সারাক্ষণ রিপোর্ট
চীনের কৌশল: নীরব রপ্তানি বাধা
যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্যযুদ্ধ আবার উত্তপ্ত। তবে এবার সরাসরি শুল্ক নয়, বরং চীন রপ্তানি ঠেকাতে ব্যবহার করছে অদৃশ্য কৌশল। গত চার মাস ধরে যুক্তরাষ্ট্রের গরুর মাংস, মুরগির মাংস ও তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের মতো পণ্যের ওপর চীন বাধা তৈরি করেছে। কখনো লাইসেন্স নবায়ন না করে, কখনো ত্রিপক্ষীয় বিক্রয় চুক্তির ছলে রপ্তানি সীমিত করে—চীন কার্যত মার্কিন পণ্য প্রবেশের পথ রুদ্ধ করছে।
ট্রাম্পপন্থী রাজ্যগুলোর ওপর কৌশলগত চাপ
চীনের এসব পদক্ষেপ বিশেষভাবে লক্ষ্য করছে রিপাবলিকান-প্রভাবিত রাজ্যগুলোকে, যেমন আইওয়া ও নেব্রাস্কা, যেগুলো কৃষি ও জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি ও পরিবেশনীতি বিশেষজ্ঞ বেন লিলিস্টন বলেন, “শুল্ক দিলে পণ্য ঢুকতে পারে, শুধু দাম বাড়ে। কিন্তু এই বাধাগুলো সরাসরি রপ্তানির পথই বন্ধ করে দিচ্ছে।”
চীন কীভাবে বাধা দিচ্ছে?
- মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নবায়ন না করা
- মুরগির মাংসে নিষিদ্ধ ওষুধ থাকার অভিযোগ আনা
- যুক্তরাষ্ট্রের এলএনজি আমদানি বন্ধ করে দেওয়া
এসব ক্ষেত্র ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ শিল্প খাত হিসেবে বিবেচিত।
অতীতের মতো চীনের পুরোনো কৌশল
চীন এই ধরণের কৌশল অনেক আগে থেকেই ব্যবহার করে আসছে। ২০০১ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (WTO) প্রবেশের পর থেকেই চীন সন্দেহভাজন কীট বা জিএমও থাকার অজুহাতে বিদেশি পণ্য আটকে দিয়েছে। ২০১৮ সালে হুয়াওয়ের এক নির্বাহীর কানাডায় আটক নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে ক্যানোলা তেল আমদানিও বন্ধ করেছিল চীন। পরে ওই নির্বাহী দেশে ফিরলে আমদানি আবার চালু হয়।
প্রাক্তন মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি দারসি ভেটার মন্তব্য করেন, “স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিয়ে এমন রাজনীতি করা উচিত নয়। এটা বিজ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে গঠিত নিয়মকে রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত করে।”
দ্বৈত লাভ: বিজ্ঞানসুলভ মুখোশে রাজনৈতিক কৌশল
গবেষক মার্ক বুশের ভাষায়, “চীন বিজ্ঞানভিত্তিক জনস্বার্থের মুখোশে বাণিজ্য যুদ্ধ চালায়—এতে একদিকে তাদের অস্বীকার করার সুযোগ থাকে, অন্যদিকে তারা কৌশলগতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতি করতে পারে।”
তবে যুক্তরাষ্ট্রও এই কৌশলের বাইরে নয়। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতিবিদ কলিন কার্টার বলেন, “আমাদের নিজস্ব চিনির নীতিমালাই এক চরম উদাহরণ।”
এলএনজি খাতেও পুরোনো ইতিহাস
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আগের মেয়াদেও চীন যুক্তরাষ্ট্র থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (LNG) আমদানি বন্ধ করেছিল। এবারও একই ঘটনা ঘটছে। চীন এলএনজি-কে কৌশলগত হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে, যার প্রস্তুতি তারা আগেই নিয়েছে বলে জানান জ্বালানি বিশ্লেষক লেসলি পালটি-গুজমান।
চলতি বছর এখন পর্যন্ত মাত্র একটি গ্যাস কার্গো আমদানি করেছে চীন, যেখানে গত বছর এ সময়ের মধ্যে সংখ্যা ছিল ১৪টি। ফেব্রুয়ারিতে চীন যুক্তরাষ্ট্রের গ্যাস আমদানির ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে এবং রাজনৈতিকভাবে মার্কিন গ্যাস গ্রহণ নিরুৎসাহিত করে।
মুরগির মাংস নিয়ে বিতর্ক
ন্যাশনাল চিকেন কাউন্সিলের মুখপাত্র টম সুপার বলেন, “চীন বহুদিন ধরেই অশুল্ক বাধা ব্যবহার করছে।” চীন যে অ্যান্টিবায়োটিকের অভিযোগ এনেছে, তা যুক্তরাষ্ট্রে বহু আগেই নিষিদ্ধ।
খনিজ রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ: আরও বড় হুমকি
সবচেয়ে উদ্বেগজনক সিদ্ধান্ত হচ্ছে—যুক্তরাষ্ট্রে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ রপ্তানিতে চীনের নিয়ন্ত্রণ। এসব খনিজ ব্যবহার হয় বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি, পেট্রোকেমিক্যাল ও অন্যান্য শিল্প পণ্যে। চীন এসব খনিজের প্রধান উৎস হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প খুঁজে পাওয়া কঠিন।
কমোডিটি বিশ্লেষক আল গ্রিনউড বলেন, “এই খাতটি চীনের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে।”
দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জ: অদৃশ্য বাধা থাকবেই
বিশেষজ্ঞ গ্রেটা পেইশ বলেন, “চীন সব সময় এই অদৃশ্য কৌশল ব্যবহার করে আসছে—তারা বলে আমরা শুধু নিয়ম মানছি। এটা তাদের বাণিজ্য কৌশলের অংশ এবং এটি নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত।”
উপসংহার:
চীন এখন সরাসরি শুল্কে নয়, বরং প্রশাসনিক কৌশল ও অদৃশ্য বিধিনিষেধের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বাণিজ্য যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। এতে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষি, জ্বালানি ও খনিজ খাত—যেগুলো মার্কিন রাজনীতির ট্রাম্পপন্থী ভিত্তিকে প্রতিনিধিত্ব করে। ভবিষ্যতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্বাভাবিক হলেও এই অদৃশ্য বাধাগুলোর অবসান দ্রুত হবে না বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।