১১:৪৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩০ জুন ২০২৫

নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন: বাংলাদেশে ইফতার ঘিরে রাজনৈতিক দল গঠনের নতুন কৌশল

  • Sarakhon Report
  • ০২:০৭:২৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩ এপ্রিল ২০২৫
  • 28

সারাক্ষণ রিপোর্ট

রমজানে ঢাকার মতো ব্যস্ত ও যানজটে ভরা শহরের চেহারা বদলে যায়। সূর্যাস্তের সময় রাজধানীর রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যায়। তবে এই সময়টা রাজনীতিবিদদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ইফতার আয়োজনগুলো হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক যোগাযোগ ও জোট গঠনের প্রধান ক্ষেত্র।

গত বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের পর প্রথম রমজানেই নানা রাজনৈতিক সমীকরণের ইঙ্গিত মিলেছে এসব ইফতার আয়োজনে। কে কোন দলে যোগ দিল, কে কার পাশে বসেছিল — এসব ছোট ছোট ইঙ্গিত থেকেই বোঝা যাচ্ছে রাজনীতির নতুন পথচলা কোন দিকে যেতে পারে।

ইফতার আয়োজনে রাজনৈতিক উষ্ণতা

নানা দলের ইফতার আয়োজনে অংশগ্রহণ পর্যবেক্ষণ করে রাজনৈতিক বাতাসের গতি বোঝার চেষ্টা করেছেন সংশ্লিষ্টরা। নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদকরা আমন্ত্রিত হয়েছিলেন একটি এমনই ইফতার আয়োজনে, যেখানে রাজনীতির উত্তাপ ছিল স্পষ্ট।

এই ইফতার আয়োজন করেছিল ‘গণ-অধিকার পরিষদ’ — একটি ছোট রাজনৈতিক দল, যা ২০১৮ সালের ছাত্র আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় গড়ে ওঠে। দলটি ৬০০ জনের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিল, কিন্তু হাজির হয় ৯০০ জন। তেলে ভাজা নাস্তা ও মিষ্টি বিতরণ চলছিল, আর দইয়ের শরবত ছিল অবিরত।

তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল ভবনের ছাদে পৌঁছানো। আটতলা ভবনের একমাত্র লিফটের ধারণক্ষমতা ১৮ জন, আর সবাই একসঙ্গে ওপরে উঠতে চাচ্ছিল। লিফটের অপারেটর একজন শান্ত ভদ্রলোক, যিনি সাবধানে একে একে মানুষজনকে লিফটে তুলছিলেন যেন দোকানদার মেপে আঙুর তুলছেন।

ইফতার আয়োজনে রাজনীতির ইঙ্গিত

উপরের রেস্টুরেন্টে ছিল ঠাসা ভিড়। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের জন্য আলাদা টেবিল বরাদ্দ ছিল। বেশিরভাগ অংশগ্রহণকারী ছিলেন পুরুষ, তবে কিছু সংখ্যক নারীও ছিলেন।

গণ-অধিকার পরিষদের যুব শাখার নেত্রী সঙ্গীতা হক জানালেন, রমজানের প্রথম দুই সপ্তাহেই তিনি পাঁচটি ইফতার পার্টিতে অংশ নিয়েছেন। তিনি বলেন, “আমাদের দলের প্রতিটি শাখারই আলাদা ইফতার আয়োজন আছে — যুব শাখা, শ্রম শাখা, মানবাধিকার শাখা।”

মঞ্চ থেকে একের পর এক বক্তৃতা হচ্ছিল, যার লক্ষ্য ছিল মূলত উপস্থিত গণমাধ্যম। মূল বার্তাটি ছিল, বাংলাদেশে একটি নির্বাচনের প্রয়োজন। কেউ চাইছে তা দ্রুত হোক, কেউ আগে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের দাবি জানাচ্ছে যাতে অতীতের মতো কারচুপির পুনরাবৃত্তি না হয়।

সামরিক বাহিনী ও ছাত্র সরকারে টানাপোড়েন

ইফতার পার্টিগুলোতে আলোচনার অন্যতম বড় বিষয় ছিল সামরিক বাহিনী ও ছাত্র-নির্ভর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা।

ছাত্ররা সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানকে নিয়ে সন্দিহান। অনেকে মনে করেন, শেখ হাসিনার আত্মীয় হওয়ায় তিনি হয়তো আওয়ামী লীগের পুনরুত্থানে ভূমিকা রাখতে চাইছেন।

আবার অন্য একটি গুঞ্জন হচ্ছে, সেনাপ্রধান হয়তো বিএনপির সঙ্গে গোপন চুক্তি করে দ্রুত নির্বাচন চাচ্ছেন। অপরদিকে, বিএনপি নেতাদের ধারণা ছাত্ররা নিজেরাই রাজনীতিতে সংগঠিত হওয়ার জন্য সময় কেনার উদ্দেশ্যে নির্বাচন পেছাতে চায়।

ভারতের অবস্থান ও কূটনৈতিক সরবতা

ভারতের অবস্থানও এই আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দীর্ঘদিন ধরে শেখ হাসিনার প্রতি ভারতের সমর্থন থাকলেও, এবার তার পতনের জন্য তারা বিএনপি ও জামায়াত-ই-ইসলামীর মধ্যে চক্রান্তকে দায়ী করছে। তবে এবার ভারতের কূটনীতিকরা দুই দলের ইফতার আয়োজনেই উপস্থিত ছিলেন — যা পাল্টে যাওয়া সময়ের ইঙ্গিত।

জামায়াতের মহাসচিব মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, “খুব ব্যস্ত সময়।” তিনি জানান, তাদের আয়োজনে ৩৯টি কূটনৈতিক মিশনের প্রতিনিধিত্ব ছিল।

বিএনপির ইফতারে আবেগঘন মুহূর্ত

গণ-অধিকার পরিষদের ছাদে ইফতারের কাছাকাছি সময়ে, কাছেই একটি স্কুল মাঠে তাবুতে স্থানীয় বিএনপি শাখাও আয়োজন করেছিল ইফতার পার্টি। গোল টেবিলে লোকজন বসেছিলেন, ট্রাক থেকে বিরিয়ানি বক্স ও কোমল পানীয় নামানো হচ্ছিল।

মুখ্য সড়কে মাইকিং করে অতিথিদের নাম ঘোষণা হচ্ছিল। ফুল দিয়ে সাজানো মঞ্চে স্থানীয় বিএনপি নেতা আরিফুল ইসলাম আরিফ যখন বক্তব্য রাখতে উঠলেন, তখন তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।

তিনি বলেন, “আমি সাত বছর পর এখানে আসতে পেরেছি, কারণ আমি এতদিন জেলে ছিলাম।”

নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন: বাংলাদেশে ইফতার ঘিরে রাজনৈতিক দল গঠনের নতুন কৌশল

০২:০৭:২৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩ এপ্রিল ২০২৫

সারাক্ষণ রিপোর্ট

রমজানে ঢাকার মতো ব্যস্ত ও যানজটে ভরা শহরের চেহারা বদলে যায়। সূর্যাস্তের সময় রাজধানীর রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যায়। তবে এই সময়টা রাজনীতিবিদদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ইফতার আয়োজনগুলো হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক যোগাযোগ ও জোট গঠনের প্রধান ক্ষেত্র।

গত বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের পর প্রথম রমজানেই নানা রাজনৈতিক সমীকরণের ইঙ্গিত মিলেছে এসব ইফতার আয়োজনে। কে কোন দলে যোগ দিল, কে কার পাশে বসেছিল — এসব ছোট ছোট ইঙ্গিত থেকেই বোঝা যাচ্ছে রাজনীতির নতুন পথচলা কোন দিকে যেতে পারে।

ইফতার আয়োজনে রাজনৈতিক উষ্ণতা

নানা দলের ইফতার আয়োজনে অংশগ্রহণ পর্যবেক্ষণ করে রাজনৈতিক বাতাসের গতি বোঝার চেষ্টা করেছেন সংশ্লিষ্টরা। নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদকরা আমন্ত্রিত হয়েছিলেন একটি এমনই ইফতার আয়োজনে, যেখানে রাজনীতির উত্তাপ ছিল স্পষ্ট।

এই ইফতার আয়োজন করেছিল ‘গণ-অধিকার পরিষদ’ — একটি ছোট রাজনৈতিক দল, যা ২০১৮ সালের ছাত্র আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় গড়ে ওঠে। দলটি ৬০০ জনের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিল, কিন্তু হাজির হয় ৯০০ জন। তেলে ভাজা নাস্তা ও মিষ্টি বিতরণ চলছিল, আর দইয়ের শরবত ছিল অবিরত।

তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল ভবনের ছাদে পৌঁছানো। আটতলা ভবনের একমাত্র লিফটের ধারণক্ষমতা ১৮ জন, আর সবাই একসঙ্গে ওপরে উঠতে চাচ্ছিল। লিফটের অপারেটর একজন শান্ত ভদ্রলোক, যিনি সাবধানে একে একে মানুষজনকে লিফটে তুলছিলেন যেন দোকানদার মেপে আঙুর তুলছেন।

ইফতার আয়োজনে রাজনীতির ইঙ্গিত

উপরের রেস্টুরেন্টে ছিল ঠাসা ভিড়। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের জন্য আলাদা টেবিল বরাদ্দ ছিল। বেশিরভাগ অংশগ্রহণকারী ছিলেন পুরুষ, তবে কিছু সংখ্যক নারীও ছিলেন।

গণ-অধিকার পরিষদের যুব শাখার নেত্রী সঙ্গীতা হক জানালেন, রমজানের প্রথম দুই সপ্তাহেই তিনি পাঁচটি ইফতার পার্টিতে অংশ নিয়েছেন। তিনি বলেন, “আমাদের দলের প্রতিটি শাখারই আলাদা ইফতার আয়োজন আছে — যুব শাখা, শ্রম শাখা, মানবাধিকার শাখা।”

মঞ্চ থেকে একের পর এক বক্তৃতা হচ্ছিল, যার লক্ষ্য ছিল মূলত উপস্থিত গণমাধ্যম। মূল বার্তাটি ছিল, বাংলাদেশে একটি নির্বাচনের প্রয়োজন। কেউ চাইছে তা দ্রুত হোক, কেউ আগে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের দাবি জানাচ্ছে যাতে অতীতের মতো কারচুপির পুনরাবৃত্তি না হয়।

সামরিক বাহিনী ও ছাত্র সরকারে টানাপোড়েন

ইফতার পার্টিগুলোতে আলোচনার অন্যতম বড় বিষয় ছিল সামরিক বাহিনী ও ছাত্র-নির্ভর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা।

ছাত্ররা সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানকে নিয়ে সন্দিহান। অনেকে মনে করেন, শেখ হাসিনার আত্মীয় হওয়ায় তিনি হয়তো আওয়ামী লীগের পুনরুত্থানে ভূমিকা রাখতে চাইছেন।

আবার অন্য একটি গুঞ্জন হচ্ছে, সেনাপ্রধান হয়তো বিএনপির সঙ্গে গোপন চুক্তি করে দ্রুত নির্বাচন চাচ্ছেন। অপরদিকে, বিএনপি নেতাদের ধারণা ছাত্ররা নিজেরাই রাজনীতিতে সংগঠিত হওয়ার জন্য সময় কেনার উদ্দেশ্যে নির্বাচন পেছাতে চায়।

ভারতের অবস্থান ও কূটনৈতিক সরবতা

ভারতের অবস্থানও এই আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দীর্ঘদিন ধরে শেখ হাসিনার প্রতি ভারতের সমর্থন থাকলেও, এবার তার পতনের জন্য তারা বিএনপি ও জামায়াত-ই-ইসলামীর মধ্যে চক্রান্তকে দায়ী করছে। তবে এবার ভারতের কূটনীতিকরা দুই দলের ইফতার আয়োজনেই উপস্থিত ছিলেন — যা পাল্টে যাওয়া সময়ের ইঙ্গিত।

জামায়াতের মহাসচিব মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, “খুব ব্যস্ত সময়।” তিনি জানান, তাদের আয়োজনে ৩৯টি কূটনৈতিক মিশনের প্রতিনিধিত্ব ছিল।

বিএনপির ইফতারে আবেগঘন মুহূর্ত

গণ-অধিকার পরিষদের ছাদে ইফতারের কাছাকাছি সময়ে, কাছেই একটি স্কুল মাঠে তাবুতে স্থানীয় বিএনপি শাখাও আয়োজন করেছিল ইফতার পার্টি। গোল টেবিলে লোকজন বসেছিলেন, ট্রাক থেকে বিরিয়ানি বক্স ও কোমল পানীয় নামানো হচ্ছিল।

মুখ্য সড়কে মাইকিং করে অতিথিদের নাম ঘোষণা হচ্ছিল। ফুল দিয়ে সাজানো মঞ্চে স্থানীয় বিএনপি নেতা আরিফুল ইসলাম আরিফ যখন বক্তব্য রাখতে উঠলেন, তখন তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।

তিনি বলেন, “আমি সাত বছর পর এখানে আসতে পেরেছি, কারণ আমি এতদিন জেলে ছিলাম।”