সারাক্ষণ রিপোর্ট
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে দেশীয় উৎস থেকে সরকারের ঋণ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। মূল কারণ হিসেবে বিদ্যুৎ ও সার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের বকেয়া বিল মেটানোর জন্য বিশেষ বন্ড ইস্যু, ট্রেজারি বিল (টি-বিল) ছাড়, এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে সরকারি সিকিউরিটি বিক্রিকে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
ঋণের সামগ্রিক অবস্থা
- বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন জানাচ্ছে, এ বছরের প্রথম ছয় মাসে স্থানীয় উৎস থেকে সরকারের নিট ঋণগ্রহণ প্রায় ৩১,৪৩২ কোটি টাকা ছুঁয়েছে; যা আগের বছরের একই সময়ে মাত্র ৪৫৬ কোটি টাকা ছিল। এ হিসেবে প্রায় ৬৯ গুণ বৃদ্ধি।
- এই ঋণ চলতি অর্থবছরের মোট দেশীয় ঋণের লক্ষ্য (১,১৭,০০০ কোটি টাকা)-এর প্রায় ২৭ শতাংশ।
- বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, আগের অর্থবছরের কিছু ঋণ পরিশোধের পরও সরকারি সিকিউরিটির বিক্রি অনেক বেড়েছে, যার ফলে ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণ ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে।
ব্যাংকিং খাতের মাধ্যমে ঋণগ্রহণ
- ব্যাংক খাত থেকে সরকারের নিট ঋণ পৌঁছেছে ৬,৭৪৪ কোটি টাকায়, যা এই খাত থেকে সরকারের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার (৯৯,০০০ কোটি টাকা) প্রায় ৬.৮ শতাংশ।
- বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নতুন করে কোনো ঋণ না নিয়ে বরং সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ৫৮,১১৬ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে।
- অন্যদিকে, তফসিলি ব্যাংক থেকে ৬৪,১৮৬.১ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার, যার ফলে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সরকারের মোট ঋণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।
- অর্থনীতিবিদদের মতে, এ ধরনের ঋণগ্রহণ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে পারে, কারণ গত বছরের মার্চ থেকে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরেই রয়েছে।
অব্যাংকিং উৎস থেকে ঋণ
- ব্যাংকের বাইরে থাকা খাত থেকেও সরকার উল্লেখযোগ্য হারে ঋণ নিচ্ছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে নিট ঋণ ২৪,৬৮৮.২ কোটি টাকায় পৌঁছেছে, যেখানে আগের বছরে একই সময়ে ছিল ৭,০৮৯ কোটি টাকা।
- বিদ্যুৎ ও সার বাবদ বকেয়া পরিশোধে সরকার বিশেষ বন্ড ইস্যু করে ১২,৫৪২ কোটি টাকা পরিশোধ করে, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৩৬,৫৮৬ কোটি টাকা।
সঞ্চয়পত্র ও বিশেষ বন্ডের ভূমিকা
- সাধারণত অব্যাংকিং উৎস থেকে সরকার সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ কমে যাওয়ায় বিক্রির তুলনায় পরিশোধ বেশি হচ্ছে, ফলে নিট ঋণগ্রহণ একাধিকবার ঋণাত্মক হয়েছে।
- চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে সঞ্চয়পত্র থেকে নিট ঋণ দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ২,২৪৪ কোটি টাকা, যেখানে আগের বছরের একই সময়ে এটি ছিল ঋণাত্মক ৬,০৬৩ কোটি টাকা।
- সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কমলেও বিশেষ বন্ড ইস্যু এবং সরকারি সিকিউরিটি বিক্রি বাড়ায় সরকারের অন্যান্য উৎস থেকে ঋণগ্রহণ বেড়েছে।
ট্রেজারি বিল ও ট্রেজারি বন্ডের গুরুত্ব
- সরকারি ঋণ ব্যবস্থায় ট্রেজারি বিল ও ট্রেজারি বন্ডের গুরুত্ব ক্রমাগত বাড়ছে। বিমা কোম্পানি থেকে শুরু করে সাধারণ বিনিয়োগকারী—সবাই এগুলোর প্রতি আগ্রহী।
- অব্যাংকিং খাতে বিশেষ বন্ড ও সরকারি সিকিউরিটির বিক্রির মাধ্যমে সরকার দ্রুত নগদ অর্থের ঘাটতি মেটাচ্ছে এবং একই সঙ্গে নিরাপদ বিনিয়োগের সুযোগ করে দিয়ে জনগণের আস্থা অর্জন করছে।
ঋণ বৃদ্ধির মূল কারণ
- কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তার মতে, অব্যাংকিং উৎস থেকে সরকারি সিকিউরিটিতে মানুষের বিনিয়োগের প্রবণতা বাড়ছে, যা সরকারের ঋণগ্রহণকে ত্বরান্বিত করেছে।
- নিরাপদ ও স্থিতিশীল বিনিয়োগের আকর্ষণ ছাড়াও সরকারের কিছু নীতিগত পদক্ষেপ মানুষকে এদিকে আগ্রহী করেছে।
উপসংহার
অব্যাংকিং উৎস থেকে সরকারের ঋণ বৃদ্ধির ফলে দেশীয় ঋণ কাঠামোতে বড় রকমের পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরাসরি ঋণ না নিয়ে তফসিলি ব্যাংক এবং অব্যাংকিং খাতের ওপর নির্ভরশীল হওয়া, বিশেষ বন্ড ইস্যু, ও সরকারি সিকিউরিটি বিক্রি—এসবই সরকারের আর্থিক চাহিদা পূরণের নতুন দিক উন্মোচন করেছে। পাশাপাশি, চলমান উচ্চমূল্যস্ফীতির সময়ে এই ঋণনীতি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে পারে বলে অভিমত ব্যক্ত করা হচ্ছে।