বিল’।
সামাজিক জীবনে দরিদ্র মানুষদের নানারকম ফন্দি ফিকিরের মধ্য দিয়ে বিপদে ফেলা হয়, জোর জবরদস্তি করে তাদেরকে বাধ্য করা হয় অন্যায়কে মেনে নিতে। তাই প্রবাদ রচিত হয়েছে ‘কুশো বেঁধে দক্ষিণা আদায়’ কিংবা ‘বেড়ায় কাকুড় খেয়েছে।” খেতের কাকুড় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, কেউ-না-কেউ সেই কাকুড় আত্মসাৎ করেছে কিন্তু এতটা প্রভাবশালী যে তার নাম করা যাচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে খেতের বেড়ার ওপর দোষ চাপাতে হচ্ছে।