০৯:৪৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৪৪)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:২৬ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১০ মার্চ ২০২৫
  • 21

সেজদি

জ্বরের ঘোরে যেদিন দিদি প্রলাপ বকিতে লাগিলেন, ডাক্তার বলিলেন, “রোগিণীর মাথায় বরফের আইস-ব্যাগ দিতে হইবে।” ফরিদপুরে তখন বরফ পাওয়া যায় না। আমি দিদির পিতা শ্রীশবাবুকে বলিলাম, “রাজবাড়িতে বরফের কল আছে। মাছের বেপারীরা সেই বরফ দিয়া কলিকাতায় মাছ চালান করে। আমি সেখান হইতে বরফ আনিয়া দিতে পারি।” এই মেয়েটিকে শ্রীশবাবু বড়ই ভালোবাসিতেন। তিনি আমাকে দশটি টাকা দিয়া রাজবাড়ি পাঠাইলেন।

দিদির অসুখে আমি যে কিছু করিতে পারিতেছি ইহা আমার কাছে একটি বরের মতো মনে হইল। রাজবাড়ি যাইবার ট্রেনে বসিয়া কেবল মনে হইতেছিল, আমি যেন শক্তিশেলাহত লক্ষ্মণের জন্য বিশল্যকরণী আনিতে চলিয়াছি। আমার সারা অঙ্গ ভরিয়া প্রার্থনার সুর বাজিতেছিল, “খোদা! আমার সেজদিকে ভালো করিয়া দাও।” সন্ধ্যাবেলায় আধ মণ বরফ লইয়া অম্বিকাপুর স্টেশনে নামিলাম। দিদির জন্য কেনা এই বরফ কোনো কুলির মাথায় দিয়া লইয়া যাইব না। আমি নিজে বরফের বস্তা মাথায় করিয়া পথে রওয়ানা হইলাম। সেই বয়সে আধ মণ ভার মাথায় করিয়া বহিবার শক্তি তেমন হয় নাই, কিন্তু দিদির জন্য যে-কোনো কষ্ট আমার কাছে কষ্ট বলিয়া মনে হইল না। বরফের পানিতে সমস্ত জামা-কাপড় ভিজিয়া গেল। কে তাহা গ্রাহ্য করে। আরও জোরে-আরও দ্রুত আমাকে চলিতে হইবে। এই বরফ পাইয়া আমার সেজদি ভালো হইবেন। আমার এত আদরের সেজদি-আমার এত মমতা-মাখানো সেজদি।

বরফের পানিতে ভিজিয়া অতি ক্লান্ত হইয়া শ্রীশবাবুর বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম। শ্রীশবাবু এত যে ভার-ভার্তিক লোক ছিলেন তিনিও আমাকে বুকে জড়াইয়া ধরিলেন। আমার মতো সকলেরই তখন ধারণা হইল, এই বরফ পাইয়া দিদি ভালো হইয়া উঠিবেন।

সত্যসত্যই দিদি ধীরে ধীরে সারিয়া উঠিতে লাগিলেন। ভালো হইয়া দিদি আমাকে একদিন ডাকিয়া বলিলেন, “সাধু! তুমি আমার জন্য কেন এত কষ্ট করিয়া বরফ আনিতে গিয়াছিলে?” আমি কোনো কথাই বলিতে পারিলাম না। আমার চোখ দুইটি মাত্র অশ্রুসজল হইয়া উঠিল। মনে মনে বলিলাম, “আমার লক্ষ্মীমণি সেজদি-সোনামণি সেজদি-তোমার অসুখ সারাইবার জন্য আমি মহাসমুদ্রে ঝাঁপ দিতে পারিতাম, হিমালয় পর্বত ডিঙাইয়া যাইতে পারিতাম।”

সেজদির বর ছিলেন বাবু গণেশচন্দ্র ঘোষাল। তাঁকে আমি গণেশদা বলিয়া ডাকিতাম। তাঁহার নিজের কিছু সাহিত্য-রুচি ছিল। তিনিও সেজদির মতো আমার লেখার খুব অনুরাগী ছিলেন। প্রাইভেট মাস্টারের মতো তিনি আমার পড়া বলিয়া দিতেন। সেকালের লেখা আমার বহু কবিতায় তাঁহার সংশোধনের ছাপ আছে।

সেবার দিদি শ্বশুরবাড়ি যাইবেন। পাবনা জেলার পলাশটিয়া গ্রামে দিদির শ্বশুরবাড়ি। দিদিকে আগাইয়া দিয়া আসিলাম। দিদি বারবার করিয়া বলিয়া দিলেন, “সাধু। তুমি অবশ্য আমাকে পত্র লিখিও।”

দিদি চলিয়া গেলে সমস্ত বাড়ি ভরিয়া যেন একটা বিষাদের ছায়া ঘনাইয়া আসিল। এই মেয়েটি সহজ স্নেহপ্রবণতায় বাড়ির সবগুলি লোককে আপন মমতায় আচ্ছন্ন করিয়া রাখিত।

 

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৪৪)

১১:০০:২৬ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১০ মার্চ ২০২৫

সেজদি

জ্বরের ঘোরে যেদিন দিদি প্রলাপ বকিতে লাগিলেন, ডাক্তার বলিলেন, “রোগিণীর মাথায় বরফের আইস-ব্যাগ দিতে হইবে।” ফরিদপুরে তখন বরফ পাওয়া যায় না। আমি দিদির পিতা শ্রীশবাবুকে বলিলাম, “রাজবাড়িতে বরফের কল আছে। মাছের বেপারীরা সেই বরফ দিয়া কলিকাতায় মাছ চালান করে। আমি সেখান হইতে বরফ আনিয়া দিতে পারি।” এই মেয়েটিকে শ্রীশবাবু বড়ই ভালোবাসিতেন। তিনি আমাকে দশটি টাকা দিয়া রাজবাড়ি পাঠাইলেন।

দিদির অসুখে আমি যে কিছু করিতে পারিতেছি ইহা আমার কাছে একটি বরের মতো মনে হইল। রাজবাড়ি যাইবার ট্রেনে বসিয়া কেবল মনে হইতেছিল, আমি যেন শক্তিশেলাহত লক্ষ্মণের জন্য বিশল্যকরণী আনিতে চলিয়াছি। আমার সারা অঙ্গ ভরিয়া প্রার্থনার সুর বাজিতেছিল, “খোদা! আমার সেজদিকে ভালো করিয়া দাও।” সন্ধ্যাবেলায় আধ মণ বরফ লইয়া অম্বিকাপুর স্টেশনে নামিলাম। দিদির জন্য কেনা এই বরফ কোনো কুলির মাথায় দিয়া লইয়া যাইব না। আমি নিজে বরফের বস্তা মাথায় করিয়া পথে রওয়ানা হইলাম। সেই বয়সে আধ মণ ভার মাথায় করিয়া বহিবার শক্তি তেমন হয় নাই, কিন্তু দিদির জন্য যে-কোনো কষ্ট আমার কাছে কষ্ট বলিয়া মনে হইল না। বরফের পানিতে সমস্ত জামা-কাপড় ভিজিয়া গেল। কে তাহা গ্রাহ্য করে। আরও জোরে-আরও দ্রুত আমাকে চলিতে হইবে। এই বরফ পাইয়া আমার সেজদি ভালো হইবেন। আমার এত আদরের সেজদি-আমার এত মমতা-মাখানো সেজদি।

বরফের পানিতে ভিজিয়া অতি ক্লান্ত হইয়া শ্রীশবাবুর বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম। শ্রীশবাবু এত যে ভার-ভার্তিক লোক ছিলেন তিনিও আমাকে বুকে জড়াইয়া ধরিলেন। আমার মতো সকলেরই তখন ধারণা হইল, এই বরফ পাইয়া দিদি ভালো হইয়া উঠিবেন।

সত্যসত্যই দিদি ধীরে ধীরে সারিয়া উঠিতে লাগিলেন। ভালো হইয়া দিদি আমাকে একদিন ডাকিয়া বলিলেন, “সাধু! তুমি আমার জন্য কেন এত কষ্ট করিয়া বরফ আনিতে গিয়াছিলে?” আমি কোনো কথাই বলিতে পারিলাম না। আমার চোখ দুইটি মাত্র অশ্রুসজল হইয়া উঠিল। মনে মনে বলিলাম, “আমার লক্ষ্মীমণি সেজদি-সোনামণি সেজদি-তোমার অসুখ সারাইবার জন্য আমি মহাসমুদ্রে ঝাঁপ দিতে পারিতাম, হিমালয় পর্বত ডিঙাইয়া যাইতে পারিতাম।”

সেজদির বর ছিলেন বাবু গণেশচন্দ্র ঘোষাল। তাঁকে আমি গণেশদা বলিয়া ডাকিতাম। তাঁহার নিজের কিছু সাহিত্য-রুচি ছিল। তিনিও সেজদির মতো আমার লেখার খুব অনুরাগী ছিলেন। প্রাইভেট মাস্টারের মতো তিনি আমার পড়া বলিয়া দিতেন। সেকালের লেখা আমার বহু কবিতায় তাঁহার সংশোধনের ছাপ আছে।

সেবার দিদি শ্বশুরবাড়ি যাইবেন। পাবনা জেলার পলাশটিয়া গ্রামে দিদির শ্বশুরবাড়ি। দিদিকে আগাইয়া দিয়া আসিলাম। দিদি বারবার করিয়া বলিয়া দিলেন, “সাধু। তুমি অবশ্য আমাকে পত্র লিখিও।”

দিদি চলিয়া গেলে সমস্ত বাড়ি ভরিয়া যেন একটা বিষাদের ছায়া ঘনাইয়া আসিল। এই মেয়েটি সহজ স্নেহপ্রবণতায় বাড়ির সবগুলি লোককে আপন মমতায় আচ্ছন্ন করিয়া রাখিত।