০৫:২৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৬৮)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:১৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৫ এপ্রিল ২০২৫
  • 23

তেহের ফকির

আমাদের গ্রামে তাঁতিপাড়ার রহিম মল্লিকের গানের কথা আগেই উল্লেখ করিয়াছি। রহিম মল্লিকের পিতার নাম ছিল তেহের ফকির। তিনি খুব ভালো লাঠিখেলা জানিতেন। আর ফকিরি করিয়া গ্রামদেশের রোগীর চিকিৎসা করিতেন। আমাদের পাড়ায় কোনো লাঠিখেলার অনুষ্ঠান হইলে সকল লাঠিয়াল তাঁহার পায়ের ধুলা লইয়া তবে আসরে নামিত। খেলা শেষ হইবার আগে সকলের অনুরোধে তিনি কিছুক্ষণ লাঠিখেলার কসরত দেখাইতেন। তাহা দেখিয়া লাঠিখেলা শিখিবার জন্য আমার মন খুব আকৃষ্ট হইল। মনে মনে ভাবিলাম, লাঠিখেলা যদি শিখিতে হয়, তবে সবচাইতে বড় ওস্তাদ তেহের ফকিরের কাছেই যাইব। আমার বয়স তখন পাঁচ-ছয় বৎসরের বেশি হইবে না। আমি বাঁশের ঝাড় হইতে অপটু হাতে একখানা লাঠি তৈরি করিয়া তেহের ফকিরের কাছে গেলাম খেলা শিখিতে। গ্রাম-সম্পর্কে তিনি আমার দাদা। তাঁহাকে যাইয়া বলিলাম, “দাদা! আমি আপনার কাছে আসিয়াছি লাঠি খেলা শিখিতে।”

আমার কথা শুনিয়া তিনি দাদিকে বলিলেন, “ওগো শুনিতেছ? আমার এক বড় কুটুম আসিয়াছে আমার কাছে লাঠিখেলা শিখিতে।” এই বলিয়া তিনি আমার হাত হইতে লাঠিখানা লইয়া নানা কসরত দেখাইয়া আমার গায়ে আনিয়া লাঠি ঠেকাইতে লাগিলেন। দাদি ঘরের চৌকাঠ ধরিয়া হাসিয়া কুটি কুটি হইতেছিলেন।

তেহের ফকিরের বাড়িতে প্রতি বৎসর মাঘী পূর্ণিমার রাত্রে ধামাইল হইত। ধামাইলের পনরো ষোল দিন আগে বাঁশের ঝাড় হইতে অক্ষত কতকগুলি সরু বাঁশ কাটিয়া আনা হইত। সবচাইতে বড় বাঁশটির নাম রাখা হইত মাদারের বাঁশ-তারপর আলীর বাঁশ, ফতেমার বাঁশ প্রভৃতি ছয়টি বাঁশ! সবচাইতে ছোট বাঁশটির নাম ছিল আল্লার বাঁশ। এই বাঁশটি সাদা কাপড়ে আবৃত হইত। প্রত্যেক বাঁশের আগায় একটি চামর থাকিত। এই বাঁশগুলি লইয়া ফকিরের শিষ্যেরা গ্রামের বাড়ি বাড়ি যাইয়া নাচিত। যাদব ঢুলি এই নাচের সঙ্গে ঢোল বাজাইত। সে কি অপূর্ব নাচ! পায়ে নূপুর পরিয়া প্রত্যেকের বাঁশটি ডান হাতের তেলোর উপর লইয়া বাম হাতে বাঁশের কিছুটা উপরে ধরিয়া কখনও বসিয়া, কখনও মাজা বাঁকা করিয়া, কখনও-বা লাফাইয়া এমন সুন্দর নাচ দেখাইত।

সেই নাচের তালে তালে যাদব ঢুলি তাহার ঢোলবাদ্যের সমস্ত নৈপুণ্য দেখাইত। নাচুয়েদের সঙ্গে তাহার বাদ্যের প্রতিযোগিতা হইত। কোনো বাড়িতে যদি তাহার ঢোল বাদ্যের চাইতে নাচুয়েদের নাচের তারিফ হইত, পরবর্তী বাড়িতে যাইয়া সে তাহার ঢোলবাদ্যের আরও নতুন নতুন কৌশল দেখাইয়া নাচুয়েদের পরাজিত করিত।

সমবেত নাচ শেষ হইলে একক নাচ আরম্ভ হইত। কেহ তাহার বাঁশটি পেটের উপর লইয়া হাতে না ধরিয়া নাচিত। কেহ মাথার উপরে বাঁশটি লইয়া নাচিত। গ্রামের লোকেরা

ধন্য ধন্য করিত। বাঁশ নাচানো শেষ হইলে সবগুলি বাঁশ একটি ধামার উপর রাখিয়া নাচুয়েরা বাড়ির কর্তার নিকট হইতে পান-তামাক খাইত। ধামাইলের বাঁশ মাটিতে নামানো নিষিদ্ধ। বাড়ির গৃহিণী নাকে নথ ঝুলাইতে ঝুলাইতে আসিয়া সোয়াসের খানেক চাউল, পাঁচটি পয়সা একটি কুলার উপরে আনিয়া সেই ধামায় ঢালিয়া দিত। ফকিরের শিষ্যেরা অন্য বাড়িতে যাইয়া আবার নাচের অনুষ্ঠান জমাইত। গ্রামের উলঙ্গ ছেলেমেয়ের দল এই বাঁশ-নাচুয়ের দলের সঙ্গে এ-বাড়ি সে-বাড়ি ঘুরিয়া বেড়াইত।

চলবে…..

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৬৮)

১১:০০:১৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৫ এপ্রিল ২০২৫

তেহের ফকির

আমাদের গ্রামে তাঁতিপাড়ার রহিম মল্লিকের গানের কথা আগেই উল্লেখ করিয়াছি। রহিম মল্লিকের পিতার নাম ছিল তেহের ফকির। তিনি খুব ভালো লাঠিখেলা জানিতেন। আর ফকিরি করিয়া গ্রামদেশের রোগীর চিকিৎসা করিতেন। আমাদের পাড়ায় কোনো লাঠিখেলার অনুষ্ঠান হইলে সকল লাঠিয়াল তাঁহার পায়ের ধুলা লইয়া তবে আসরে নামিত। খেলা শেষ হইবার আগে সকলের অনুরোধে তিনি কিছুক্ষণ লাঠিখেলার কসরত দেখাইতেন। তাহা দেখিয়া লাঠিখেলা শিখিবার জন্য আমার মন খুব আকৃষ্ট হইল। মনে মনে ভাবিলাম, লাঠিখেলা যদি শিখিতে হয়, তবে সবচাইতে বড় ওস্তাদ তেহের ফকিরের কাছেই যাইব। আমার বয়স তখন পাঁচ-ছয় বৎসরের বেশি হইবে না। আমি বাঁশের ঝাড় হইতে অপটু হাতে একখানা লাঠি তৈরি করিয়া তেহের ফকিরের কাছে গেলাম খেলা শিখিতে। গ্রাম-সম্পর্কে তিনি আমার দাদা। তাঁহাকে যাইয়া বলিলাম, “দাদা! আমি আপনার কাছে আসিয়াছি লাঠি খেলা শিখিতে।”

আমার কথা শুনিয়া তিনি দাদিকে বলিলেন, “ওগো শুনিতেছ? আমার এক বড় কুটুম আসিয়াছে আমার কাছে লাঠিখেলা শিখিতে।” এই বলিয়া তিনি আমার হাত হইতে লাঠিখানা লইয়া নানা কসরত দেখাইয়া আমার গায়ে আনিয়া লাঠি ঠেকাইতে লাগিলেন। দাদি ঘরের চৌকাঠ ধরিয়া হাসিয়া কুটি কুটি হইতেছিলেন।

তেহের ফকিরের বাড়িতে প্রতি বৎসর মাঘী পূর্ণিমার রাত্রে ধামাইল হইত। ধামাইলের পনরো ষোল দিন আগে বাঁশের ঝাড় হইতে অক্ষত কতকগুলি সরু বাঁশ কাটিয়া আনা হইত। সবচাইতে বড় বাঁশটির নাম রাখা হইত মাদারের বাঁশ-তারপর আলীর বাঁশ, ফতেমার বাঁশ প্রভৃতি ছয়টি বাঁশ! সবচাইতে ছোট বাঁশটির নাম ছিল আল্লার বাঁশ। এই বাঁশটি সাদা কাপড়ে আবৃত হইত। প্রত্যেক বাঁশের আগায় একটি চামর থাকিত। এই বাঁশগুলি লইয়া ফকিরের শিষ্যেরা গ্রামের বাড়ি বাড়ি যাইয়া নাচিত। যাদব ঢুলি এই নাচের সঙ্গে ঢোল বাজাইত। সে কি অপূর্ব নাচ! পায়ে নূপুর পরিয়া প্রত্যেকের বাঁশটি ডান হাতের তেলোর উপর লইয়া বাম হাতে বাঁশের কিছুটা উপরে ধরিয়া কখনও বসিয়া, কখনও মাজা বাঁকা করিয়া, কখনও-বা লাফাইয়া এমন সুন্দর নাচ দেখাইত।

সেই নাচের তালে তালে যাদব ঢুলি তাহার ঢোলবাদ্যের সমস্ত নৈপুণ্য দেখাইত। নাচুয়েদের সঙ্গে তাহার বাদ্যের প্রতিযোগিতা হইত। কোনো বাড়িতে যদি তাহার ঢোল বাদ্যের চাইতে নাচুয়েদের নাচের তারিফ হইত, পরবর্তী বাড়িতে যাইয়া সে তাহার ঢোলবাদ্যের আরও নতুন নতুন কৌশল দেখাইয়া নাচুয়েদের পরাজিত করিত।

সমবেত নাচ শেষ হইলে একক নাচ আরম্ভ হইত। কেহ তাহার বাঁশটি পেটের উপর লইয়া হাতে না ধরিয়া নাচিত। কেহ মাথার উপরে বাঁশটি লইয়া নাচিত। গ্রামের লোকেরা

ধন্য ধন্য করিত। বাঁশ নাচানো শেষ হইলে সবগুলি বাঁশ একটি ধামার উপর রাখিয়া নাচুয়েরা বাড়ির কর্তার নিকট হইতে পান-তামাক খাইত। ধামাইলের বাঁশ মাটিতে নামানো নিষিদ্ধ। বাড়ির গৃহিণী নাকে নথ ঝুলাইতে ঝুলাইতে আসিয়া সোয়াসের খানেক চাউল, পাঁচটি পয়সা একটি কুলার উপরে আনিয়া সেই ধামায় ঢালিয়া দিত। ফকিরের শিষ্যেরা অন্য বাড়িতে যাইয়া আবার নাচের অনুষ্ঠান জমাইত। গ্রামের উলঙ্গ ছেলেমেয়ের দল এই বাঁশ-নাচুয়ের দলের সঙ্গে এ-বাড়ি সে-বাড়ি ঘুরিয়া বেড়াইত।

চলবে…..