সেবা-সমিতির সভ্য হিসাবে
রোগীর সেবা করিতে যাইয়া কত বিচিত্র রকমের লোকের সঙ্গেই না আমার পরিচয় হইয়াছে। ফরিদপুরের প্রসিদ্ধ উকিল মথুরবাবুর মেয়ের নিউমোনিয়া। জামাতা ভোলানাথবাবু আমার শিক্ষক। বড় ভালো পড়াইতেন। আমাকে তিনি বিশেষ করিয়া স্নেহ করিতেন। যে-বাড়িতে তিনি থাকিতেন সেখানে গেলাম রোগিণীর সেবা করিতে। মাস্টার মহাশয় তখন ছিলেন না। বাড়ির কেহ আমাকে চেনেনও না। আমি রোগিণীর সেবা করিতে আসিয়াছি শুনিয়া তাঁহারা যেন হাতে স্বর্গ পাইলেন। এতদিন রাত-জাগিয়া তাঁহারা শ্রান্ত-ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছেন। আমার দক্ষ-হাতে রোগীর পরিচর্যা দেখিয়া তাঁহারা সকলেই আমার দিকে প্রশংসাপূর্ণ দৃষ্টি মেলিলেন। একজন তো বলিয়াই ফেলিলেন, ‘আপনি আসাতে আমরা বাঁচিয়া গেলাম। রোগিণীর পাশে রাত্র জাগিবার আজ কেহ নাই।” প্রায় ঘণ্টাখানেক চলিয়া গেল।
আমি বসিয়া বসিয়া রোগিণীর মাথায় জলপট্টি দিতেছি। অডিকলন লইয়া পানিতে মিশাইয়া সুদক্ষ-হাতে সেই পানিতে ন্যাকড়া ভিজাইয়া রোগিণীর কপাল মুছাইয়া দিতেছি। এমন সময় বাড়ির লোকেরা সকলে একত্রিত হইয়া কিছুক্ষণ কি যেন পরামর্শ করিলেন। আমি দূর হইতে কেবলমাত্র ‘মুসলমান’ শব্দটি শুনিতে পাইলাম। কিছুক্ষণ পরে যে-ভদ্রলোকটি আমাকে বলিয়াছিলেন, আজ রাত্রে রোগিণীর পাশে রাত্র জাগিবার লোক নাই, তিনি আমাকে অদূরে ডাকিয়া লইয়া বলিলেন, “আমাদের বাড়িতে রোগিণীর সেবা করিবার যথেষ্ট লোক আছে। আপনার থাকার কোনো প্রয়োজন নাই।” আমি সবই বুঝিতে পারিলাম। নিতান্ত অপরাধীর মতোই আমি সেখান হইতে চলিয়া আসিলাম।
এইবার প্রতিজ্ঞা করিলাম, বড়লোকদের বাড়িতে না ডাকিলে আর সেবা করিতে যাইব না। কত গরিব লোক বিনা চিকিৎসায় মরিতেছে। এবার হইতে তাহাদের সেবা করিব।
অম্বিকাপুর স্টেশনে নতুন স্টেশন-মাস্টার আসিলেন বাবু উমাকান্ত ঘোষাল। নিজের কোনো সন্তান-সন্ততি নাই। স্ত্রী শুচিবাইগ্রস্তা। দিনের মধ্যে অন্তত ত্রিশবার স্নান করিতেন। অফিসের কাজ সারিয়া মাস্টারবাবুকে জামাকাপড় বদলাইয়া ঘরে ঢুকিতে হইত। এই ভদ্রলোক আমাকে বড়ই ভালোবাসিতেন। তিনি আমাকে আমার সেবাকার্যের জন্য উৎসাহ দিতেন। কোনো গরিব লোকের ঔষধপত্র কেনার জন্য টাকা চাহিলে বিনা প্রশ্নে তিনি আমাকে টাকা দিতেন। তিনি সেবাকার্যের জন্য আমাকে একটি ডুস ও একটি থার্মোমিটার কিনিয়া দিয়াছিলেন। সেবার তাঁরই রেলস্টেশনের পয়েন্টম্যানের স্ত্রীর কলেরা হইল। স্বামী আমাকে ডাকিয়া লইয়া গেল তাহার সেবা করিতে। সদ্য বিবাহ করিয়া সে নতুন সংসার পাতিয়াছিল।
বউয়ের হাতের পায়ের মেহেদির দাগ এখনও মোছে নাই। স্বামী বেচারা বউয়ের জন্য প্রাণপণ করিতেছে। কিন্তু একা মানুষ। কত দিক সামলাইবে? তাহারা বিহার দেশের মানুষ। বহুদিন বাংলাদেশে থাকিয়া বেশ বাংলা শিখিয়াছে। শাশুড়ি থাকে গোয়ালন্দ। অসুখের সময় শাশুড়িকে আনিতে গিয়াছিল। কিন্তু আত্মীয়স্বজনেরা শাশুড়িকে আসিতে দিল না। বিবাহের এক বৎসরের মধ্যে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি যাওয়া মায়ের পক্ষে নিষেধ। কে এই নিষেধবাণী প্রথম প্রচার করিয়াছিল জানি না। হয়তো কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে এই নিষেধবাণীর প্রয়োজন ছিল। কিন্তু কোন নিষ্ঠুর সূত্র ধরিয়া সেই নিষেধবাণী এই মৃত্যুপথযাত্রী মেয়ের শয্যাশিয়রে তার মমতাময়ী মাকে আসিতে আজ বাধা প্রদান করিল। অসুখের ঘোরে বউটি বারবার বলিতেছে, “আমার মাকে আনিয়া দাও।
মা না আসিলে আমি বাঁচিব না।” স্বামী মিথ্যা প্রবোধ দিতেছে, “সামনের গাড়িতেই মা আসিবেন। তুমি চুপ করিয়া থাক।” কিন্তু কত গাড়ি আসিল, কত গাড়ি চলিয়া গেল। মেয়েটির মা আর আসিল না। সেই মা হয়তো এই রোগগ্রস্তা বধুটির মতোই ঘরে বসিয়া মেয়ের জন্য কাঁদিয়া সারা হইতেছে। কে আমাদের সমাজ হইতে এই হৃদয়হীন কুসংস্কার দূর করিবে?
বউটিকে আমি দুই-তিন রাত সেবা করিলাম। ডাক্তারের নির্দেশমতো পার-রেকটাল ফোঁটায় ফোঁটায় ঈষৎ উষ্ণ সেলাইন-পানি রোগিণীর দেহে প্রবেশ করাইলাম। পায়খানা বমি পরিষ্কার করিয়া দিতে লাগিলাম। রাত্রে আমি থাকিতাম বলিয়া স্বামীকে ঘুমাইতে দিতাম। সে দিনে রোগিণীর দেখাশুনা করিত।
চলবে…..
Sarakhon Report 



















