০৯:৪৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৪৫)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:২৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১১ মার্চ ২০২৫
  • 21

সেজদি

বাড়ির ঠাকুর চাকর হইতে আরম্ভ করিয়া ভাই-বোন বাপ-মা এমনকি পাড়া-প্রতিবেশীরা পর্যন্ত এই মেয়েটিকে সবচাইতে আপনার বলিয়া ভাবিত। খাতা-কলম লইয়া দিদির কাছে পত্র লিখিতে আরম্ভ করিলাম। সেই পত্রে বালককালের উচ্ছ্বাসের সঙ্গে ভবিষ্যৎ-জীবনে আমি কি করিব কি করিয়া দেশের অসহায় দুস্থ লোকদের সামনে যাইয়া সেবার মূর্তি হইয়া দাঁড়াইব, এমনি বড় বড় কথা সুদীর্ঘ ত্রিশ পৃষ্ঠাব্যাপী পত্রে ভর্তি হইয়া উঠিল। আমার সেই পত্র পাইয়া দিদি মাত্র এক পৃষ্ঠার একটি ক্ষুদ্র পত্র লিখিলেন। যে-দিদিকে ছাড়িয়া এমন অভাব বোধ করিতেছি, দিদি যে আমার জন্যও তেমন করিতেছেন এমন কোনো কথার আভাসই সেই পত্রে পাইলাম না। ইহাতে মনে মনে কিছু অভিমান হইলেও দিদিকে মনে মনেই ক্ষমা করিলাম। হয়তো শ্বশুরবাড়িতে দিদির খুব কাজ। বড় করিয়া পত্র লিখিতে অবসর পান নাই। ইহার পরে হয়তো আমাকে আরও বড় পত্র লিখিবেন।

প্রায় তিন-চার মাস পরে সেজদি শ্বশুরবাড়ি হইতে ফিরিবেন। খবর পাইয়া শ্রীশবাবু তাঁকে আগাইয়া আনিতে আমাকে গোয়ালন্দ পাঠাইলেন। খুবই খুশির সঙ্গে গোয়ালন্দ রওয়ানা হইলাম। পদ্মা নদী দিয়া আমাদের স্টিমার চলিল। দুই পাশে বালুচরে কাশফুল ফুটিয়াছে।

সন্ধ্যা-মেঘের মতো রঙিন হইয়া উঠিয়াছে চরের সদ্য-ফোটা ফুলভারে নত ঝাউগাছগুলি। আমার সেজদির গায়ের বর্ণই যেন ছড়াইয়া পড়িয়াছে সেই ঝাউগাছগুলিতে। কতকাল পরে আবার সেজদিকে দেখিব। আমার সেজদি আমার সোনার সেজদি। কত গ্রাম-বন্দর-নদী-নালা ছাড়াইয়া জাহাজ ছুটিয়া চলিয়াছে। তবু আমার মন বলে, আরও যদি একটু জোরে জাহাজ চলিত-পাখির মতো যদি আকাশে ডানা মেলিয়া উড়িয়া যাইতে পারিত, তবেই যেন মনের আশা মিটিত। আরও কিছু আগে যাইয়া দিদিকে দেখিতে পাইতাম।

গোয়ালন্দে আসিয়া শুনিলাম এক ঘণ্টা পরে কালিগঞ্জের স্টিমার আসিবে। কালিগঞ্জের ঘাটে যাইয়া দাঁড়াইয়া রহিলাম। স্টিমার আসিয়া ঘাটে ভিড়িল। দলে দলে লোক নামিয়া গেল। তাহাদের মধ্যে আমার সেজদিকে দেখিতে পাইলাম না। স্টিমারের লোকগুলি যেন আমার বুকের উপর দিয়া হাঁটিয়া যাইতে প্রত্যেকের পদাঘাতে একটি একটি করিয়া নিরাশার আঘাত হানিয়া গেল। শেষ লোকটি যখন স্টিমার হইতে নামিয়া গেল তখন অতি বড় একটি দীর্ঘনিশ্বাস আমার বুক হইতে বাহির হইল।

সারারাত্র রাজবাড়িতে মশার কামড় সহ্য করিয়া পরদিন ফরিদপুরে শ্রীশবাবুর বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম। মরি মরি। সেজদি দরজার সামনে দাঁড়াইয়া হাসিমুখে আমাকে সম্ভাষণ করিলেন। ভিড়ের মধ্যে আমি সেজদিকে দেখিতে পাই নাই। রাত্রের গাড়িতেই তাঁহারা আসিয়া পৌঁছিয়াছেন।

এতদিন শ্বশুরবাড়িতে থাকিয়া সেজদির চেহারা আরও সুন্দর হইয়াছে। বাড়ির সবাই আজ সেজদিকে ঘিরিয়া বসিয়া আছেন তাঁর শ্বশুরবাড়ির কথা শুনিতে। মা যে এত কথা বলেন তিনিও আজ মনোযোগী শ্রোতা। সেজদি একে একে তাঁর শ্বশুরবাড়ির কাহিনী বলিতে লাগিলেন। তাঁর ভাশুরদের কথা, দেবরদের কথা, ঠাকুরঝিদের কথা। কি আর এমন শুনিবার আছে তাহার মধ্যে। কিন্তু সেজদির মুখে তাহারা যেন সুন্দর হইয়া রূপ পাইয়াছে। শ্রোতারা এক নিশ্বাসে সব শুনিতেছে, একটি সুখী পরিবারের কাহিনী। এই গৃহের মেয়েটি যেন তাঁর সুখী বধূ-জীবনের সঙ্গে সেই কাহিনীকে তাঁহার স্নেহ-মমতায় গাঁথিয়া আনিয়াছেন।

পলাশটিয়া গ্রামের সেই ঘোষাল-বাড়ি। সেখানে বারো মাসে তেরো পার্বণ। অসময়ে অতিথি আসিলে বাড়ির মেয়েরা না খাইয়া অতিথিকে খাওয়ায়। ঘাটলায় স্নান করিতে যাইয়া পাড়ার সমবয়সী বন্ধুদের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করে। পলাশটিয়া গ্রামের ছেলেরা মাঝে মাঝে থিয়েটার করে। সেই থিয়েটারের গান:

“ভাঙা ঘরে মন টেকে না করি কি, করি কি?”

এই গানটি সেজদির মুখে এমন শোনাইল সেদিন।

 

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৪৫)

১১:০০:২৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১১ মার্চ ২০২৫

সেজদি

বাড়ির ঠাকুর চাকর হইতে আরম্ভ করিয়া ভাই-বোন বাপ-মা এমনকি পাড়া-প্রতিবেশীরা পর্যন্ত এই মেয়েটিকে সবচাইতে আপনার বলিয়া ভাবিত। খাতা-কলম লইয়া দিদির কাছে পত্র লিখিতে আরম্ভ করিলাম। সেই পত্রে বালককালের উচ্ছ্বাসের সঙ্গে ভবিষ্যৎ-জীবনে আমি কি করিব কি করিয়া দেশের অসহায় দুস্থ লোকদের সামনে যাইয়া সেবার মূর্তি হইয়া দাঁড়াইব, এমনি বড় বড় কথা সুদীর্ঘ ত্রিশ পৃষ্ঠাব্যাপী পত্রে ভর্তি হইয়া উঠিল। আমার সেই পত্র পাইয়া দিদি মাত্র এক পৃষ্ঠার একটি ক্ষুদ্র পত্র লিখিলেন। যে-দিদিকে ছাড়িয়া এমন অভাব বোধ করিতেছি, দিদি যে আমার জন্যও তেমন করিতেছেন এমন কোনো কথার আভাসই সেই পত্রে পাইলাম না। ইহাতে মনে মনে কিছু অভিমান হইলেও দিদিকে মনে মনেই ক্ষমা করিলাম। হয়তো শ্বশুরবাড়িতে দিদির খুব কাজ। বড় করিয়া পত্র লিখিতে অবসর পান নাই। ইহার পরে হয়তো আমাকে আরও বড় পত্র লিখিবেন।

প্রায় তিন-চার মাস পরে সেজদি শ্বশুরবাড়ি হইতে ফিরিবেন। খবর পাইয়া শ্রীশবাবু তাঁকে আগাইয়া আনিতে আমাকে গোয়ালন্দ পাঠাইলেন। খুবই খুশির সঙ্গে গোয়ালন্দ রওয়ানা হইলাম। পদ্মা নদী দিয়া আমাদের স্টিমার চলিল। দুই পাশে বালুচরে কাশফুল ফুটিয়াছে।

সন্ধ্যা-মেঘের মতো রঙিন হইয়া উঠিয়াছে চরের সদ্য-ফোটা ফুলভারে নত ঝাউগাছগুলি। আমার সেজদির গায়ের বর্ণই যেন ছড়াইয়া পড়িয়াছে সেই ঝাউগাছগুলিতে। কতকাল পরে আবার সেজদিকে দেখিব। আমার সেজদি আমার সোনার সেজদি। কত গ্রাম-বন্দর-নদী-নালা ছাড়াইয়া জাহাজ ছুটিয়া চলিয়াছে। তবু আমার মন বলে, আরও যদি একটু জোরে জাহাজ চলিত-পাখির মতো যদি আকাশে ডানা মেলিয়া উড়িয়া যাইতে পারিত, তবেই যেন মনের আশা মিটিত। আরও কিছু আগে যাইয়া দিদিকে দেখিতে পাইতাম।

গোয়ালন্দে আসিয়া শুনিলাম এক ঘণ্টা পরে কালিগঞ্জের স্টিমার আসিবে। কালিগঞ্জের ঘাটে যাইয়া দাঁড়াইয়া রহিলাম। স্টিমার আসিয়া ঘাটে ভিড়িল। দলে দলে লোক নামিয়া গেল। তাহাদের মধ্যে আমার সেজদিকে দেখিতে পাইলাম না। স্টিমারের লোকগুলি যেন আমার বুকের উপর দিয়া হাঁটিয়া যাইতে প্রত্যেকের পদাঘাতে একটি একটি করিয়া নিরাশার আঘাত হানিয়া গেল। শেষ লোকটি যখন স্টিমার হইতে নামিয়া গেল তখন অতি বড় একটি দীর্ঘনিশ্বাস আমার বুক হইতে বাহির হইল।

সারারাত্র রাজবাড়িতে মশার কামড় সহ্য করিয়া পরদিন ফরিদপুরে শ্রীশবাবুর বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম। মরি মরি। সেজদি দরজার সামনে দাঁড়াইয়া হাসিমুখে আমাকে সম্ভাষণ করিলেন। ভিড়ের মধ্যে আমি সেজদিকে দেখিতে পাই নাই। রাত্রের গাড়িতেই তাঁহারা আসিয়া পৌঁছিয়াছেন।

এতদিন শ্বশুরবাড়িতে থাকিয়া সেজদির চেহারা আরও সুন্দর হইয়াছে। বাড়ির সবাই আজ সেজদিকে ঘিরিয়া বসিয়া আছেন তাঁর শ্বশুরবাড়ির কথা শুনিতে। মা যে এত কথা বলেন তিনিও আজ মনোযোগী শ্রোতা। সেজদি একে একে তাঁর শ্বশুরবাড়ির কাহিনী বলিতে লাগিলেন। তাঁর ভাশুরদের কথা, দেবরদের কথা, ঠাকুরঝিদের কথা। কি আর এমন শুনিবার আছে তাহার মধ্যে। কিন্তু সেজদির মুখে তাহারা যেন সুন্দর হইয়া রূপ পাইয়াছে। শ্রোতারা এক নিশ্বাসে সব শুনিতেছে, একটি সুখী পরিবারের কাহিনী। এই গৃহের মেয়েটি যেন তাঁর সুখী বধূ-জীবনের সঙ্গে সেই কাহিনীকে তাঁহার স্নেহ-মমতায় গাঁথিয়া আনিয়াছেন।

পলাশটিয়া গ্রামের সেই ঘোষাল-বাড়ি। সেখানে বারো মাসে তেরো পার্বণ। অসময়ে অতিথি আসিলে বাড়ির মেয়েরা না খাইয়া অতিথিকে খাওয়ায়। ঘাটলায় স্নান করিতে যাইয়া পাড়ার সমবয়সী বন্ধুদের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করে। পলাশটিয়া গ্রামের ছেলেরা মাঝে মাঝে থিয়েটার করে। সেই থিয়েটারের গান:

“ভাঙা ঘরে মন টেকে না করি কি, করি কি?”

এই গানটি সেজদির মুখে এমন শোনাইল সেদিন।