০২:০৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৪০)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:২০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৫ মার্চ ২০২৫
  • 15

মনাদা

ক্রমে ক্রমে আলিম মোল্লার আমবাগান, শ্মশানঘাটার শেওড়াতলা, লক্ষ্মীপুরের কুরিদের সুপারি-নারিকেল বনে ঘেরা দালান কোঠা, সতর খাদার মিঞাজান মোল্লার চৌচালা বাড়ি পদ্মার ভাঙনে ভাসিয়া গেল।

আমি আর মনাদা বসিয়া বসিয়া আলোচনা করি। আচ্ছা, স্কুলের বড় বড় ছেলেরা তো ইচ্ছা করিলে এই সময় অসহায় গ্রামবাসীদের সাহায্য করিতে পারে। তাহারা বাড়িঘর মাথায় করিয়া নদী ভাঙনের আশঙ্কা নাই এমন স্থানে তাহা রাখিয়া আসিতে পারে। ছোট ছোট ছেলেরা হাঁড়ি-পাতিল আসবাবপত্র সরাইয়া নিরাপদ স্থানে রাখিয়া আসিতে পারে। স্থির হইল, রাত জাগিয়া মনাদা অসহায় গ্রামবাসীদের অবস্থা জানাইয়া একটি আবেদনপত্র লিখিয়া রাখিবেন।

পরদিন স্কুলের সময় মনাদার লিখিত সেই আবেদনপত্রখানা লইয়া আমি স্কুলের হেডমাস্টার মহাশয়ের হাতে দিলাম। তিনি তৎক্ষণাৎ তাহা ক্লাসে ক্লাসে প্রচার করিবার হুকুম দিলেন। এই আবেদনপত্র পড়িয়া ছেলেরা দলে দলে বিভক্ত হইয়া লক্ষ্মীপুর অঞ্চলের গ্রামবাসীদের সাহায্য করিতে ছুটিল। আমাদের দেখাদেখি স্থানীয় ঈশান স্কুলের ছাত্রেরাও ভূতপূর্ব কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট অম্বিকাচরণ মজুমদার মহাশয়ের পুত্র শ্রীকিরণ মজুমদারের নেতৃত্বে আমাদের গ্রামে আসিয়া সাহায্যকাজে ব্যাপৃত হইলেন। তিন-চারদিন বেশ কাজ চলিল। ইতিমধ্যে ফরিদপুরের প্রসিদ্ধ উকিল বাবু পূর্ণচন্দ্র মৈত্র এবং মথুরানাথ মৈত্র মহাশয়দ্বয় দুই স্কুলের হেডমাস্টারদের কাছে পত্র লিখিলেন, “নদীভাঙনের লোকদিগকে ছেলেরা যে সাহায্য করিতে যাইতেছে, তাহারা যদি জলে ডুবিয়া মরে, সেজন্য কে দায়ী হইবে? ছেলেদিগকে স্কুলে দেওয়া হইয়াছে লেখাপড়া করিতে। স্কুলের পড়া ছাড়িয়া তাহাদিগকে সাহায্যকার্যে যাইবার কে অনুমতি দিয়াছে?” এই পত্র পাইয়া পরদিন হইতে দুই স্কুলের হেডমাস্টারই ছেলেদিগকে আর সাহায্যকার্যে যাইবার অনুমতি দিলেন না।

আমি আর মনাদা বসিয়া বসিয়া নানা জল্পনা-কল্পনা করিতে লাগিলাম। আহা, এই নিরাশ্রয় লোকদিগকে ছেলেরা সাহায্য করিতেছিল তাহাও এই ভদ্রলোক দুইজনের গায়ে সহিল না। অনেক ভাবিয়া-চিন্তিয়া স্থির হইল, এই দুই উকিলের নামে একখানা বেনামী পত্র লিখিয়া

উকিল লাইব্রেরির দেয়ালে টানাইয়া দেওয়া হইবে। এই দুই উকিলের বাড়ি ছিল পশ্চিমবঙ্গে। এখন যেমন হিন্দু-মুসলমানে বিরোধ তখনকার দিনে ছিল পশ্চিমবঙ্গে আর পূর্ববঙ্গে বিরোধ।

তবে সে-বিরোধ হিন্দু-মুসলমান বিরোধের মতো এত মারাত্মক হইয়া উঠে নাই। মনাদা লিখিলেন, “বর্ধমানে বন্যার সময় পশ্চিমবঙ্গের ছেলেরা চা-বিস্কুট না হইলে সেবাকার্যে যাইতেন না। পূর্ববঙ্গের ছেলেরাই সেখানে অগ্রণী হইয়া সেবাকার্য করিয়াছিল। মথুরাবাবু ও পূর্ণবাবু ইচ্ছা করিলে মোমের পুতুল করিয়া আপনাপন ছেলেদের ঘরে বসাইয়া রাখিতে পারেন, কিন্তু কোন অধিকারে তাঁহারা পূর্ববঙ্গের ছেলেদের অভিভাবক হইয়া বসিলেন? এই নিরাশ্রয় লোকদের দীর্ঘনিশ্বাস ভগবানের আসন পর্যন্ত যাইয়া পৌঁছিবে। অসহায় গ্রামবাসীদের দুঃখে পূর্ববঙ্গের ছেলেদের সেবাকার্যে যদি তাঁহারা সত্যসত্যই বাধা হইয়া দাঁড়ান, তবে ইহার প্রতিকার পূর্ববঙ্গের ছেলেরাই করিবে।”

 

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৪০)

১১:০০:২০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৫ মার্চ ২০২৫

মনাদা

ক্রমে ক্রমে আলিম মোল্লার আমবাগান, শ্মশানঘাটার শেওড়াতলা, লক্ষ্মীপুরের কুরিদের সুপারি-নারিকেল বনে ঘেরা দালান কোঠা, সতর খাদার মিঞাজান মোল্লার চৌচালা বাড়ি পদ্মার ভাঙনে ভাসিয়া গেল।

আমি আর মনাদা বসিয়া বসিয়া আলোচনা করি। আচ্ছা, স্কুলের বড় বড় ছেলেরা তো ইচ্ছা করিলে এই সময় অসহায় গ্রামবাসীদের সাহায্য করিতে পারে। তাহারা বাড়িঘর মাথায় করিয়া নদী ভাঙনের আশঙ্কা নাই এমন স্থানে তাহা রাখিয়া আসিতে পারে। ছোট ছোট ছেলেরা হাঁড়ি-পাতিল আসবাবপত্র সরাইয়া নিরাপদ স্থানে রাখিয়া আসিতে পারে। স্থির হইল, রাত জাগিয়া মনাদা অসহায় গ্রামবাসীদের অবস্থা জানাইয়া একটি আবেদনপত্র লিখিয়া রাখিবেন।

পরদিন স্কুলের সময় মনাদার লিখিত সেই আবেদনপত্রখানা লইয়া আমি স্কুলের হেডমাস্টার মহাশয়ের হাতে দিলাম। তিনি তৎক্ষণাৎ তাহা ক্লাসে ক্লাসে প্রচার করিবার হুকুম দিলেন। এই আবেদনপত্র পড়িয়া ছেলেরা দলে দলে বিভক্ত হইয়া লক্ষ্মীপুর অঞ্চলের গ্রামবাসীদের সাহায্য করিতে ছুটিল। আমাদের দেখাদেখি স্থানীয় ঈশান স্কুলের ছাত্রেরাও ভূতপূর্ব কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট অম্বিকাচরণ মজুমদার মহাশয়ের পুত্র শ্রীকিরণ মজুমদারের নেতৃত্বে আমাদের গ্রামে আসিয়া সাহায্যকাজে ব্যাপৃত হইলেন। তিন-চারদিন বেশ কাজ চলিল। ইতিমধ্যে ফরিদপুরের প্রসিদ্ধ উকিল বাবু পূর্ণচন্দ্র মৈত্র এবং মথুরানাথ মৈত্র মহাশয়দ্বয় দুই স্কুলের হেডমাস্টারদের কাছে পত্র লিখিলেন, “নদীভাঙনের লোকদিগকে ছেলেরা যে সাহায্য করিতে যাইতেছে, তাহারা যদি জলে ডুবিয়া মরে, সেজন্য কে দায়ী হইবে? ছেলেদিগকে স্কুলে দেওয়া হইয়াছে লেখাপড়া করিতে। স্কুলের পড়া ছাড়িয়া তাহাদিগকে সাহায্যকার্যে যাইবার কে অনুমতি দিয়াছে?” এই পত্র পাইয়া পরদিন হইতে দুই স্কুলের হেডমাস্টারই ছেলেদিগকে আর সাহায্যকার্যে যাইবার অনুমতি দিলেন না।

আমি আর মনাদা বসিয়া বসিয়া নানা জল্পনা-কল্পনা করিতে লাগিলাম। আহা, এই নিরাশ্রয় লোকদিগকে ছেলেরা সাহায্য করিতেছিল তাহাও এই ভদ্রলোক দুইজনের গায়ে সহিল না। অনেক ভাবিয়া-চিন্তিয়া স্থির হইল, এই দুই উকিলের নামে একখানা বেনামী পত্র লিখিয়া

উকিল লাইব্রেরির দেয়ালে টানাইয়া দেওয়া হইবে। এই দুই উকিলের বাড়ি ছিল পশ্চিমবঙ্গে। এখন যেমন হিন্দু-মুসলমানে বিরোধ তখনকার দিনে ছিল পশ্চিমবঙ্গে আর পূর্ববঙ্গে বিরোধ।

তবে সে-বিরোধ হিন্দু-মুসলমান বিরোধের মতো এত মারাত্মক হইয়া উঠে নাই। মনাদা লিখিলেন, “বর্ধমানে বন্যার সময় পশ্চিমবঙ্গের ছেলেরা চা-বিস্কুট না হইলে সেবাকার্যে যাইতেন না। পূর্ববঙ্গের ছেলেরাই সেখানে অগ্রণী হইয়া সেবাকার্য করিয়াছিল। মথুরাবাবু ও পূর্ণবাবু ইচ্ছা করিলে মোমের পুতুল করিয়া আপনাপন ছেলেদের ঘরে বসাইয়া রাখিতে পারেন, কিন্তু কোন অধিকারে তাঁহারা পূর্ববঙ্গের ছেলেদের অভিভাবক হইয়া বসিলেন? এই নিরাশ্রয় লোকদের দীর্ঘনিশ্বাস ভগবানের আসন পর্যন্ত যাইয়া পৌঁছিবে। অসহায় গ্রামবাসীদের দুঃখে পূর্ববঙ্গের ছেলেদের সেবাকার্যে যদি তাঁহারা সত্যসত্যই বাধা হইয়া দাঁড়ান, তবে ইহার প্রতিকার পূর্ববঙ্গের ছেলেরাই করিবে।”