সারাক্ষণ রিপোর্ট
পোর্ট লুইস শহরের একটি ছোট অফিসকক্ষে ওলিভিয়ার ব্যাঙ্কুল্ট দেয়ালে ঝোলানো চাগোস দ্বীপপুঞ্জের ত্রিবর্ণ পতাকার দিকে ইশারা করেন। এই দ্বীপপুঞ্জের সবচেয়ে বড় দ্বীপ ডিয়েগো গার্সিয়ায় যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। ১৯৭০–এর দশকের শুরুর দিকে এই ঘাঁটি নির্মাণের সময় প্রায় ১,৫০০ চাগোসবাসীকে জোরপূর্বক সরিয়ে নেওয়া হয়। তখন ওলিভিয়ার ব্যাঙ্কুল্ট ছিলেন ছোট শিশু। দ্বীপপুঞ্জটি মূলত মরিশাসের অংশ ছিল, কিন্তু ১৯৬৮ সালে মরিশাসের স্বাধীনতার ঠিক আগে যুক্তরাজ্য এটি আলাদা করে ফেলে। চাগোসের পতাকায় থাকা কমলা রং এখানে বসবাসকারীদের অস্তমিত সূর্যের প্রতীক, কালো রং তাদের অন্ধকার যুগকে নির্দেশ করে, আর নীল রং সমুদ্র ও ভবিষ্যতের আশাকে তুলে ধরে।
সার্বভৌমত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার আলোচনা
১ এপ্রিল এক ব্রিটিশ সরকারি মুখপাত্র জানান, চাগোস দ্বীপপুঞ্জের সার্বভৌমত্ব মরিশাসের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। এর আগে ২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতও একই ধরনের সুপারিশ করেছিল। সরকারি সূত্র বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই চুক্তিতে আপত্তি করবেন না বলে আশা করা হচ্ছে, যদিও তাঁর নতুন প্রশাসনের কিছু সদস্য গত অক্টোবরে এই চুক্তির সমালোচনা করেন। বিদায়ী বাইডেন প্রশাসন অবশ্য সমঝোতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল।
সম্ভাব্য চূড়ান্ত চুক্তি ও মরিশাসের ভূমিকা
চূড়ান্ত চুক্তি সই হলে মরিশাসের কৌশলগত গুরুত্ব বহুগুণে বেড়ে যাবে। মরিশাস দাবি করে যে তাদের সামুদ্রিক এলাকা প্রায় ২৩ লাখ বর্গকিলোমিটার, যা প্রায় আলজেরিয়ার সমান—আফ্রিকার সবচেয়ে বড় দেশের সমান। এই এলাকাটি ভারত মহাসাগরের গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ, যেখানে বড় ধরনের খনিজ সম্পদ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। পশ্চিমা বিশ্ব, চীন এবং বিশেষ করে ভারতের এখানে বড় স্বার্থ থাকায় মরিশাস আন্তর্জাতিক মহলে গুরুত্ব পেতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে ভারত আগালে্গা দ্বীপে বিমান ও নৌবাহিনীর অবকাঠামো গড়ে তুলছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্প্রতি পোর্ট লুইস সফর করেছেন, আর ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁও শিগগিরই মরিশাসে যেতে পারেন। ট্রোমেলিন দ্বীপ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আইনি বিরোধ থাকায় ম্যাক্রোঁ সম্ভবত তা এড়াতে চাইছেন। মরিশাসের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ধনঞ্জয় রামফুল বলছেন, “বিশ্বশক্তিগুলো প্রতিযোগিতায় নেমেছে, আর আমরা সেখান থেকে আমাদের সম্ভাব্য লাভ তুলে নিতে পারি।”
ডিয়েগো গার্সিয়ার সামরিক গুরুত্ব
চাগোস দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে ডিয়েগো গার্সিয়া যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি। ইরানের সঙ্গে উত্তেজনা বাড়ার প্রেক্ষিতে সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র সেখান থেকে বি-২ স্টেলথ বোমারু বিমান মোতায়েন করেছে। এই বিমানগুলো বাঙ্কার-বাস্টার বোমা বহন করতে সক্ষম, যা ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা আক্রমণেও ব্যবহৃত হতে পারে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন।
সমঝোতার কৌশলগত চ্যালেঞ্জ
যুক্তরাষ্ট্র কখনোই ডিয়েগো গার্সিয়া ঘাঁটির ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে চায়নি। তাই সাম্প্রতিক সমঝোতায় একটি কৌশলগত “ফাঁক” রাখা হয়েছে—চুক্তিতে বলা হচ্ছে মরিশাস সার্বভৌমত্ব ফিরে পাবে, কিন্তু ডিয়েগো গার্সিয়ায় যুক্তরাজ্য “সার্বভৌম অধিকার” বজায় রাখবে। সমালোচকদের মতে, এভাবে “নিয়ন্ত্রিত সার্বভৌমত্ব” ভবিষ্যতে পশ্চিমা স্বার্থকে হুমকিতে ফেলতে পারে। যদি কোনো সরকার চুক্তি লঙ্ঘন করে চীনকে অন্য দ্বীপে সামরিক ঘাঁটির অনুমতি দেয়, সেটি বিচিত্র হবে না বলে তারা আশঙ্কা করেন। তবে মন্ত্রী রামফুল জোর দিয়ে বলেন, “একটি সামরিক ঘাঁটিই যথেষ্ট; আমরা জিবুতির মতো হতে চাই না।”
অর্থনৈতিক গুরুত্ব ও প্রত্যাশা
মরিশাসের প্রধানমন্ত্রী নবীনচন্দ্র রামগুলাম যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে ডিয়েগো গার্সিয়া ব্যবহারের আর্থিক ‘খরচ’ অগ্রিম আদায় করার বিষয়টিতে আগ্রহী। মরিশাস একটি গুরুত্বপূর্ণ অফশোর আর্থিক কেন্দ্র, এবং বাজেট ঘাটতি সামাল দিতে তাদের ক্রেডিট রেটিং ধরে রাখা জরুরি। সুতরাং এই চুক্তি থেকে আসা অর্থনৈতিক সুবিধা মরিশাসের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
আগালে্গা দ্বীপে ভারতের উপস্থিতি
চাগোস নিয়ে আলোচনা যখন উত্তপ্ত, তখন আগালে্গা দ্বীপ তুলনামূলকভাবে আলোচনার বাইরে থেকে যাচ্ছে। ২০১৫ সালে ভারত ও মরিশাসের মধ্যে একটি চুক্তি হয়, যার আওতায় আগালে্গায় একটি জেটি ও বড় রানওয়ে তৈরি হচ্ছে। অনেকে সন্দেহ করেন, এটি কি ভারতীয় সামরিক ঘাঁটি নয়? যদিও সরকারিভাবে বলা হয়েছে এটি “পণ্য ওঠানামার কেন্দ্র”, কিন্তু এত কম বাসিন্দার একটি দ্বীপে বিশাল রানওয়ের মতো অবকাঠামো সামরিক উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কারণে বানানো কঠিন বলে কেউ কেউ মনে করেন।
ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের প্রভাব
মরিশাসের অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা মনে করেন, ভারতের ওপর অতিরিক্ত সামরিক নির্ভরশীলতা দেশটির সার্বভৌমত্ব কমাতে পারে। অন্যদিকে, আরও অনেকে মনে করেন আঞ্চলিক নিরাপত্তার স্বার্থে ভারতের সহায়তা গ্রহণ বাস্তবসম্মত একটি পথ। দীর্ঘদিন ধরে মরিশাসের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পদে ভারতীয় কর্মকর্তারা কাজ করেছেন, আর কোস্টগার্ড রক্ষণাবেক্ষণেও ভারতের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। এক কর্মকর্তা বলেন, “ভারত এখন বৈশ্বিক পরিসরে শক্তিশালী দেশ হিসেবে উঠছে, তাই আগালে্গায় তাদের উপস্থিতি অব্যাহত রাখা স্বাভাবিক বিষয়।”
চূড়ান্ত মন্তব্য
চাগোস দ্বীপপুঞ্জ সংক্রান্ত আলোচনায় মরিশাস সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে বলে অনেকেই মনে করেন। একইসঙ্গে, ভারতের প্রভাবও ক্রমবর্ধমান হতে পারে। মরিশাসের পররাষ্ট্রনীতিতে ভারতের ভূমিকা দিন দিন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। একসময় দ্বীপ রাষ্ট্রটির প্রতিষ্ঠাতা প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, “আমরা অনেকের উপপত্নী, কিন্তু কারও স্ত্রী নই।” কিন্তু সময় বদলেছে। এখন মনে হচ্ছে মরিশাস স্থায়ীভাবে ভারতের সঙ্গে শক্তিশালী বন্ধনে আবদ্ধ হতে চলেছে।