০৫:২৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৫৮)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:১৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২ এপ্রিল ২০২৫
  • 20

সুবোধ ডাক্তার

সাত-আট দিন পরে শ্রান্ত-ক্লান্ত, অনিদ্রায় অবসন্ন অবস্থায় ডাক্তারবাবু গৃহে ফিরিতেন। ডাক্তার-গৃহিণী পাখার বাতাস করিতে করিতে জিজ্ঞাসা করিতেন, “এতদিন কোথায় ছিলে?”

ডাক্তারবাবু বলিতেন, “প্রথমে তো গেলাম রঘুয়া পাড়া মাতবরবাড়ি। রোগী এখন-তখন।

সারারাত সেবা-শুশ্রূষা করিয়া রোগীকে কিছুটা চাঙ্গা করিয়া আনিলাম, এমন সময় কল আসিল ভাটপাড়া গ্রাম হইতে। ছোট্ট মেয়েটির নিউমোনিয়া হইয়াছে। আহা। দেখিতে যেন হলদে পাখির বাচ্চাটি। তাকে ঔষধ-পত্র দিয়া কিছুটা নিরাময় করিয়াছি, এমন সময় খবর আসিল বউঘাটায় কার ছেলেকে সাপে কাটিয়াছে। গেলাম সেখানে। এমনি করিয়া দেরি হইয়া গেল।”

গৃহিণী বলিলেন, “টাকা-পয়সা কি আনিয়াছ? ঘরে তো চাল বাড়ন্ত।”

ডাক্তার মুখ কাঁচুমাচু করিয়া বলিলেন, “এবার বেশ টাকা পাইয়াছিলাম। রঘুয়া পাড়ার মাতবর দুই শত টাকা দিয়াছিল।”

গৃহিণী জিজ্ঞাসা করিলেন, “তবে যে তোমার ব্যাগে মাত্র দশটি টাকা দেখিলাম।”

ডাক্তার বলিলেন, “ভাটপাড়ার মেয়েটির জন্য যে ঔষধের দাম দিতে হইল। ওরা এত গরিব যে ঔষধের টাকা না দিলে মেয়েটির চিকিৎসাই হইত না। পথের মধ্যে একটি গরিব ছেলে পরীক্ষা দেওয়ার ফিস চাহিল। আর বল তো সাপে-কাটা রোগীর কাছ হইতে কি টাকা লইতে পারি? আমি তাদের আরও কিছু দিয়া আসিলাম।”

গৃহিণী আর কিছুই বলিলেন না। এরূপ ঘন ঘন ডাক্তারবাবুকে অদৃশ্য হইতে দেখিয়া পরে আর তিনি নিখোঁজ হইলে কেহ বড় একটা খোঁজ-খবর লইতেন না।

এই ডাক্তারবাবুর সঙ্গে আমার সহজেই পরিচয় হইয়া গেল। একবার খবর পাইলাম, কেদারীর মার বোন নদীর ওপারের চরে অসুস্থ হইয়া পড়িয়া আছে। সুবোধবাবুকে বলিতেই তিনি আমার সঙ্গে নদীর ওপারে সেই বৃদ্ধাকে দেখিতে গেলেন। যাইয়া দেখিলাম, সাত-আটদিন আগে এই বৃদ্ধাকে একটি ষাঁড়ে গুঁতা দিয়া তাহার গুপ্তস্থান ছিঁড়িয়া দিয়াছে।

সেই ক্ষতস্থান পচিয়া এমন দুর্গন্ধ হইয়াছে যে কাছে যাওয়া যায় না। রাশি রাশি মাছি বুড়িকে ঘিরিয়া আছে। এক গ্লাস পানি দেওয়ারও লোক নাই। ডাক্তারবাবু তাঁহার ব্যাগ হইতে ঔষধ বাহির করিয়া গরম পানিতে সেই ক্ষতস্থান ধুয়াইয়া দিলেন। তারপর একটি ইনজেকশন দিলেন। ইনজেকশন দেওয়ার সময় ইহার সমস্ত কায়দা-কানুন আমাকে শিখাইতে লাগিলেন।

“রোগীর কাঁধের নিচে হাতের ডানার শেষ দিকটার উপরে বিশেষ কোনো রক্তনালি নাই। এখানে ইনজেকশনের সুই ফুঁড়িতে কোনো বিপদের আশঙ্কা নাই। তুমি এইভাবে শিরিঞ্জ ধরিয়া সুইয়ের কিছুটা দাবাইয়া দিবে। তারপর ধীরে ধীরে ঔষধ টিপিয়া দিবে। ইহার আগে শিরিজে ঔষধ ভরিয়া বেশি করিয়া সামনের দিকে টিপিয়া দিবে, যেন বাতাস না থাকে। ঔষধ ভরিবার আগে শিরিঞ্জটি গরম পানিতে ফুটাইয়া লইও। নিজের হাত দুইখানিও ভালোমতো কার্বলিক সাবানে পরিষ্কার করিও। আমি রোজ আসিয়া এই রোগীকে দেখিতে পারিব না। কাল হইতে তুমিই ইহাকে ইনজেকশন দিবে।”

 

চলবে…..

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৫৮)

১১:০০:১৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২ এপ্রিল ২০২৫

সুবোধ ডাক্তার

সাত-আট দিন পরে শ্রান্ত-ক্লান্ত, অনিদ্রায় অবসন্ন অবস্থায় ডাক্তারবাবু গৃহে ফিরিতেন। ডাক্তার-গৃহিণী পাখার বাতাস করিতে করিতে জিজ্ঞাসা করিতেন, “এতদিন কোথায় ছিলে?”

ডাক্তারবাবু বলিতেন, “প্রথমে তো গেলাম রঘুয়া পাড়া মাতবরবাড়ি। রোগী এখন-তখন।

সারারাত সেবা-শুশ্রূষা করিয়া রোগীকে কিছুটা চাঙ্গা করিয়া আনিলাম, এমন সময় কল আসিল ভাটপাড়া গ্রাম হইতে। ছোট্ট মেয়েটির নিউমোনিয়া হইয়াছে। আহা। দেখিতে যেন হলদে পাখির বাচ্চাটি। তাকে ঔষধ-পত্র দিয়া কিছুটা নিরাময় করিয়াছি, এমন সময় খবর আসিল বউঘাটায় কার ছেলেকে সাপে কাটিয়াছে। গেলাম সেখানে। এমনি করিয়া দেরি হইয়া গেল।”

গৃহিণী বলিলেন, “টাকা-পয়সা কি আনিয়াছ? ঘরে তো চাল বাড়ন্ত।”

ডাক্তার মুখ কাঁচুমাচু করিয়া বলিলেন, “এবার বেশ টাকা পাইয়াছিলাম। রঘুয়া পাড়ার মাতবর দুই শত টাকা দিয়াছিল।”

গৃহিণী জিজ্ঞাসা করিলেন, “তবে যে তোমার ব্যাগে মাত্র দশটি টাকা দেখিলাম।”

ডাক্তার বলিলেন, “ভাটপাড়ার মেয়েটির জন্য যে ঔষধের দাম দিতে হইল। ওরা এত গরিব যে ঔষধের টাকা না দিলে মেয়েটির চিকিৎসাই হইত না। পথের মধ্যে একটি গরিব ছেলে পরীক্ষা দেওয়ার ফিস চাহিল। আর বল তো সাপে-কাটা রোগীর কাছ হইতে কি টাকা লইতে পারি? আমি তাদের আরও কিছু দিয়া আসিলাম।”

গৃহিণী আর কিছুই বলিলেন না। এরূপ ঘন ঘন ডাক্তারবাবুকে অদৃশ্য হইতে দেখিয়া পরে আর তিনি নিখোঁজ হইলে কেহ বড় একটা খোঁজ-খবর লইতেন না।

এই ডাক্তারবাবুর সঙ্গে আমার সহজেই পরিচয় হইয়া গেল। একবার খবর পাইলাম, কেদারীর মার বোন নদীর ওপারের চরে অসুস্থ হইয়া পড়িয়া আছে। সুবোধবাবুকে বলিতেই তিনি আমার সঙ্গে নদীর ওপারে সেই বৃদ্ধাকে দেখিতে গেলেন। যাইয়া দেখিলাম, সাত-আটদিন আগে এই বৃদ্ধাকে একটি ষাঁড়ে গুঁতা দিয়া তাহার গুপ্তস্থান ছিঁড়িয়া দিয়াছে।

সেই ক্ষতস্থান পচিয়া এমন দুর্গন্ধ হইয়াছে যে কাছে যাওয়া যায় না। রাশি রাশি মাছি বুড়িকে ঘিরিয়া আছে। এক গ্লাস পানি দেওয়ারও লোক নাই। ডাক্তারবাবু তাঁহার ব্যাগ হইতে ঔষধ বাহির করিয়া গরম পানিতে সেই ক্ষতস্থান ধুয়াইয়া দিলেন। তারপর একটি ইনজেকশন দিলেন। ইনজেকশন দেওয়ার সময় ইহার সমস্ত কায়দা-কানুন আমাকে শিখাইতে লাগিলেন।

“রোগীর কাঁধের নিচে হাতের ডানার শেষ দিকটার উপরে বিশেষ কোনো রক্তনালি নাই। এখানে ইনজেকশনের সুই ফুঁড়িতে কোনো বিপদের আশঙ্কা নাই। তুমি এইভাবে শিরিঞ্জ ধরিয়া সুইয়ের কিছুটা দাবাইয়া দিবে। তারপর ধীরে ধীরে ঔষধ টিপিয়া দিবে। ইহার আগে শিরিজে ঔষধ ভরিয়া বেশি করিয়া সামনের দিকে টিপিয়া দিবে, যেন বাতাস না থাকে। ঔষধ ভরিবার আগে শিরিঞ্জটি গরম পানিতে ফুটাইয়া লইও। নিজের হাত দুইখানিও ভালোমতো কার্বলিক সাবানে পরিষ্কার করিও। আমি রোজ আসিয়া এই রোগীকে দেখিতে পারিব না। কাল হইতে তুমিই ইহাকে ইনজেকশন দিবে।”

 

চলবে…..