০৫:৫২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫
ইরান ইউরেনিয়াম সরিয়ে নিয়েছে এমন কোনো গোয়েন্দা তথ্য নেই: মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগন্নাথ মন্দির আর প্রসাদ বিতরণ নিয়ে কেন রাজনৈতিক বিতর্ক পশ্চিমবঙ্গে? মন্দির ভাঙচুরের ঘটনা ও গঙ্গা জলচুক্তি নবায়ন নিয়ে ভারতের প্রতিক্রিয়া ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন: বাংলাদেশের বড় একটি ভুল, প্রতিশোধ বনাম সংস্কার সাকিব আল হাসান: বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের এক অমর কিংবদন্তি বাংলা নাটকের সুপারস্টার অপূর্বের জন্মদিন আজ শিবসা নদী: শতবর্ষী এক প্রাণপ্রবাহ ও তার সুন্দরবনের প্রভাব ইরান যুদ্ধ ও ‘ট্রাম্প নীতি’ চীনের বহুমুখী বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গিকে ঘোলাটে করে দিচ্ছে আসিয়ান এখন আর কেবল বৈশ্বিক পুঁজির নীরব গ্রাহক নয় প্রতিদিন একটি রুমাল (পর্ব-১৯)

অপরাপর মঙ্গলের কী হবে

  • Sarakhon Report
  • ০৩:১০:৫৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল ২০২৫
  • 91

বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ

‘ইচ্ছে করলেই কৃষ্ণচূড়া গাছটার নাম ফাতেমাচূড়া হবে না’- মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী বলেছিলেন। রবিঠাকুর নামকে লাউয়ের বোঁটার সাথে তুলনা করেছিলেন। তিনি তখন ‘বিচিত্রা’ সাময়িকীতে ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে লিখছিলেন। প্রথম দুই সংখ্যায় উপন্যাসটির নাম ছিল ‘তিন পুরুষ’। তৃতীয়বারে কবি এর নাম দেন ‘যোগাযোগ’। এর কৈফিয়ত দিতে গিয়ে কবি লেখেন, ‘ব্যক্তিসম্বন্ধে মানুষের নাম তার বিশেষণ নয়, সম্বোধন মাত্র। লাউয়ের বোঁটা নিয়ে লাউয়ের বিচার কেউ করে না, ওটাতে ধরবার সুবিধে। যার নাম দিয়েছি সুশীল তার শীলতা নিয়ে আমার কোন জবাবদিহি নেই।’ এবারের পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। মঙ্গল শব্দটি প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা থেকে বিবর্তিত হয়ে সংস্কৃত ভাষা থেকে এসেছে (মন্‌গ্‌+অল (অলচ্)+অ(অচ্)}। এর অর্থ সাধারণের জানা- শুভ, ভালো, উপকার, কল্যাণ, প্রশন্ত ইত্যাদি। সমাসের হিসেবে ‘মঙ্গল সূচক যে শোভাযাত্রা’ তাকে মঙ্গল শোভাযাত্রা বলা যেতে পারে। অভিধানে মঙ্গল বলতে প্রশস্ত কর্মের অনুষ্ঠান এবং অপ্রশস্ত কর্মের বিসর্জনকেও বোঝানো হয়েছে, যা নববর্ষের দ্যোতনার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। কিন্তু বাধ সেধেছে মঙ্গল শব্দের আরেকটি অর্থ। অর্থটি হচ্ছে হিন্দু দেবদেবীর মাহাত্ম্য বিষয়ক কাব্য বা পালা গান (যেমন মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল)। আবার মঙ্গলের স্ত্রীবাচক শব্দ মঙ্গলা, অর্থ মঙ্গলদায়িনী, শুভঙ্করী; হিন্দু ধর্ম মতে তিনি দুর্গাদেবী।

কিন্তু মুশকিল হচ্ছে মঙ্গল শব্দটি শুধু বাংলা নববর্ষের পয়লা দিনের শোভাযাত্রার সাথে জড়িয়ে নেই। এটি সহ আরো অনেক বাংলা শব্দ জড়িয়ে আছে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও বাঙালি সংস্কৃতির উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অনুষঙ্গের সাথে এবং একই সাথে বিভিন্ন দেব-দেবীর নামের বা বৈশিষ্ট্যের সাথে। এদের ইংরেজি শব্দও অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধর্ম বা পুরাণ (mythology)-এর দেব-দেবীর সাথে সম্পর্কিত। এক এক করে আসি। প্রথমে মহাকাশের দিকে তাকাই। সৌরজগতের কেন্দ্রীয় নক্ষত্র (সূর্য) এবং তার ৮টি গ্রহের নামের উৎস (etymology) খেয়াল করি। সূর্য শব্দটা এসেছে সংস্কৃত ‘সূর্য’ (Sürya) থেকে, যার অর্থ ‘বীর’ বা ‘শক্তিশালী’। সূর্য হিন্দু সৌরদেবতার নাম, যিনি শক্তির প্রতীক। যদিও বৈদিক যুগে (খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০-৫ম শতাব্দী) আরও বেশ কিছু দেবতারও সৌর বৈশিষ্ট্য ছিল, পরবর্তী হিন্দু ধর্মে এদের বেশিরভাগই একক দেবতায় মিশে গিয়েছিল। একসময় সূর্যকে বিষ্ণু, শিব, শক্তি এবং গণেশের সাথে স্থান দেওয়া হয়েছিল। এই পাঁচ দেবতাকে ব্রাহ্মণ (পুরোহিত) স্মার্তদের একটি দল পূজা করে, তবে শুধুমাত্র একটি ছোট দল, সৌর সম্প্রদায়, সূর্যকে সর্বোচ্চ দেবতা হিসাবে পূজা করে। তবে, বেশিরভাগ হিন্দুই তাঁর কাছে সাহায্যপ্রার্থী এবং অনেক হিন্দু প্রতিদিন ভোরে সূর্যকে সম্বোধন করে গায়ত্রী মন্ত্র উচ্চারণ করে। সূর্যের ইংরেজি Sun, যার উৎস প্রোটো-জার্মানিক ভাষা থেকে উৎপন্ন প্রাচীন ইংরেজি sunne: ডাচ zon এবং জার্মান Sonne এর সাথে সম্পর্কিত, গ্রীক helios এবং ল্যাটিন sol দ্বারা বিভক্ত একটি ইন্দো-ইউরোপীয় শব্দধাতু থেকে। গ্রীক শব্দ helios এর অর্থ ‘সূর্য’, ‘সূর্যের রশ্মি’ বা ‘দিনের আলো’; এটি বাইবেলে পাওয়া যায় এবং একটি গ্রীক পৌরাণিক চরিত্রের নামও। ল্যাটিন শব্দ sol এর অর্থ ‘সূর্য’- সূর্যের রোমান দেবতাকে নির্দেশ করে থাকে।

সূর্য থেকে যদি দূরে যেতে থাকি তবে ক্রমানুযায়ী ৮টি গ্রহ: (১) বুধ (Mercury), (২) শুক্র (Venus), (৩) পৃথিবী (Earth), (৪) মঙ্গল (Mars), (৫) বৃহস্পতি (Jupiter), (৬) শনি (Saturn), (৭) ইউরেনাস (Uranus) ও (৮) নেপচুন (Neptune)। ‘বুধ’ শব্দটি সংস্কৃত ‘বুধ’ থেকে এসেছে, যা ‘বুদ্ধি’ বা ‘জ্ঞান’ নির্দেশ করে। হিন্দু জ্যোতিষে বৃহস্পতির পুত্র বুধকে জ্ঞান ও বুদ্ধির দেবতা বলে গণ্য করা হয়। Mercury নামটি রোমান মিথোলজির বাণিজ্য ও যোগাযোগের দেবতা মার্কারির নামানুসারে রাখা হয়েছে। মার্কারির পাখাযুক্ত পাদুকা আছে, ফলে তিনি খুব দ্রুতগামী। কক্ষপথে বুধের দ্রুত ঘূর্ণনের সাথে মিল রেখে এই নামকরণ করা হয়েছে। গ্রিক পুরাণে এর সমতুল্য হার্মিস। সংস্কৃতে শুক্র অর্থ ‘শুক্ল’-‘উজ্জ্বল’ বা ‘দীপ্যমান’। গ্রহের নামটি এসেছে হিন্দু পুরাণের দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের নাম থেকে। শুক্র শব্দের আরেক অর্থ ‘বীর্য’; বীর্যের উপাদান শুক্রাণু। বামনপুরাণে বলা হয়েছে, ‘রুদ্রস্য শুক্রদ্বারেণ নির্গতত্বাৎ শুক্রঃ’; শিব সন্তুষ্টচিত্তে তাকে শিশ্নপথে নিঃসরণ করেছিলেন, সেই থেকে তার নাম শুক্র। তাই তিনি সৌন্দর্য ও প্রেমের প্রতীক। শুক্র গহের আরেক নাম ‘শুকতারা’, আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারা। Venus রোমান প্রেম ও সৌন্দর্যের দেবী ভেনাসের নামে। গ্রিক পুরাণে এর সমতুল্য আফ্রোদিতি। ৩য় গ্রহ প্রাণিজগতের জীবনধারণের জন্য উপযোগী একমাত্র গ্রহ- পৃথিবী। এ শব্দটিও সংস্কৃত থেকে উদ্ভুত; সংস্কৃত পৃথ্বী অর্থ ‘বিস্তীর্ণ’, এটি ভূমির প্রতীক। Earth শব্দের উদ্ভব প্রাচীন ইংরেজি eor(th)e এবং প্রোটো-জার্মানিক erthō থেকে, যার অর্থ ‘মাটি’ বা ‘জমি’। বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষাতেই এটি একমাত্র গ্রহ যার নাম হিন্দু, গ্রিক, রোমান বা অন্য কোনো দেবতার নামে নয়। এবারে সেই মঙ্গল, যার ব্যুৎপত্তি আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। ইংরেজি Mars রোমান যুদ্ধের দেবতা মার্সের নামে। গ্রিক পুরাণে এর সমতুল্য অ্যারেস (Ares)। মঙ্গলের পৃষ্ঠ কমলা-লাল রঙের, কারণ এটি আয়রন (Ferric) অক্সাইডের ধুলো দিয়ে ঢাকা, যা এটিকে ‘কমলা গ্রহ’ উপাধি দিয়েছে। ৫ম গ্রহটি বৃহতের পতি, মানে বৃহস্পতি, সংস্কৃত জাত। হিন্দু পৌরাণিক দেবতা বৃহস্পতি দেবতাদের গুরু (সুরাচার্য) এবং জ্ঞান ও প্রজ্ঞার প্রতীক। সৌরজগতের বৃহত্তম গ্রহ হওয়ায় সম্ভবত এই দেবতার নামে নামকরণ করা হয়েছে। Jupiter নামটি রোমান মিথোলজির প্রধান দেবতা জুপিটারের নামানুসারে রাখা হয়েছে। জুপিটার আকাশ ও বজ্রের দেবতা এবং দেবতাদের রাজা। গ্রীক নাম ‘জিউস’ (Zeus), যার অর্থ ‘আকাশের পিতা’। শনি সংস্কৃত শনৈশ্চর থেকে এসেছে। হিন্দু জ্যোতিষ অনুযায়ী শনি সূর্যের পুত্র এবং যম তার অধিদেবতা। শনি কৃষ্ণবস্ত্রধারী ও কামসূত্রকার, শকুন তার বাহন; তাকে অশুভকারী দেবতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শনির শুভদৃষ্টি বা কোপদৃষ্টি উভয়ই অনিষ্টকর, ফলে শনির দশা বলতে অতিশয় দুঃসময়কে বোঝানো হয়ে থাকে। Saturn রোমান কৃষি ও সময়ের দেবতা (গ্রিক ক্রোনাস)। ৭ম গ্রহ ইউরেনাস; গ্রিক পুরাণের আদি আকাশ দেবতা (Ouranos)-এর নামানুসারে: রোমান নামও একই। বাংলায় এর কোন পৃথক নাম নেই। ৮ম বা সবশেষ গ্রহ নেপচুন; রোমান সমুদ্র দেবতা নেপচুনের নামে (গ্রিক পোসেইডন)। এরও বাংলা কোন শব্দ নেই। বাংলা অভিধানে ৮ম গ্রহ হিসেবে ‘রাহু’র নাম উল্লেখ করা হয়েছে, যেটি সূর্য-চন্দ্রকে গ্রাস করে, আবার ত্যাগ করে। অন্তর্জালে কোথাও ইউরেনাসকে, কোথাও নেপচুনকে ‘রাহু’ নাম দেয়া হয়েছে, যা ভুল। আসলে বিষয়টি জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত- যে দুই বিন্দুতে চন্দ্রের কক্ষ পৃথিবীর কক্ষতলকে ছেদ করে তার একটির নাম রাহু (North Lunar Node), অপরটির নাম কেতু (South Lunar Node)। হিন্দু পুরাণ মতে এক দানবকে বিষ্ণু তার সুদর্শন চক্র দিয়ে দু টুকরো করে ফেলেছিল, কাটা মুণ্ড অংশের নাম রাহু, ধড় অংশের নাম কেতু। কৃত্তিবাস লিখছেন, ‘চন্দ্রকলা ভ্রমে রাহু করিল কি গ্রাস’। আরেকটি বিষয়- ২০০৬ সালে আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান ইউনিয়ন (IAU) প্লুটো (Pluto)-কে গ্রহ হিসেবে অযোগ্য ঘোষণা করে এবং ‘বামন গ্রহ’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। কারণ আদর্শ গ্রহের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী প্লুটোর মহাকর্ষীয় প্রভাব তার কক্ষপথে ভাগ বসানো ছোট বস্তুগুলিকে (যেমন গ্রহাণু বা ধুমকেতু) অপসারণ বা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। যাহোক প্লটো নামটাও এসেছে রোমান পাতালপুরীর দেবতা প্লটোর নাম থেকে (গ্রিক হেডেস)।

এবারে চলুন ছাদে যাই, মানে চাঁদ দেখি। পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহটি রোমান্টিসিজমের কেন্দ্রবিন্দু, কবি-সাহিত্যিক আর নভঃবিজ্ঞানীদের বিলাসি কল্পনার খোরাক। সংস্কৃতে চন্দ্র শব্দের অর্থ দীপ্ত, কমনীয়।

‘গোকুলচন্দ্রের নখচন্দ্রে চন্দ্র লয় শরণ’, হিন্দুশাস্ত্র মতে চন্দ্র দেবতা বিশেষ। তিনি ব্রহ্মার মানসপুত্র অত্রির চোখের পানি থেকে উৎপন্ন হন। মহাভারতে সমুদ্রমন্থনের ফলে যে বিবিধ রত্ন পাওয়া যায় তন্মধ্যে চন্দ্র প্রথম। মৎস্যপুরাণ অনুসারে দক্ষ প্রজাপতির স্ত্রীর নাম প্রসূতি, তাদের নক্ষত্ররূপিণী ২৭ জন কন্যা। চন্দ্রদেব এই সাতাশ কন্যাকে বিবাহ করেন। রোহিণী দক্ষের ৪র্থ কন্যা। চন্দ্রদেব অন্যান্য স্ত্রীর তুলনায় রোহিণীকে বেশি ভালোবাসতেন, তার প্রতি গভীর আগ্রহ দেখাতেন ও সময় দিতেন, যা তার বাকি সব স্ত্রীর মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে। এ কারণে দক্ষ চন্দ্রকে অভিশাপ দেন ও চন্দ্র যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হন ও ক্ষয়প্রাপ্ত হন। পরে কন্যাগণের প্রার্থনায় দক্ষ এ বর দেন যে ‘চন্দ্রের এক পক্ষে ক্ষয় ও এক পক্ষে বৃদ্ধি হইবে’; যেখান থেকে চন্দ্রকলার সৃষ্টি, শুক্লপক্ষ-কৃষ্ণপক্ষের সৃষ্টি। বলা বাহুল্য, চন্দ্রের একটি প্রতিশব্দ চাঁদ: ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’। চন্দ্র থেকে নিস্তার পাওয়া মুশকিল, এ শব্দের সাথে জড়িয়ে আছে ফুল (চন্দ্রমল্লিকা), অলঙ্কার (চন্দ্রহার), রত্ন (চন্দ্রকান্ত), বংশপদবী (শরৎচন্দ্র/ভারতচন্দ্র), ধ্বনি (চন্দ্রবিন্দু), অস্ত্র (চন্দ্রহাস) ইত্যাদির নাম। Moon শব্দের উৎপত্তি প্রাচীন ইংরেজি mona এবং প্রোটো-জার্মানিক menon থেকে, যা প্রোটো-ইন্দো-ইউরোপীয় mensis (মাস) এর সাথে সম্পর্কিত। Moon শব্দটি গ্রীক বা রোমান পুরাণে সরাসরি কোনও নির্দিষ্ট দেবতা থেকে উদ্ভূত নয়। তবে, এটি পরোক্ষভাবে পৌরাণিক ব্যক্তিত্বের সাথে যুক্ত। গ্রীক পুরাণে Moon-এর দেবী হলেন সেলিন (Selene)। সেলিনের রোমান সমার্থক হলেন লুনা (Luna), যিনি চাঁদের দেবী। পৃথিবী ছাড়াও বিভিন্ন গ্রহের অসংখ্য উপগ্রহ রয়েছে এবং তাদের নামকরণের উৎসও বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেগুলো গ্রিক/রোমান মিথোলজির দেব-দেবীর নামানুসারে। যেমন: বৃহস্পতির Io, Ganymede, শনির Titan, নেপচুনের Triton ইত্যাদি।

 

বাংলা বর্ষপঞ্জিতে আসি। ১৯৫৪ সালে ভারতীয় পঞ্জিকা সংস্কার কমিটির প্রধান ড. মেঘনাদ সাহা অঙ্ক কষে নিশ্চিত ঘোষণা করেছিলেন যে সম্রাট আকবরই বাংলা সনের প্রবর্তক। পরে উড়িষ্যার ইতিহাসবিদ কাশীপ্রসাদ জয়সোবাল এ মতকে সমর্থন করেছিলেন। আইন-ই-আকবরী (আবুল ফজল রচিত) থেকে জানা যায়, আকবর তাঁর রাজত্বের শুরু থেকেই দিন-তারিখ গণনার একটি বিজ্ঞানভিত্তিক, কর্মোপযোগী ও গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি চালুর জন্য বর্ষপঞ্জি সংস্কারের প্রয়োজন অনুভব করেন, যা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবার জন্যই আদর্শ হবে। বাংলা সনের মাধ্যমে তার সে আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয়েছিল। তিনি বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদ আমির ফতুল্লাহ শিরাজীকে প্রচলিত বর্ষপঞ্জিতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাধনের দায়িত্ব অর্পণ করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় ৯৬৩ হিজরির মুহররম মাসের শুরু থেকে বাংলা বর্ষের ৯৬৩ অব্দের সূত্রপাত হয়। যেহেতু ৯৬৩ হিজরির মুহররম মাস বাংলা বৈশাখ মাসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল, সেহেতু চৈত্র মাসের পরিবর্তে বৈশাখ মাসকেই বাংলা বর্ষের প্রথম মাস করা হয়; চৈত্র ছিল শক বর্ষপঞ্জির (শকাব্দ) প্রথম মাস, যা সে সময় বঙ্গে ব্যবহৃত হতো। খ্রিস্টাব্দের হিসাবে ১৫৮৪ সালে প্রবর্তিত নতুন বর্ষপঞ্জিটি প্রথমে তারিখ-ই- এলাহী নামে পরিচিত ছিল; ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ বা ১১ মার্চ এটি বঙ্গাব্দ নামে প্রচলিত হয়। আকবরের সময়ে মাসের প্রতিদিনের জন্য একটি করে স্বতন্ত্র নাম ছিল, কিন্তু এতগুলি নাম মনে রাখা ছিল একটি কষ্টসাধ্য ব্যাপার; তাই সম্রাট শাহজাহান তাঁর ফসলি সনে সেগুলিকে সাপ্তাহিক পদ্ধতিতে রূপান্তরিত করেন। সম্ভবত একজন পর্তুগীজ পণ্ডিতের সহায়তায় তিনি সাত দিনের সমন্বয়ে এই সপ্তাহ-পদ্ধতি চালু করেন। নামকরণ কে করেছিলেন তা নিশ্চিত হওয়া না গেলেও প্রাচীন জ্যোতিষশাস্ত্র, বিশেষ করে হেলেনিস্টিক জ্যোতিষশাস্ত্র এবং সম্ভবত তারও আগের ব্যাবিলনীয় জ্যোতিষশাস্ত্র, প্রাচীন হিন্দু জ্যোতিষগ্রন্থ ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’ (৩৫০-৫০০ খ্রিস্টাব্দ), ‘যোগশাস্ত্র’, এবং ‘ভূগুসংহিতা’-সহ বেশ কিছু গ্রন্থে সপ্তাহের দিনগুলোর নাম ও পর্যায়ের ব্যাখ্যা রয়েছে। নামকরণের এই ধারার ভিত্তি হল ‘হোরাচক্র’ (Hora Chakra) বা ‘গ্রহ হোরার শৃঙ্খলা’। একটি দিন ২৪টি হোরায় বিভক্ত, প্রতিটি হোরায় একটি গ্রহ প্রভাব বিস্তার করে বলে বিশ্বাস করা হয়। এই বিশ্বাস অনুসারে, একটি দিনের প্রতিটি হোরা বা ঘণ্টাকে সৌরজগতের ‘নবগ্রহ’-এর সাতটি গ্রহ (সূর্য, চন্দ্র, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি)-এর মধ্যে একটির প্রভাবাধীন বলে মনে করা হয়; ঐতিহ্যগতভাবে সূর্য ও চাঁদকেও গ্রহ হিসেবে ধরা হয়। চাল্ডিয়ান অর্ডার (Chaldean Order) অনুসারে পরবর্তী গ্রহগুলি পরবর্তী ঘণ্টাগুলির উপর প্রভাব বিস্তার করে। চাল্ডিয়ান অর্ডার এবং সপ্তাহের দিনের ক্রমের মধ্যে সম্পর্কটি মনোযোগ দিয়ে বোঝার বিষয়। গ্রহগুলো তাদের আপাত গতির উপর ভিত্তি করে চাল্ডিয়ান অর্ডার মোতাবেক একটি নির্দিষ্ট ক্রমে সাজানো: শনি, বৃহস্পতি, মঙ্গল, সূর্য, শুক্র, বুধ, চন্দ্র। শনি সবচেয়ে ধীরে চলে বলে মনে করা হতো, এরপর বৃহস্পতি; চন্দ্র সবচেয়ে দ্রুত। এই ক্রমটি planetary hours গণনার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি এবং ২৪ ঘন্টা ধরে পুনরাবর্তিত হতে থাকে। সপ্তাহের দিনগুলোর নামকরণ এবং তাদের ক্রম নির্ধারণের মূল ভিত্তি হলো প্রতিটি দিনের প্রথম হোরা (Planetary Hour)-র অধিপতি গ্রহ। এই অধিপতি গ্রহ চাল্ডিয়ান অর্ডার মেনেই পরপর দিনগুলোর প্রথম হোরাকে প্রভাবিত করে। ধরা যাক, শনিবার দিনের প্রথম হোরা শনি গ্রহের। আগেই বলেছি- একটি দিনে ২৪টি হোরা থাকে এবং চাণ্ডিয়ান অর্ডার অনুযায়ী শনি- বৃহস্পতি মঙ্গল সূর্য শুক্র বুধ চন্দ্র ক্রম অনুযায়ী সেগুলো আবর্তিত হতে থাকে। সুতরাং, শনিবারের শেষ (২৪তম) হোরাটি মঙ্গল গ্রহের। এখন, রবিবার দিনের প্রথম হোরা কোনটি হবে? নিয়ম হলো, একটি দিনের শেষ হোরা যে গ্রহের, তার পরের গ্রহটি হবে পরবর্তী দিনের প্রথম হোরা এবং এই ক্রম চাল্ডিয়ান অর্ডার মেনেই চলবে। শনিবারের শেষ হোরা ছিল মঙ্গল। চাল্ডিয়ান অর্ডারে মঙ্গলের পরের গ্রহ হলো সূর্য। অতএব, রবিবার দিনের প্রথম হোরা হবে সূর্য এবং সেইজন্য দিনটির নাম রবিবার (রবি অর্থ সূর্য, Sun’s day)। একইভাবে, রবিবার দিনের ২৪তম হোরা হবে বুধের এবং সোমবারের প্রথম হোরা হবে চন্দ্রের এবং এই ক্রম চান্ডিয়ান অর্ডার অনুসরণ করে সপ্তাহের বাকি দিনগুলোর নামকরণ নির্ধারণ করে। তাহলে ক্রমটা দাঁড়াচ্ছে:

শনিবার: প্রথম হোরা শনি

রবিবার: প্রথম হোরা সূর্য (শনিবারের শেষ হোরা মঙ্গলের পর)

সোমবার: প্রথম হোরা চন্দ্র (রবিবারের শেষ হোরা বুধের পর)

মঙ্গলবার: প্রথম হোরা মঙ্গল (সোমবারের শেষ হোরা শনির পর)

বুধবার: প্রথম হোরা বুধ (মঙ্গলবারের শেষ হোরা মঙ্গলের পর সূর্য, শুক্র, বুধ)

বৃহস্পতিবার: প্রথম হোরা বৃহস্পতি (বুধবারের শেষ হোরা চন্দ্রের পর শনি, বৃহস্পতি)

শুক্রবার: প্রথম হোরা শুক্র (বৃহস্পতিবারের শেষ হোরা মঙ্গলের পর সূর্য, শুক্র) এই বিশ্বাস অনুযায়ী, কোনো বিশেষ কাজ করার জন্য দিনের সেই নির্দিষ্ট ঘণ্টাটিকে বেছে নেওয়া উচিত যা সেই কাজের প্রকৃতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ গ্রহের প্রভাবাধীন। উদাহরণস্বরূপ, ব্যবসায়িক আলোচনার জন্য বুধের হোরা উপযুক্ত বলে মনে করা হয়, তেমনি ভালোবাসার জন্য শুক্রের হোরা। যদিও আধুনিক বিজ্ঞান এই ধারণাকে সমর্থন করে না, তবে জ্যোতিষশাস্ত্রে planetary hours একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাচীন পদ্ধতি হিসেবে আজও বিবেচিত হয়। বিশেষ করে হোরাারি জ্যোতিষ (Horary Astrolog) নামক প্রশ্নের উত্তর জানার প্রাচীন পদ্ধতিতে এর ব্যবহার দেখা যায়। লক্ষ্যণীয় যে, রোমান নামকরণ পদ্ধতির সঙ্গে সপ্তাহের দিনগুলির মিল রয়েছে, যেমন: Sun (Sunday)-এর সঙ্গে রবির; Moon (Monday)-এর সঙ্গে সোমের; Mars (Tuesday এসেছে রোমান দেবতা Tiw থেকে)-এর সঙ্গে মঙ্গলের; Mercury (Wednesday জার্মানিক দেবতা Woden/Wodan থেকে, যিনি রোমান Mercury-র সমতুল্য)-এর সঙ্গে বুধের: Jupiter (Thursday নর্স বজ্র ও শক্তির দেবতা Thor এর নাম থেকে, রোমান Jupiter-এর সমতুল্য)-এর সঙ্গে বৃহস্পতির; Venus (Friday ভালোবাসা ও সৌন্দর্যের দেবী নর্স দেবী Frigg থেকে, যিনি রোমান Venus এর সমতুল্য)-এর সঙ্গে শুক্রর এবং Saturn (Saturday)-এর সঙ্গে শনির। ধ্রুপদী সংগীতে সপ্তাহের দিনের ভিত্তিতে স্বরবিন্যাস বা ‘রাগ’ নির্বাচন করা হয়। এটি একটি ঐতিহ্যগত ধারণা, যার মধ্যে প্রতিটি দিনের জন্য নির্দিষ্ট একটি রাগ নির্ধারণ করা হয়েছে। এই প্রথাকে ‘দিন-চক্রীয় রাগ’ (Time Theory of Ragas) বলা হয়। এই পদ্ধতি হিন্দি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে গুরুত্বপূর্ণ এবং বহু শতাব্দী ধরে প্রচলিত রয়েছে। উদাহরণ: সোমবার: বিভাস, ভৈরবী, শিবরঞ্জিনী; মঙ্গলবার: বিলাবল, বিহাগ; বুধবার: হিন্দোল, দরবারি কানাড়া, কেদার; বৃহস্পতিবার: দীপক, ভূপালী; শুক্রবার: বাহার, কাফি; শনিবার: শ্রী, মালকৌশ/মালকোষ, যোগীয়া এবং রবিবার: ভৈরব, সূর্যকান্ত, রাগ তোডি। এই রাগগুলো কিছুটা পরিবেশ এবং সঠিক সময়ের ভিত্তিতেও নির্বাচন করা হয়। যেমন: ভৈরবের সময় দিবা ১ম প্রহর, শ্রী রাগের সময় দিবা ৪র্থ প্রহর, মেঘ রাগের সময় রাত্রি ১ম ও ২য় প্রহর, মালকৌশের (কৌশিক) সময় রাত্রি ২য় প্রহর, হিন্দোল রাগের সময় রাত্রি ২য় ও ৩য় প্রহর, দীপক রাগের সময় গ্রীষ্মকালের মধ্যাহ্ন ইত্যাদি। সম্রাট আকবরের দরবারে তানসেন দিনভিত্তিক রাগ গাইতেন বলে ঐতিহাসিক গ্রন্থ ‘আইন-ই-আকবরি’ ও ‘মাআসির-ই-রাহিমি’-তে উল্লেখ আছে। তিনি সাধারণত ভৈরব (রবিবার), কেদার (বুধবার) ইত্যাদি সময়মতো গাইতেন; তবে তিনি দীপক রাগ (রাত্রির রাগ) দিনে গেয়ে আগুন ঝরিয়েছিলেন বলে কিংবদন্তি রয়েছে। ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলী খান, আলাউদ্দিন খাঁ, পণ্ডিত ভীমসেন জোশী, উদয় ভাওয়ালকর-সহ প্রায় সকল ধ্রুপদী শিল্পীই সাধারণত দিনভিত্তিক রাগ পরিবেশনের ঐতিহ্য মেনে চলতেন। তবে মহান শিল্পীরা কখনও কখনও তা অতিক্রম করে গেছেন সংগীত ছিল তাদের কাছে নিয়মের চেয়ে বেশি কিছু। বড়ে গুলাম আলী খান মাঝে মাঝে মালকোষ (শনিবারের রাগ) অন্য দিনে গেয়েছেন।

বাংলা সনের প্রসঙ্গে আবার আসা যাক। বঙ্গাব্দ প্রবর্তনের প্রথমদিকে ১২মাস ফারওয়ারদিন, উর্দিবাহিশ, খোরদাদ, তীর, মুরদাদ, শাহারিবার, মেহের, আবান, আজার, দে, বাহমান এবং ইসফান্দ নামে পরিচিত ছিল। পরবর্তীকালে মাসগুলির নাম কীভাবে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ ইত্যাদি হয় তা জানা যায় নি। অনুমান করা হয় যে, শক রাজবংশের স্মরণার্থে ৭৮ খ্রিস্টাব্দে প্রবর্তিত শকাব্দ থেকে এ নামগুলি এসেছে। বস্তুত এই মাসগুলোর ভিত্তি এবং নামকরণের উৎস প্রাচীন ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যা ও সৌরপঞ্জিকা পদ্ধতির সাথে গভীরভাবে জড়িত। জ্যোতির্বিজ্ঞান অনুসারে সূর্যই সৌরজগতের একমাত্র নক্ষত্র (star)। তবে, প্রাচীন ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যা এবং জ্যোতিষশাস্ত্রে ‘নক্ষত্র’ শব্দটি একটি ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়; নক্ষত্র বলতে চন্দ্রের গতিপথে (ecliptic) ২৭টি বিভাজনকে বোঝায় (প্রতি বিভাজন দ্রাঘিমাংশে = ১৩°২০′)। জ্যোতির্বিদ্যার দৃষ্টিকোণ থেকে নক্ষত্রগুলো আকাশের কল্পিত বিভাগ, যা প্রাচীনকালে জ্যোতির্বিন্যাস এবং পঞ্জিকা তৈরির কাজে সহায়ক ছিল। এগুলি ‘চন্দ্রনিবাস’ নামেও পরিচিত, কারণ চন্দ্র এক দিনে এক নক্ষত্র অতিক্রম করে (≈ ২৭.৩ দিনে সম্পূর্ণ চক্র)। গ্রিক/আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যায় এগুলিকে lunar mansions বা নক্ষত্রমণ্ডল বলা হয়, যা তারামণ্ডল (constellation) থেকে ভিন্ন। জ্যোতিষশাস্ত্রে সূর্যের গতিপথও উক্ত নক্ষত্রমণ্ডলে বিভক্ত। সূর্য এক নক্ষত্রে -১৩.৩৩ দিন থাকে (৩৬০০+২৭ ১৩°২০′ প্রতি নক্ষত্র)। এই প্রবেশকালই বাংলা মাসের নামের উৎস। অর্থাৎ বঙ্গাব্দের মাসের নামগুলির ভিত্তি এই কাল্পনিক নক্ষত্রসমূহ। সূর্য যখন যে নক্ষত্রে অবস্থান করে, সেই মাসের নামকরণ সেই নক্ষত্রের নামে রাখা হয়। সূর্যের এক নক্ষত্র থেকে অন্য নক্ষত্রে প্রবেশ এবং সেই নক্ষত্রে অবস্থানের সময়কাল মিলেই একটি বাংলা মাস তৈরি হয়। বাংলা ১২ মাসের নাম, নক্ষত্রসঙ্গতি এবং নামকরণের উৎস এক নজরে দেখে নেয়া যাক:

বৈশাখ: সূর্য বিশাখা নক্ষত্রে প্রবেশ করে এই সময়। বিশাখা মানে ‘দ্বিগ্রাহী’ (যেখানে দুইটি তারা নক্ষত্র)। জৈষ্ঠ্য: সূর্য জ্যেষ্ঠা নক্ষত্রে প্রবেশ করে। ‘জ্যেষ্ঠা’ মানে ‘প্রবীণ’ বা ‘বড়’-এটি এক নক্ষত্রের নাম। আষাঢ়: সূর্য পূর্বাষাঢ়া নক্ষত্রে প্রবেশ করে। ‘আষাঢ়া’ শব্দের অর্থ: উজ্জ্বলতা বা প্রতাপ। শ্রাবণ: সূর্য শ্রবণা নক্ষত্রে অবস্থান করে। ‘শ্রবণা’ শব্দের মানে: শোনা বা শ্রবণীয়।

ভাদ্র: ‘ভদ্রপদা’ দুইটি নক্ষত্র (পূর্বভাদ্রপদ ও উত্তরভাদ্রপদ) থেকে এসেছে। ‘ভদ্র’ অর্থ শুভ, ‘পদ’ অর্থ পা বা অঙ্গ।

আশ্বিন: ‘অশ্বিনী’ নক্ষত্রে সূর্য অবস্থান করে। অশ্বিনী মানে ‘ঘোড়া’-এটি দুটি দেবতাভ্রাতার নাম (অশ্বিনী কুমার)।
কার্তিক: ‘কৃত্তিকা’ নক্ষত্রে’ সূর্য প্রবেশ করে। এটি অগ্নিদেবের নক্ষত্র; ‘কার্তিকেয়’র নামানুসারেও এই নাম।

অগ্রহায়ণ: ‘অগ্র’ অর্থ প্রথম, ‘হায়ণ’ মানে বছর। একসময় এটি বছরের প্রথম মাস ছিল, যখন প্রধান ফসল

ধান কাটা হতো। একমাত্র মাস যা কোন নক্ষত্রের নামানুসারে নয়।

পৌষ: ‘পুষ্যা’ নক্ষত্রে সূর্য থাকে। ‘পুষ্য’ মানে পুষ্টিকর, যা বৃদ্ধি করে।

মাঘ: ‘মঘা’ নক্ষত্রে সূর্য থাকে। ‘মঘা’ মানে শক্তিশালী বা সম্মানিত।

ফাল্গুন: সূর্য ফাল্গুনী নক্ষত্রে প্রবেশ করে (পূর্বফাল্গুনী ও উত্তরফাল্গুনী)। ফাল্গুন মানে ‘উজ্জ্বলতা’ বা ‘সৌন্দর্য’। চৈত্র: ‘চিত্রা’ নক্ষত্রে সূর্য থাকে। ‘চিত্রা’ মানে সুসজ্জিত বা অলঙ্কৃত।

এই নক্ষত্র এবং মাসভিত্তিক বিভাজন প্রাচীন ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যা গ্রন্থ যেমন বেদাঙ্গ জ্যোতিষ এবং পরবর্তীকালের সূর্যসিদ্ধান্ত ও পঞ্চসিদ্ধান্তিকায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। তিথি, নক্ষত্র, যোগ এবং করণের ব্যবহার ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে গৃহ্যসূত্র ও ধর্মসূত্রতেও বিস্তারিতভাবে বর্ণিত আছে। ময়মনসিংহ গীতিকাতেও পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষের প্রভাব দেখা যায়।

ষড়ঋতুর নামের দিকে নজর দিলে দেখা যায় সেখানে সরাসরি কোনো নক্ষত্রের প্রভাব নেই। ঋতুর নামকরণ মূলত প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য, আবহাওয়ার পরিবর্তন এবং মানুষের জীবনযাত্রার সাথে তার সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে রচিত। প্রতিটি নামের মধ্যেই সেই নির্দিষ্ট ঋতুর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও তাৎপর্য নিহিত রয়েছে। তবে ঋতুর নামগুলি সংস্কৃত শব্দ থেকে উদ্ভূত, যা প্রকৃতির পরিবর্তনকে নির্দেশ করে: গ্রীষ্ম তাপ (‘গ্রস্’ ধাতু), বর্ষা = বৃষ্টি (‘বৃষ’ ধাতু), শরৎ = পরিষ্কার আকাশ (‘শৃ’ ধাতু), হেমন্ত হিমের শুরু (‘হিম’), শীত শৈত্য (‘শী’ ধাতু) ও বসন্ত = প্রাণের বিকাশ (‘বস’ ধাতু)। কিছু ঋতু-উৎসবে দেবতাদের উপাসনা জড়িত: বসন্ত = কামদেবের পূজা (হোলি উৎসব); বর্ষা ইন্দ্রের বৃষ্টির দেবতা হিসেবে আবাহন। কিন্তু ঋতুর নাম ইন্দ্র, কামদেব ইত্যাদির নামে নয়। আমরা বসন্তকে ‘ঋতুরাজ’ বলে থাকি, কিন্তু সংস্কৃত কাব্যে শরৎকে ঋতুরাজ বলা হতো, কারণ এর মৃদু আবহাওয়া কবি-সাহিত্যিকদের প্রিয়।

ইউনেস্কো (UNESCO) ২০১৬ সালের ৩০শে নভেম্বর ইথিওপিয়ার আদিস আবাবায় অনুষ্ঠিত ১১তম সভায় বাংলাদেশের পহেলা বৈশাখের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’কে ‘মানবতার বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ (Intangible Cultural Heritage of Humanity) হিসাবে তালিকাভুক্ত (Inscription) করে (11.COM)। তৎকালীন ইউনেস্কো ডিজি ইরিনা বোকোভা বলেছিলেন, ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সংস্কৃতি হলো মানুষের অন্তরের ভাষা।’ ইউনেস্কোর অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ভিজিট করলেই দেখা যায় ‘Mangal Shobhajatra on Pahela Baishakh’ শিরোনামের নিচে লেখা আছে (অনুবাদ), ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা উৎসব বাংলাদেশের জনগণের লোকঐতিহ্যের জন্য গর্বের প্রতীক, সেই সাথে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার শক্তি ও সাহস এবং সত্য ও ন্যায়ের প্রতি তাদের সমর্থনের প্রতীক। এটি গণতন্ত্রের জন্য সংহতি এবং একটি ভাগাভাগি করে নেয়া মূল্যবোধেরও প্রতিনিধিত্ব করে, যা জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ বা বয়স নির্বিশেষে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে।’ ইউনেস্কোর স্বীকৃতি প্রমাণ করে যে, পহেলা বৈশাখের শোভাযাত্রা কেবল একটি উৎসব নয়, বরং বাঙালির সহনশীলতা, সৃজনশীলতা ও ঐক্যের জীবন্ত দলিল। এটি বিশ্বকে শিক্ষা দেয় কীভাবে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য শান্তি ও সম্প্রীতির হাতিয়ার হতে পারে। ইসলামি শরিয়াহ ও সংস্কৃতিতে চান্দ্রবর্ষ (হিজরি সাল) প্রাধান্য পায়, তবে কিছু ক্ষেত্রে সৌরবর্ষও ব্যবহার করা হয়। ইসলামি জীবনব্যবস্থায় সৌরবর্ষ (Gregorian Calendar) এবং চান্দ্রবর্ষ (Hijri Calendar) উভয়েরই আলাদা প্রভাব রয়েছে এবং এর মাধ্যমে অনেক দিক-নির্দেশনা পাওয়া যায়। নতুন চাঁদ দেখার মাধ্যমেই হিজরি মাস শুরু হয় এবং তারিখগুলো সৌরবর্ষের তুলনায় প্রতি বছর প্রায় ১০-১১ দিন এগিয়ে আসে। রমজান মাসের রোজা, ঈদ-উল-ফিতর, ঈদ-উল-আযহা, হজ্ব, ১০ই মহররম এবং অন্যান্য ইসলামিক পর্ব ও তারিখ হিজরি সালের চাঁদের ওপর নির্ভরশীল। আবার ৫ ওয়াক্ত নামাযের সময়সূচি সৌরদিনের সাথে সম্পর্কিত। যেমন: ফজরের নামায সূর্যোদয়ে আগে, মাগরিবের নামায সূর্যাস্তের পরপর ইত্যাদি। এমনকি নামাযের নিষিদ্ধ সময় সম্পূর্ণরূপে সৌরসময়ের দ্বারা নির্ধারিত। দিনের ৩ সময় নামায পড়া নিষিদ্ধ: সূর্যোদয়ের সময়, সূর্য যখন ঠিক মাথার উপর (উল্লম্বভাবে) থাকে এবং সূর্যাস্তের সময়। এইভাবে, ইসলামি জীবনব্যবস্থায় উভয় ক্যালেন্ডারের প্রভাব রয়েছে এবং তারা একে অপরকে পরিপূরক হিসেবে কাজ করে।

বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী। অন্যান্য প্রধান ধর্ম হিন্দু, খ্রিস্ট, বৌদ্ধ ও শিখধর্ম। বাংলাদেশের মুসলমানদের পরিচয় ‘বাঙালি মুসলমান’-এটি একটি অনন্য সাংস্কৃতিক সমন্বয়, যেখানে বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্য ও ইসলামের বিশ্বজনীন মূল্যবোধ একাকার। এই দ্বৈত পরিচয় ধারণের পথে কিছু চ্যালেঞ্জ থাকলেও, এর মাঝেই নিহিত রয়েছে বাংলাদেশের সমৃদ্ধির চাবিকাঠি। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে (১২০১-১৮০০) রচিত বিভিন্ন ‘মঙ্গলকাব্য’ আমাদের অমূল্য সম্পদ। উদাহরণ: মনসামঙ্গল (রচয়িতা: বিজয়গুপ্ত, বিপ্রদাস পিপলাই), চণ্ডীমঙ্গল (রচয়িতা: মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, কবিকঙ্কণ), অন্নদামঙ্গল (রচয়িতা: ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর) ইত্যাদি। মঙ্গল শব্দটি শুভফলপ্রদানকারী দেবতার গাথা বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। আবার একই সময়ে কবি আলাওল রচিত ‘পদ্মাবতী’, ‘সেকান্দরনামা’, দৌলত কাজী রচিত ‘সতী ময়না ও লোর চন্দ্রানী’, শেখ ফয়জুল্লাহ প্রণীত ‘গোরক্ষ বিজয়’, ফকীর গরিবুল্লাহ রচিত ‘জঙ্গানামা’, শাহ মুহম্মদ সগীর রচিত ‘ইউসুফ-জোলেখা’ প্রভৃতি আমাদের সাহিত্যভাণ্ডরকে সমৃদ্ধ করেছে। একই ব্যাপ্তিকালে (১৪ শতকে) সুফি সাধকরা যেমন: হযরত শাহ জালাল (র.), শাহ পরান (র.), খান জাহান আলী (র.) বঙ্গদেশে ইসলাম প্রচার করেছেন। লালন ফকির, হাসন রাজার গানে ইসলাম ও বাঙালিত্বের মেলবন্ধন ঘটেছে, যাকে সিনক্রেটিজম (Syncretism) বলা যেতে পারে। বাউল, মরমি/মুর্শিদি, মাইজভাণ্ডারি ইত্যাদি গানে আল্লাহ-প্রেমের প্রকাশ ঘটেছে। কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা ভাষায় ইসলামি সাহিত্য চর্চা করেছেন; আরবি, ফার্সি, তুর্কি শব্দ বেশুমার ব্যবহার করেছেন। আবার একই সাথে তিনি প্রচুর কীর্তনও রচনা করেছেন। তাই তো তিনি আমাদের জাতীয় কবি। পাকিস্তানি শাসনামলে ‘বাঙালি’ পরিচয়কে ইসলামি সংস্কৃতির বিরোধী করে তোলার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন প্রমাণ করে দেয় যে বাঙালি মুসলমানের পরিচয়ে মাতৃভাষার গুরত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশে সকল ধর্মাবলম্বীর সহাবস্থানের জন্য বাঙালিত্বের সাধারণ ভিত্তি প্রয়োজন। পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন তেমন একটা সাধারণ ভিত্তি। বহুভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বলেছিলেন, ‘মুসলমান হিসাবে আমার ধর্ম ইসলাম, কিন্তু বাঙালি হিসাবে আমার সংস্কৃতি বাংলা। এ দুটিকে আলাদা করলে আমি অর্ধেক হয়ে যাব।’ বাংলাদেশের মুসলমানদের জন্য বাঙালিত্ব ও ইসলাম পরস্পরবিরোধী নয়-এটি একটি সম্পূরক সম্পর্ক। এই সমন্বয়ই বাংলাদেশকে একটি অনন্য রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তুলেছে, যেখানে ধর্মীয় অনুশাসন ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা পাশাপাশি বিরাজ করে। লেখাটা যে উক্তি দিয়ে শুরু করেছিলাম তার অবশিষ্টাংশ দিয়ে শেষ করি। মওলানা ভাসানী আরো বলেছিলেন ‘তোমরা ধর্মের সাথে বাঙালি সংস্কৃতি একত্র করতে যেও না’।

গীতিকার এবং প্রবন্ধকার

baizid.romana@gmail.com

ইরান ইউরেনিয়াম সরিয়ে নিয়েছে এমন কোনো গোয়েন্দা তথ্য নেই: মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী

অপরাপর মঙ্গলের কী হবে

০৩:১০:৫৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল ২০২৫

বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ

‘ইচ্ছে করলেই কৃষ্ণচূড়া গাছটার নাম ফাতেমাচূড়া হবে না’- মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী বলেছিলেন। রবিঠাকুর নামকে লাউয়ের বোঁটার সাথে তুলনা করেছিলেন। তিনি তখন ‘বিচিত্রা’ সাময়িকীতে ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে লিখছিলেন। প্রথম দুই সংখ্যায় উপন্যাসটির নাম ছিল ‘তিন পুরুষ’। তৃতীয়বারে কবি এর নাম দেন ‘যোগাযোগ’। এর কৈফিয়ত দিতে গিয়ে কবি লেখেন, ‘ব্যক্তিসম্বন্ধে মানুষের নাম তার বিশেষণ নয়, সম্বোধন মাত্র। লাউয়ের বোঁটা নিয়ে লাউয়ের বিচার কেউ করে না, ওটাতে ধরবার সুবিধে। যার নাম দিয়েছি সুশীল তার শীলতা নিয়ে আমার কোন জবাবদিহি নেই।’ এবারের পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। মঙ্গল শব্দটি প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা থেকে বিবর্তিত হয়ে সংস্কৃত ভাষা থেকে এসেছে (মন্‌গ্‌+অল (অলচ্)+অ(অচ্)}। এর অর্থ সাধারণের জানা- শুভ, ভালো, উপকার, কল্যাণ, প্রশন্ত ইত্যাদি। সমাসের হিসেবে ‘মঙ্গল সূচক যে শোভাযাত্রা’ তাকে মঙ্গল শোভাযাত্রা বলা যেতে পারে। অভিধানে মঙ্গল বলতে প্রশস্ত কর্মের অনুষ্ঠান এবং অপ্রশস্ত কর্মের বিসর্জনকেও বোঝানো হয়েছে, যা নববর্ষের দ্যোতনার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। কিন্তু বাধ সেধেছে মঙ্গল শব্দের আরেকটি অর্থ। অর্থটি হচ্ছে হিন্দু দেবদেবীর মাহাত্ম্য বিষয়ক কাব্য বা পালা গান (যেমন মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল)। আবার মঙ্গলের স্ত্রীবাচক শব্দ মঙ্গলা, অর্থ মঙ্গলদায়িনী, শুভঙ্করী; হিন্দু ধর্ম মতে তিনি দুর্গাদেবী।

কিন্তু মুশকিল হচ্ছে মঙ্গল শব্দটি শুধু বাংলা নববর্ষের পয়লা দিনের শোভাযাত্রার সাথে জড়িয়ে নেই। এটি সহ আরো অনেক বাংলা শব্দ জড়িয়ে আছে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও বাঙালি সংস্কৃতির উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অনুষঙ্গের সাথে এবং একই সাথে বিভিন্ন দেব-দেবীর নামের বা বৈশিষ্ট্যের সাথে। এদের ইংরেজি শব্দও অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধর্ম বা পুরাণ (mythology)-এর দেব-দেবীর সাথে সম্পর্কিত। এক এক করে আসি। প্রথমে মহাকাশের দিকে তাকাই। সৌরজগতের কেন্দ্রীয় নক্ষত্র (সূর্য) এবং তার ৮টি গ্রহের নামের উৎস (etymology) খেয়াল করি। সূর্য শব্দটা এসেছে সংস্কৃত ‘সূর্য’ (Sürya) থেকে, যার অর্থ ‘বীর’ বা ‘শক্তিশালী’। সূর্য হিন্দু সৌরদেবতার নাম, যিনি শক্তির প্রতীক। যদিও বৈদিক যুগে (খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০-৫ম শতাব্দী) আরও বেশ কিছু দেবতারও সৌর বৈশিষ্ট্য ছিল, পরবর্তী হিন্দু ধর্মে এদের বেশিরভাগই একক দেবতায় মিশে গিয়েছিল। একসময় সূর্যকে বিষ্ণু, শিব, শক্তি এবং গণেশের সাথে স্থান দেওয়া হয়েছিল। এই পাঁচ দেবতাকে ব্রাহ্মণ (পুরোহিত) স্মার্তদের একটি দল পূজা করে, তবে শুধুমাত্র একটি ছোট দল, সৌর সম্প্রদায়, সূর্যকে সর্বোচ্চ দেবতা হিসাবে পূজা করে। তবে, বেশিরভাগ হিন্দুই তাঁর কাছে সাহায্যপ্রার্থী এবং অনেক হিন্দু প্রতিদিন ভোরে সূর্যকে সম্বোধন করে গায়ত্রী মন্ত্র উচ্চারণ করে। সূর্যের ইংরেজি Sun, যার উৎস প্রোটো-জার্মানিক ভাষা থেকে উৎপন্ন প্রাচীন ইংরেজি sunne: ডাচ zon এবং জার্মান Sonne এর সাথে সম্পর্কিত, গ্রীক helios এবং ল্যাটিন sol দ্বারা বিভক্ত একটি ইন্দো-ইউরোপীয় শব্দধাতু থেকে। গ্রীক শব্দ helios এর অর্থ ‘সূর্য’, ‘সূর্যের রশ্মি’ বা ‘দিনের আলো’; এটি বাইবেলে পাওয়া যায় এবং একটি গ্রীক পৌরাণিক চরিত্রের নামও। ল্যাটিন শব্দ sol এর অর্থ ‘সূর্য’- সূর্যের রোমান দেবতাকে নির্দেশ করে থাকে।

সূর্য থেকে যদি দূরে যেতে থাকি তবে ক্রমানুযায়ী ৮টি গ্রহ: (১) বুধ (Mercury), (২) শুক্র (Venus), (৩) পৃথিবী (Earth), (৪) মঙ্গল (Mars), (৫) বৃহস্পতি (Jupiter), (৬) শনি (Saturn), (৭) ইউরেনাস (Uranus) ও (৮) নেপচুন (Neptune)। ‘বুধ’ শব্দটি সংস্কৃত ‘বুধ’ থেকে এসেছে, যা ‘বুদ্ধি’ বা ‘জ্ঞান’ নির্দেশ করে। হিন্দু জ্যোতিষে বৃহস্পতির পুত্র বুধকে জ্ঞান ও বুদ্ধির দেবতা বলে গণ্য করা হয়। Mercury নামটি রোমান মিথোলজির বাণিজ্য ও যোগাযোগের দেবতা মার্কারির নামানুসারে রাখা হয়েছে। মার্কারির পাখাযুক্ত পাদুকা আছে, ফলে তিনি খুব দ্রুতগামী। কক্ষপথে বুধের দ্রুত ঘূর্ণনের সাথে মিল রেখে এই নামকরণ করা হয়েছে। গ্রিক পুরাণে এর সমতুল্য হার্মিস। সংস্কৃতে শুক্র অর্থ ‘শুক্ল’-‘উজ্জ্বল’ বা ‘দীপ্যমান’। গ্রহের নামটি এসেছে হিন্দু পুরাণের দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের নাম থেকে। শুক্র শব্দের আরেক অর্থ ‘বীর্য’; বীর্যের উপাদান শুক্রাণু। বামনপুরাণে বলা হয়েছে, ‘রুদ্রস্য শুক্রদ্বারেণ নির্গতত্বাৎ শুক্রঃ’; শিব সন্তুষ্টচিত্তে তাকে শিশ্নপথে নিঃসরণ করেছিলেন, সেই থেকে তার নাম শুক্র। তাই তিনি সৌন্দর্য ও প্রেমের প্রতীক। শুক্র গহের আরেক নাম ‘শুকতারা’, আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারা। Venus রোমান প্রেম ও সৌন্দর্যের দেবী ভেনাসের নামে। গ্রিক পুরাণে এর সমতুল্য আফ্রোদিতি। ৩য় গ্রহ প্রাণিজগতের জীবনধারণের জন্য উপযোগী একমাত্র গ্রহ- পৃথিবী। এ শব্দটিও সংস্কৃত থেকে উদ্ভুত; সংস্কৃত পৃথ্বী অর্থ ‘বিস্তীর্ণ’, এটি ভূমির প্রতীক। Earth শব্দের উদ্ভব প্রাচীন ইংরেজি eor(th)e এবং প্রোটো-জার্মানিক erthō থেকে, যার অর্থ ‘মাটি’ বা ‘জমি’। বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষাতেই এটি একমাত্র গ্রহ যার নাম হিন্দু, গ্রিক, রোমান বা অন্য কোনো দেবতার নামে নয়। এবারে সেই মঙ্গল, যার ব্যুৎপত্তি আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। ইংরেজি Mars রোমান যুদ্ধের দেবতা মার্সের নামে। গ্রিক পুরাণে এর সমতুল্য অ্যারেস (Ares)। মঙ্গলের পৃষ্ঠ কমলা-লাল রঙের, কারণ এটি আয়রন (Ferric) অক্সাইডের ধুলো দিয়ে ঢাকা, যা এটিকে ‘কমলা গ্রহ’ উপাধি দিয়েছে। ৫ম গ্রহটি বৃহতের পতি, মানে বৃহস্পতি, সংস্কৃত জাত। হিন্দু পৌরাণিক দেবতা বৃহস্পতি দেবতাদের গুরু (সুরাচার্য) এবং জ্ঞান ও প্রজ্ঞার প্রতীক। সৌরজগতের বৃহত্তম গ্রহ হওয়ায় সম্ভবত এই দেবতার নামে নামকরণ করা হয়েছে। Jupiter নামটি রোমান মিথোলজির প্রধান দেবতা জুপিটারের নামানুসারে রাখা হয়েছে। জুপিটার আকাশ ও বজ্রের দেবতা এবং দেবতাদের রাজা। গ্রীক নাম ‘জিউস’ (Zeus), যার অর্থ ‘আকাশের পিতা’। শনি সংস্কৃত শনৈশ্চর থেকে এসেছে। হিন্দু জ্যোতিষ অনুযায়ী শনি সূর্যের পুত্র এবং যম তার অধিদেবতা। শনি কৃষ্ণবস্ত্রধারী ও কামসূত্রকার, শকুন তার বাহন; তাকে অশুভকারী দেবতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শনির শুভদৃষ্টি বা কোপদৃষ্টি উভয়ই অনিষ্টকর, ফলে শনির দশা বলতে অতিশয় দুঃসময়কে বোঝানো হয়ে থাকে। Saturn রোমান কৃষি ও সময়ের দেবতা (গ্রিক ক্রোনাস)। ৭ম গ্রহ ইউরেনাস; গ্রিক পুরাণের আদি আকাশ দেবতা (Ouranos)-এর নামানুসারে: রোমান নামও একই। বাংলায় এর কোন পৃথক নাম নেই। ৮ম বা সবশেষ গ্রহ নেপচুন; রোমান সমুদ্র দেবতা নেপচুনের নামে (গ্রিক পোসেইডন)। এরও বাংলা কোন শব্দ নেই। বাংলা অভিধানে ৮ম গ্রহ হিসেবে ‘রাহু’র নাম উল্লেখ করা হয়েছে, যেটি সূর্য-চন্দ্রকে গ্রাস করে, আবার ত্যাগ করে। অন্তর্জালে কোথাও ইউরেনাসকে, কোথাও নেপচুনকে ‘রাহু’ নাম দেয়া হয়েছে, যা ভুল। আসলে বিষয়টি জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত- যে দুই বিন্দুতে চন্দ্রের কক্ষ পৃথিবীর কক্ষতলকে ছেদ করে তার একটির নাম রাহু (North Lunar Node), অপরটির নাম কেতু (South Lunar Node)। হিন্দু পুরাণ মতে এক দানবকে বিষ্ণু তার সুদর্শন চক্র দিয়ে দু টুকরো করে ফেলেছিল, কাটা মুণ্ড অংশের নাম রাহু, ধড় অংশের নাম কেতু। কৃত্তিবাস লিখছেন, ‘চন্দ্রকলা ভ্রমে রাহু করিল কি গ্রাস’। আরেকটি বিষয়- ২০০৬ সালে আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান ইউনিয়ন (IAU) প্লুটো (Pluto)-কে গ্রহ হিসেবে অযোগ্য ঘোষণা করে এবং ‘বামন গ্রহ’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। কারণ আদর্শ গ্রহের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী প্লুটোর মহাকর্ষীয় প্রভাব তার কক্ষপথে ভাগ বসানো ছোট বস্তুগুলিকে (যেমন গ্রহাণু বা ধুমকেতু) অপসারণ বা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। যাহোক প্লটো নামটাও এসেছে রোমান পাতালপুরীর দেবতা প্লটোর নাম থেকে (গ্রিক হেডেস)।

এবারে চলুন ছাদে যাই, মানে চাঁদ দেখি। পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহটি রোমান্টিসিজমের কেন্দ্রবিন্দু, কবি-সাহিত্যিক আর নভঃবিজ্ঞানীদের বিলাসি কল্পনার খোরাক। সংস্কৃতে চন্দ্র শব্দের অর্থ দীপ্ত, কমনীয়।

‘গোকুলচন্দ্রের নখচন্দ্রে চন্দ্র লয় শরণ’, হিন্দুশাস্ত্র মতে চন্দ্র দেবতা বিশেষ। তিনি ব্রহ্মার মানসপুত্র অত্রির চোখের পানি থেকে উৎপন্ন হন। মহাভারতে সমুদ্রমন্থনের ফলে যে বিবিধ রত্ন পাওয়া যায় তন্মধ্যে চন্দ্র প্রথম। মৎস্যপুরাণ অনুসারে দক্ষ প্রজাপতির স্ত্রীর নাম প্রসূতি, তাদের নক্ষত্ররূপিণী ২৭ জন কন্যা। চন্দ্রদেব এই সাতাশ কন্যাকে বিবাহ করেন। রোহিণী দক্ষের ৪র্থ কন্যা। চন্দ্রদেব অন্যান্য স্ত্রীর তুলনায় রোহিণীকে বেশি ভালোবাসতেন, তার প্রতি গভীর আগ্রহ দেখাতেন ও সময় দিতেন, যা তার বাকি সব স্ত্রীর মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে। এ কারণে দক্ষ চন্দ্রকে অভিশাপ দেন ও চন্দ্র যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হন ও ক্ষয়প্রাপ্ত হন। পরে কন্যাগণের প্রার্থনায় দক্ষ এ বর দেন যে ‘চন্দ্রের এক পক্ষে ক্ষয় ও এক পক্ষে বৃদ্ধি হইবে’; যেখান থেকে চন্দ্রকলার সৃষ্টি, শুক্লপক্ষ-কৃষ্ণপক্ষের সৃষ্টি। বলা বাহুল্য, চন্দ্রের একটি প্রতিশব্দ চাঁদ: ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’। চন্দ্র থেকে নিস্তার পাওয়া মুশকিল, এ শব্দের সাথে জড়িয়ে আছে ফুল (চন্দ্রমল্লিকা), অলঙ্কার (চন্দ্রহার), রত্ন (চন্দ্রকান্ত), বংশপদবী (শরৎচন্দ্র/ভারতচন্দ্র), ধ্বনি (চন্দ্রবিন্দু), অস্ত্র (চন্দ্রহাস) ইত্যাদির নাম। Moon শব্দের উৎপত্তি প্রাচীন ইংরেজি mona এবং প্রোটো-জার্মানিক menon থেকে, যা প্রোটো-ইন্দো-ইউরোপীয় mensis (মাস) এর সাথে সম্পর্কিত। Moon শব্দটি গ্রীক বা রোমান পুরাণে সরাসরি কোনও নির্দিষ্ট দেবতা থেকে উদ্ভূত নয়। তবে, এটি পরোক্ষভাবে পৌরাণিক ব্যক্তিত্বের সাথে যুক্ত। গ্রীক পুরাণে Moon-এর দেবী হলেন সেলিন (Selene)। সেলিনের রোমান সমার্থক হলেন লুনা (Luna), যিনি চাঁদের দেবী। পৃথিবী ছাড়াও বিভিন্ন গ্রহের অসংখ্য উপগ্রহ রয়েছে এবং তাদের নামকরণের উৎসও বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেগুলো গ্রিক/রোমান মিথোলজির দেব-দেবীর নামানুসারে। যেমন: বৃহস্পতির Io, Ganymede, শনির Titan, নেপচুনের Triton ইত্যাদি।

 

বাংলা বর্ষপঞ্জিতে আসি। ১৯৫৪ সালে ভারতীয় পঞ্জিকা সংস্কার কমিটির প্রধান ড. মেঘনাদ সাহা অঙ্ক কষে নিশ্চিত ঘোষণা করেছিলেন যে সম্রাট আকবরই বাংলা সনের প্রবর্তক। পরে উড়িষ্যার ইতিহাসবিদ কাশীপ্রসাদ জয়সোবাল এ মতকে সমর্থন করেছিলেন। আইন-ই-আকবরী (আবুল ফজল রচিত) থেকে জানা যায়, আকবর তাঁর রাজত্বের শুরু থেকেই দিন-তারিখ গণনার একটি বিজ্ঞানভিত্তিক, কর্মোপযোগী ও গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি চালুর জন্য বর্ষপঞ্জি সংস্কারের প্রয়োজন অনুভব করেন, যা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবার জন্যই আদর্শ হবে। বাংলা সনের মাধ্যমে তার সে আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয়েছিল। তিনি বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদ আমির ফতুল্লাহ শিরাজীকে প্রচলিত বর্ষপঞ্জিতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাধনের দায়িত্ব অর্পণ করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় ৯৬৩ হিজরির মুহররম মাসের শুরু থেকে বাংলা বর্ষের ৯৬৩ অব্দের সূত্রপাত হয়। যেহেতু ৯৬৩ হিজরির মুহররম মাস বাংলা বৈশাখ মাসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল, সেহেতু চৈত্র মাসের পরিবর্তে বৈশাখ মাসকেই বাংলা বর্ষের প্রথম মাস করা হয়; চৈত্র ছিল শক বর্ষপঞ্জির (শকাব্দ) প্রথম মাস, যা সে সময় বঙ্গে ব্যবহৃত হতো। খ্রিস্টাব্দের হিসাবে ১৫৮৪ সালে প্রবর্তিত নতুন বর্ষপঞ্জিটি প্রথমে তারিখ-ই- এলাহী নামে পরিচিত ছিল; ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ বা ১১ মার্চ এটি বঙ্গাব্দ নামে প্রচলিত হয়। আকবরের সময়ে মাসের প্রতিদিনের জন্য একটি করে স্বতন্ত্র নাম ছিল, কিন্তু এতগুলি নাম মনে রাখা ছিল একটি কষ্টসাধ্য ব্যাপার; তাই সম্রাট শাহজাহান তাঁর ফসলি সনে সেগুলিকে সাপ্তাহিক পদ্ধতিতে রূপান্তরিত করেন। সম্ভবত একজন পর্তুগীজ পণ্ডিতের সহায়তায় তিনি সাত দিনের সমন্বয়ে এই সপ্তাহ-পদ্ধতি চালু করেন। নামকরণ কে করেছিলেন তা নিশ্চিত হওয়া না গেলেও প্রাচীন জ্যোতিষশাস্ত্র, বিশেষ করে হেলেনিস্টিক জ্যোতিষশাস্ত্র এবং সম্ভবত তারও আগের ব্যাবিলনীয় জ্যোতিষশাস্ত্র, প্রাচীন হিন্দু জ্যোতিষগ্রন্থ ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’ (৩৫০-৫০০ খ্রিস্টাব্দ), ‘যোগশাস্ত্র’, এবং ‘ভূগুসংহিতা’-সহ বেশ কিছু গ্রন্থে সপ্তাহের দিনগুলোর নাম ও পর্যায়ের ব্যাখ্যা রয়েছে। নামকরণের এই ধারার ভিত্তি হল ‘হোরাচক্র’ (Hora Chakra) বা ‘গ্রহ হোরার শৃঙ্খলা’। একটি দিন ২৪টি হোরায় বিভক্ত, প্রতিটি হোরায় একটি গ্রহ প্রভাব বিস্তার করে বলে বিশ্বাস করা হয়। এই বিশ্বাস অনুসারে, একটি দিনের প্রতিটি হোরা বা ঘণ্টাকে সৌরজগতের ‘নবগ্রহ’-এর সাতটি গ্রহ (সূর্য, চন্দ্র, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি)-এর মধ্যে একটির প্রভাবাধীন বলে মনে করা হয়; ঐতিহ্যগতভাবে সূর্য ও চাঁদকেও গ্রহ হিসেবে ধরা হয়। চাল্ডিয়ান অর্ডার (Chaldean Order) অনুসারে পরবর্তী গ্রহগুলি পরবর্তী ঘণ্টাগুলির উপর প্রভাব বিস্তার করে। চাল্ডিয়ান অর্ডার এবং সপ্তাহের দিনের ক্রমের মধ্যে সম্পর্কটি মনোযোগ দিয়ে বোঝার বিষয়। গ্রহগুলো তাদের আপাত গতির উপর ভিত্তি করে চাল্ডিয়ান অর্ডার মোতাবেক একটি নির্দিষ্ট ক্রমে সাজানো: শনি, বৃহস্পতি, মঙ্গল, সূর্য, শুক্র, বুধ, চন্দ্র। শনি সবচেয়ে ধীরে চলে বলে মনে করা হতো, এরপর বৃহস্পতি; চন্দ্র সবচেয়ে দ্রুত। এই ক্রমটি planetary hours গণনার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি এবং ২৪ ঘন্টা ধরে পুনরাবর্তিত হতে থাকে। সপ্তাহের দিনগুলোর নামকরণ এবং তাদের ক্রম নির্ধারণের মূল ভিত্তি হলো প্রতিটি দিনের প্রথম হোরা (Planetary Hour)-র অধিপতি গ্রহ। এই অধিপতি গ্রহ চাল্ডিয়ান অর্ডার মেনেই পরপর দিনগুলোর প্রথম হোরাকে প্রভাবিত করে। ধরা যাক, শনিবার দিনের প্রথম হোরা শনি গ্রহের। আগেই বলেছি- একটি দিনে ২৪টি হোরা থাকে এবং চাণ্ডিয়ান অর্ডার অনুযায়ী শনি- বৃহস্পতি মঙ্গল সূর্য শুক্র বুধ চন্দ্র ক্রম অনুযায়ী সেগুলো আবর্তিত হতে থাকে। সুতরাং, শনিবারের শেষ (২৪তম) হোরাটি মঙ্গল গ্রহের। এখন, রবিবার দিনের প্রথম হোরা কোনটি হবে? নিয়ম হলো, একটি দিনের শেষ হোরা যে গ্রহের, তার পরের গ্রহটি হবে পরবর্তী দিনের প্রথম হোরা এবং এই ক্রম চাল্ডিয়ান অর্ডার মেনেই চলবে। শনিবারের শেষ হোরা ছিল মঙ্গল। চাল্ডিয়ান অর্ডারে মঙ্গলের পরের গ্রহ হলো সূর্য। অতএব, রবিবার দিনের প্রথম হোরা হবে সূর্য এবং সেইজন্য দিনটির নাম রবিবার (রবি অর্থ সূর্য, Sun’s day)। একইভাবে, রবিবার দিনের ২৪তম হোরা হবে বুধের এবং সোমবারের প্রথম হোরা হবে চন্দ্রের এবং এই ক্রম চান্ডিয়ান অর্ডার অনুসরণ করে সপ্তাহের বাকি দিনগুলোর নামকরণ নির্ধারণ করে। তাহলে ক্রমটা দাঁড়াচ্ছে:

শনিবার: প্রথম হোরা শনি

রবিবার: প্রথম হোরা সূর্য (শনিবারের শেষ হোরা মঙ্গলের পর)

সোমবার: প্রথম হোরা চন্দ্র (রবিবারের শেষ হোরা বুধের পর)

মঙ্গলবার: প্রথম হোরা মঙ্গল (সোমবারের শেষ হোরা শনির পর)

বুধবার: প্রথম হোরা বুধ (মঙ্গলবারের শেষ হোরা মঙ্গলের পর সূর্য, শুক্র, বুধ)

বৃহস্পতিবার: প্রথম হোরা বৃহস্পতি (বুধবারের শেষ হোরা চন্দ্রের পর শনি, বৃহস্পতি)

শুক্রবার: প্রথম হোরা শুক্র (বৃহস্পতিবারের শেষ হোরা মঙ্গলের পর সূর্য, শুক্র) এই বিশ্বাস অনুযায়ী, কোনো বিশেষ কাজ করার জন্য দিনের সেই নির্দিষ্ট ঘণ্টাটিকে বেছে নেওয়া উচিত যা সেই কাজের প্রকৃতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ গ্রহের প্রভাবাধীন। উদাহরণস্বরূপ, ব্যবসায়িক আলোচনার জন্য বুধের হোরা উপযুক্ত বলে মনে করা হয়, তেমনি ভালোবাসার জন্য শুক্রের হোরা। যদিও আধুনিক বিজ্ঞান এই ধারণাকে সমর্থন করে না, তবে জ্যোতিষশাস্ত্রে planetary hours একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাচীন পদ্ধতি হিসেবে আজও বিবেচিত হয়। বিশেষ করে হোরাারি জ্যোতিষ (Horary Astrolog) নামক প্রশ্নের উত্তর জানার প্রাচীন পদ্ধতিতে এর ব্যবহার দেখা যায়। লক্ষ্যণীয় যে, রোমান নামকরণ পদ্ধতির সঙ্গে সপ্তাহের দিনগুলির মিল রয়েছে, যেমন: Sun (Sunday)-এর সঙ্গে রবির; Moon (Monday)-এর সঙ্গে সোমের; Mars (Tuesday এসেছে রোমান দেবতা Tiw থেকে)-এর সঙ্গে মঙ্গলের; Mercury (Wednesday জার্মানিক দেবতা Woden/Wodan থেকে, যিনি রোমান Mercury-র সমতুল্য)-এর সঙ্গে বুধের: Jupiter (Thursday নর্স বজ্র ও শক্তির দেবতা Thor এর নাম থেকে, রোমান Jupiter-এর সমতুল্য)-এর সঙ্গে বৃহস্পতির; Venus (Friday ভালোবাসা ও সৌন্দর্যের দেবী নর্স দেবী Frigg থেকে, যিনি রোমান Venus এর সমতুল্য)-এর সঙ্গে শুক্রর এবং Saturn (Saturday)-এর সঙ্গে শনির। ধ্রুপদী সংগীতে সপ্তাহের দিনের ভিত্তিতে স্বরবিন্যাস বা ‘রাগ’ নির্বাচন করা হয়। এটি একটি ঐতিহ্যগত ধারণা, যার মধ্যে প্রতিটি দিনের জন্য নির্দিষ্ট একটি রাগ নির্ধারণ করা হয়েছে। এই প্রথাকে ‘দিন-চক্রীয় রাগ’ (Time Theory of Ragas) বলা হয়। এই পদ্ধতি হিন্দি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে গুরুত্বপূর্ণ এবং বহু শতাব্দী ধরে প্রচলিত রয়েছে। উদাহরণ: সোমবার: বিভাস, ভৈরবী, শিবরঞ্জিনী; মঙ্গলবার: বিলাবল, বিহাগ; বুধবার: হিন্দোল, দরবারি কানাড়া, কেদার; বৃহস্পতিবার: দীপক, ভূপালী; শুক্রবার: বাহার, কাফি; শনিবার: শ্রী, মালকৌশ/মালকোষ, যোগীয়া এবং রবিবার: ভৈরব, সূর্যকান্ত, রাগ তোডি। এই রাগগুলো কিছুটা পরিবেশ এবং সঠিক সময়ের ভিত্তিতেও নির্বাচন করা হয়। যেমন: ভৈরবের সময় দিবা ১ম প্রহর, শ্রী রাগের সময় দিবা ৪র্থ প্রহর, মেঘ রাগের সময় রাত্রি ১ম ও ২য় প্রহর, মালকৌশের (কৌশিক) সময় রাত্রি ২য় প্রহর, হিন্দোল রাগের সময় রাত্রি ২য় ও ৩য় প্রহর, দীপক রাগের সময় গ্রীষ্মকালের মধ্যাহ্ন ইত্যাদি। সম্রাট আকবরের দরবারে তানসেন দিনভিত্তিক রাগ গাইতেন বলে ঐতিহাসিক গ্রন্থ ‘আইন-ই-আকবরি’ ও ‘মাআসির-ই-রাহিমি’-তে উল্লেখ আছে। তিনি সাধারণত ভৈরব (রবিবার), কেদার (বুধবার) ইত্যাদি সময়মতো গাইতেন; তবে তিনি দীপক রাগ (রাত্রির রাগ) দিনে গেয়ে আগুন ঝরিয়েছিলেন বলে কিংবদন্তি রয়েছে। ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলী খান, আলাউদ্দিন খাঁ, পণ্ডিত ভীমসেন জোশী, উদয় ভাওয়ালকর-সহ প্রায় সকল ধ্রুপদী শিল্পীই সাধারণত দিনভিত্তিক রাগ পরিবেশনের ঐতিহ্য মেনে চলতেন। তবে মহান শিল্পীরা কখনও কখনও তা অতিক্রম করে গেছেন সংগীত ছিল তাদের কাছে নিয়মের চেয়ে বেশি কিছু। বড়ে গুলাম আলী খান মাঝে মাঝে মালকোষ (শনিবারের রাগ) অন্য দিনে গেয়েছেন।

বাংলা সনের প্রসঙ্গে আবার আসা যাক। বঙ্গাব্দ প্রবর্তনের প্রথমদিকে ১২মাস ফারওয়ারদিন, উর্দিবাহিশ, খোরদাদ, তীর, মুরদাদ, শাহারিবার, মেহের, আবান, আজার, দে, বাহমান এবং ইসফান্দ নামে পরিচিত ছিল। পরবর্তীকালে মাসগুলির নাম কীভাবে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ ইত্যাদি হয় তা জানা যায় নি। অনুমান করা হয় যে, শক রাজবংশের স্মরণার্থে ৭৮ খ্রিস্টাব্দে প্রবর্তিত শকাব্দ থেকে এ নামগুলি এসেছে। বস্তুত এই মাসগুলোর ভিত্তি এবং নামকরণের উৎস প্রাচীন ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যা ও সৌরপঞ্জিকা পদ্ধতির সাথে গভীরভাবে জড়িত। জ্যোতির্বিজ্ঞান অনুসারে সূর্যই সৌরজগতের একমাত্র নক্ষত্র (star)। তবে, প্রাচীন ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যা এবং জ্যোতিষশাস্ত্রে ‘নক্ষত্র’ শব্দটি একটি ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়; নক্ষত্র বলতে চন্দ্রের গতিপথে (ecliptic) ২৭টি বিভাজনকে বোঝায় (প্রতি বিভাজন দ্রাঘিমাংশে = ১৩°২০′)। জ্যোতির্বিদ্যার দৃষ্টিকোণ থেকে নক্ষত্রগুলো আকাশের কল্পিত বিভাগ, যা প্রাচীনকালে জ্যোতির্বিন্যাস এবং পঞ্জিকা তৈরির কাজে সহায়ক ছিল। এগুলি ‘চন্দ্রনিবাস’ নামেও পরিচিত, কারণ চন্দ্র এক দিনে এক নক্ষত্র অতিক্রম করে (≈ ২৭.৩ দিনে সম্পূর্ণ চক্র)। গ্রিক/আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যায় এগুলিকে lunar mansions বা নক্ষত্রমণ্ডল বলা হয়, যা তারামণ্ডল (constellation) থেকে ভিন্ন। জ্যোতিষশাস্ত্রে সূর্যের গতিপথও উক্ত নক্ষত্রমণ্ডলে বিভক্ত। সূর্য এক নক্ষত্রে -১৩.৩৩ দিন থাকে (৩৬০০+২৭ ১৩°২০′ প্রতি নক্ষত্র)। এই প্রবেশকালই বাংলা মাসের নামের উৎস। অর্থাৎ বঙ্গাব্দের মাসের নামগুলির ভিত্তি এই কাল্পনিক নক্ষত্রসমূহ। সূর্য যখন যে নক্ষত্রে অবস্থান করে, সেই মাসের নামকরণ সেই নক্ষত্রের নামে রাখা হয়। সূর্যের এক নক্ষত্র থেকে অন্য নক্ষত্রে প্রবেশ এবং সেই নক্ষত্রে অবস্থানের সময়কাল মিলেই একটি বাংলা মাস তৈরি হয়। বাংলা ১২ মাসের নাম, নক্ষত্রসঙ্গতি এবং নামকরণের উৎস এক নজরে দেখে নেয়া যাক:

বৈশাখ: সূর্য বিশাখা নক্ষত্রে প্রবেশ করে এই সময়। বিশাখা মানে ‘দ্বিগ্রাহী’ (যেখানে দুইটি তারা নক্ষত্র)। জৈষ্ঠ্য: সূর্য জ্যেষ্ঠা নক্ষত্রে প্রবেশ করে। ‘জ্যেষ্ঠা’ মানে ‘প্রবীণ’ বা ‘বড়’-এটি এক নক্ষত্রের নাম। আষাঢ়: সূর্য পূর্বাষাঢ়া নক্ষত্রে প্রবেশ করে। ‘আষাঢ়া’ শব্দের অর্থ: উজ্জ্বলতা বা প্রতাপ। শ্রাবণ: সূর্য শ্রবণা নক্ষত্রে অবস্থান করে। ‘শ্রবণা’ শব্দের মানে: শোনা বা শ্রবণীয়।

ভাদ্র: ‘ভদ্রপদা’ দুইটি নক্ষত্র (পূর্বভাদ্রপদ ও উত্তরভাদ্রপদ) থেকে এসেছে। ‘ভদ্র’ অর্থ শুভ, ‘পদ’ অর্থ পা বা অঙ্গ।

আশ্বিন: ‘অশ্বিনী’ নক্ষত্রে সূর্য অবস্থান করে। অশ্বিনী মানে ‘ঘোড়া’-এটি দুটি দেবতাভ্রাতার নাম (অশ্বিনী কুমার)।
কার্তিক: ‘কৃত্তিকা’ নক্ষত্রে’ সূর্য প্রবেশ করে। এটি অগ্নিদেবের নক্ষত্র; ‘কার্তিকেয়’র নামানুসারেও এই নাম।

অগ্রহায়ণ: ‘অগ্র’ অর্থ প্রথম, ‘হায়ণ’ মানে বছর। একসময় এটি বছরের প্রথম মাস ছিল, যখন প্রধান ফসল

ধান কাটা হতো। একমাত্র মাস যা কোন নক্ষত্রের নামানুসারে নয়।

পৌষ: ‘পুষ্যা’ নক্ষত্রে সূর্য থাকে। ‘পুষ্য’ মানে পুষ্টিকর, যা বৃদ্ধি করে।

মাঘ: ‘মঘা’ নক্ষত্রে সূর্য থাকে। ‘মঘা’ মানে শক্তিশালী বা সম্মানিত।

ফাল্গুন: সূর্য ফাল্গুনী নক্ষত্রে প্রবেশ করে (পূর্বফাল্গুনী ও উত্তরফাল্গুনী)। ফাল্গুন মানে ‘উজ্জ্বলতা’ বা ‘সৌন্দর্য’। চৈত্র: ‘চিত্রা’ নক্ষত্রে সূর্য থাকে। ‘চিত্রা’ মানে সুসজ্জিত বা অলঙ্কৃত।

এই নক্ষত্র এবং মাসভিত্তিক বিভাজন প্রাচীন ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যা গ্রন্থ যেমন বেদাঙ্গ জ্যোতিষ এবং পরবর্তীকালের সূর্যসিদ্ধান্ত ও পঞ্চসিদ্ধান্তিকায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। তিথি, নক্ষত্র, যোগ এবং করণের ব্যবহার ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে গৃহ্যসূত্র ও ধর্মসূত্রতেও বিস্তারিতভাবে বর্ণিত আছে। ময়মনসিংহ গীতিকাতেও পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষের প্রভাব দেখা যায়।

ষড়ঋতুর নামের দিকে নজর দিলে দেখা যায় সেখানে সরাসরি কোনো নক্ষত্রের প্রভাব নেই। ঋতুর নামকরণ মূলত প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য, আবহাওয়ার পরিবর্তন এবং মানুষের জীবনযাত্রার সাথে তার সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে রচিত। প্রতিটি নামের মধ্যেই সেই নির্দিষ্ট ঋতুর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও তাৎপর্য নিহিত রয়েছে। তবে ঋতুর নামগুলি সংস্কৃত শব্দ থেকে উদ্ভূত, যা প্রকৃতির পরিবর্তনকে নির্দেশ করে: গ্রীষ্ম তাপ (‘গ্রস্’ ধাতু), বর্ষা = বৃষ্টি (‘বৃষ’ ধাতু), শরৎ = পরিষ্কার আকাশ (‘শৃ’ ধাতু), হেমন্ত হিমের শুরু (‘হিম’), শীত শৈত্য (‘শী’ ধাতু) ও বসন্ত = প্রাণের বিকাশ (‘বস’ ধাতু)। কিছু ঋতু-উৎসবে দেবতাদের উপাসনা জড়িত: বসন্ত = কামদেবের পূজা (হোলি উৎসব); বর্ষা ইন্দ্রের বৃষ্টির দেবতা হিসেবে আবাহন। কিন্তু ঋতুর নাম ইন্দ্র, কামদেব ইত্যাদির নামে নয়। আমরা বসন্তকে ‘ঋতুরাজ’ বলে থাকি, কিন্তু সংস্কৃত কাব্যে শরৎকে ঋতুরাজ বলা হতো, কারণ এর মৃদু আবহাওয়া কবি-সাহিত্যিকদের প্রিয়।

ইউনেস্কো (UNESCO) ২০১৬ সালের ৩০শে নভেম্বর ইথিওপিয়ার আদিস আবাবায় অনুষ্ঠিত ১১তম সভায় বাংলাদেশের পহেলা বৈশাখের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’কে ‘মানবতার বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ (Intangible Cultural Heritage of Humanity) হিসাবে তালিকাভুক্ত (Inscription) করে (11.COM)। তৎকালীন ইউনেস্কো ডিজি ইরিনা বোকোভা বলেছিলেন, ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সংস্কৃতি হলো মানুষের অন্তরের ভাষা।’ ইউনেস্কোর অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ভিজিট করলেই দেখা যায় ‘Mangal Shobhajatra on Pahela Baishakh’ শিরোনামের নিচে লেখা আছে (অনুবাদ), ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা উৎসব বাংলাদেশের জনগণের লোকঐতিহ্যের জন্য গর্বের প্রতীক, সেই সাথে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার শক্তি ও সাহস এবং সত্য ও ন্যায়ের প্রতি তাদের সমর্থনের প্রতীক। এটি গণতন্ত্রের জন্য সংহতি এবং একটি ভাগাভাগি করে নেয়া মূল্যবোধেরও প্রতিনিধিত্ব করে, যা জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ বা বয়স নির্বিশেষে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে।’ ইউনেস্কোর স্বীকৃতি প্রমাণ করে যে, পহেলা বৈশাখের শোভাযাত্রা কেবল একটি উৎসব নয়, বরং বাঙালির সহনশীলতা, সৃজনশীলতা ও ঐক্যের জীবন্ত দলিল। এটি বিশ্বকে শিক্ষা দেয় কীভাবে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য শান্তি ও সম্প্রীতির হাতিয়ার হতে পারে। ইসলামি শরিয়াহ ও সংস্কৃতিতে চান্দ্রবর্ষ (হিজরি সাল) প্রাধান্য পায়, তবে কিছু ক্ষেত্রে সৌরবর্ষও ব্যবহার করা হয়। ইসলামি জীবনব্যবস্থায় সৌরবর্ষ (Gregorian Calendar) এবং চান্দ্রবর্ষ (Hijri Calendar) উভয়েরই আলাদা প্রভাব রয়েছে এবং এর মাধ্যমে অনেক দিক-নির্দেশনা পাওয়া যায়। নতুন চাঁদ দেখার মাধ্যমেই হিজরি মাস শুরু হয় এবং তারিখগুলো সৌরবর্ষের তুলনায় প্রতি বছর প্রায় ১০-১১ দিন এগিয়ে আসে। রমজান মাসের রোজা, ঈদ-উল-ফিতর, ঈদ-উল-আযহা, হজ্ব, ১০ই মহররম এবং অন্যান্য ইসলামিক পর্ব ও তারিখ হিজরি সালের চাঁদের ওপর নির্ভরশীল। আবার ৫ ওয়াক্ত নামাযের সময়সূচি সৌরদিনের সাথে সম্পর্কিত। যেমন: ফজরের নামায সূর্যোদয়ে আগে, মাগরিবের নামায সূর্যাস্তের পরপর ইত্যাদি। এমনকি নামাযের নিষিদ্ধ সময় সম্পূর্ণরূপে সৌরসময়ের দ্বারা নির্ধারিত। দিনের ৩ সময় নামায পড়া নিষিদ্ধ: সূর্যোদয়ের সময়, সূর্য যখন ঠিক মাথার উপর (উল্লম্বভাবে) থাকে এবং সূর্যাস্তের সময়। এইভাবে, ইসলামি জীবনব্যবস্থায় উভয় ক্যালেন্ডারের প্রভাব রয়েছে এবং তারা একে অপরকে পরিপূরক হিসেবে কাজ করে।

বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী। অন্যান্য প্রধান ধর্ম হিন্দু, খ্রিস্ট, বৌদ্ধ ও শিখধর্ম। বাংলাদেশের মুসলমানদের পরিচয় ‘বাঙালি মুসলমান’-এটি একটি অনন্য সাংস্কৃতিক সমন্বয়, যেখানে বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্য ও ইসলামের বিশ্বজনীন মূল্যবোধ একাকার। এই দ্বৈত পরিচয় ধারণের পথে কিছু চ্যালেঞ্জ থাকলেও, এর মাঝেই নিহিত রয়েছে বাংলাদেশের সমৃদ্ধির চাবিকাঠি। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে (১২০১-১৮০০) রচিত বিভিন্ন ‘মঙ্গলকাব্য’ আমাদের অমূল্য সম্পদ। উদাহরণ: মনসামঙ্গল (রচয়িতা: বিজয়গুপ্ত, বিপ্রদাস পিপলাই), চণ্ডীমঙ্গল (রচয়িতা: মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, কবিকঙ্কণ), অন্নদামঙ্গল (রচয়িতা: ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর) ইত্যাদি। মঙ্গল শব্দটি শুভফলপ্রদানকারী দেবতার গাথা বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। আবার একই সময়ে কবি আলাওল রচিত ‘পদ্মাবতী’, ‘সেকান্দরনামা’, দৌলত কাজী রচিত ‘সতী ময়না ও লোর চন্দ্রানী’, শেখ ফয়জুল্লাহ প্রণীত ‘গোরক্ষ বিজয়’, ফকীর গরিবুল্লাহ রচিত ‘জঙ্গানামা’, শাহ মুহম্মদ সগীর রচিত ‘ইউসুফ-জোলেখা’ প্রভৃতি আমাদের সাহিত্যভাণ্ডরকে সমৃদ্ধ করেছে। একই ব্যাপ্তিকালে (১৪ শতকে) সুফি সাধকরা যেমন: হযরত শাহ জালাল (র.), শাহ পরান (র.), খান জাহান আলী (র.) বঙ্গদেশে ইসলাম প্রচার করেছেন। লালন ফকির, হাসন রাজার গানে ইসলাম ও বাঙালিত্বের মেলবন্ধন ঘটেছে, যাকে সিনক্রেটিজম (Syncretism) বলা যেতে পারে। বাউল, মরমি/মুর্শিদি, মাইজভাণ্ডারি ইত্যাদি গানে আল্লাহ-প্রেমের প্রকাশ ঘটেছে। কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা ভাষায় ইসলামি সাহিত্য চর্চা করেছেন; আরবি, ফার্সি, তুর্কি শব্দ বেশুমার ব্যবহার করেছেন। আবার একই সাথে তিনি প্রচুর কীর্তনও রচনা করেছেন। তাই তো তিনি আমাদের জাতীয় কবি। পাকিস্তানি শাসনামলে ‘বাঙালি’ পরিচয়কে ইসলামি সংস্কৃতির বিরোধী করে তোলার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন প্রমাণ করে দেয় যে বাঙালি মুসলমানের পরিচয়ে মাতৃভাষার গুরত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশে সকল ধর্মাবলম্বীর সহাবস্থানের জন্য বাঙালিত্বের সাধারণ ভিত্তি প্রয়োজন। পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন তেমন একটা সাধারণ ভিত্তি। বহুভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বলেছিলেন, ‘মুসলমান হিসাবে আমার ধর্ম ইসলাম, কিন্তু বাঙালি হিসাবে আমার সংস্কৃতি বাংলা। এ দুটিকে আলাদা করলে আমি অর্ধেক হয়ে যাব।’ বাংলাদেশের মুসলমানদের জন্য বাঙালিত্ব ও ইসলাম পরস্পরবিরোধী নয়-এটি একটি সম্পূরক সম্পর্ক। এই সমন্বয়ই বাংলাদেশকে একটি অনন্য রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তুলেছে, যেখানে ধর্মীয় অনুশাসন ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা পাশাপাশি বিরাজ করে। লেখাটা যে উক্তি দিয়ে শুরু করেছিলাম তার অবশিষ্টাংশ দিয়ে শেষ করি। মওলানা ভাসানী আরো বলেছিলেন ‘তোমরা ধর্মের সাথে বাঙালি সংস্কৃতি একত্র করতে যেও না’।

গীতিকার এবং প্রবন্ধকার

baizid.romana@gmail.com