সারাক্ষণ রিপোর্ট
বিভ্রান্তিকর দুই চেহারা
সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) একদিকে দেশে ‘সহনশীলতার মন্ত্রণালয়’ গঠন করে আরব বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে ঐক্যের বার্তা দেয়, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নানা মিলিশিয়া ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পৃষ্ঠপোষকতা করে বিভেদের পথ অনুসরণ করছে। সম্প্রতি এই দ্বিমুখী নীতির ফলাফল হিসেবে ইউএইকে গণহত্যায় সহযোগিতার অভিযোগে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে তোলা হয়েছে।
সুদানে মিলিশিয়াকে অস্ত্র সহায়তা
এপ্রিলের ১০ তারিখে, সুদানের পক্ষ থেকে ইউএইয়ের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মামলা করা হয়। অভিযোগ অনুযায়ী, ইউএই ‘র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস’ (RSF) নামের একটি দাঙ্গা ও হত্যাযজ্ঞে অভিযুক্ত মিলিশিয়াকে অস্ত্র সরবরাহ করেছে, যারা মাসালিত জাতিগোষ্ঠীর উপর গণহত্যা চালিয়েছে। যদিও ইউএই এ অভিযোগকে ভিত্তিহীন ‘প্রচারণা’ বলে উড়িয়ে দিয়েছে, জাতিসংঘের উপাত্ত ও স্যাটেলাইট চিত্রে তাদের অস্ত্র পাঠানোর প্রমাণ মিলেছে।
মধ্যপ্রাচ্যে একাধিক গোষ্ঠীকে সমর্থন
সুদান ছাড়াও লিবিয়ায় ইউএই খলিফা হাফতারের পাশে দাঁড়িয়েছে, যিনি জাতিসংঘ-সমর্থিত সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। ইয়েমেনে তারা দক্ষিণের বিচ্ছিন্নতাবাদী ‘সাউদার্ন ট্রানজিশনাল কাউন্সিল’কে সমর্থন দিয়েছে এবং সোমালিয়ার পন্টল্যান্ড ও সোমালিল্যান্ডে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য শক্তির সঙ্গে দ্বন্দ্ব
এই নীতিগুলো আমেরিকা, চীন এবং রাশিয়ার মতো বৃহৎ শক্তির সঙ্গে ইউএইকে সংঘাতে ফেলেছে। যদিও ইউএই দাবি করে এসব সমর্থন ‘সহযোগীদের সঙ্গে সমন্বয়ে’ হয়েছে, বাস্তবে অনেকক্ষেত্রেই তা একতরফা ছিল। উদাহরণস্বরূপ, লিবিয়ায় আমেরিকা হাফতারের বিরোধী হলেও ইউএই তাকে সমর্থন করেছে।
অর্থনৈতিক স্বার্থ না, আদর্শগত অভিমুখ
অনেকে মনে করেন ইউএইর এই পদক্ষেপের পেছনে অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে—যেমন সুদানের সোনা বা কৃষিজমির উপর নিয়ন্ত্রণ। তবে বাস্তবে এটি মূলত আদর্শিক একটি অভিমুখ। প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ বিন জায়েদ ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেন এবং কাতার ও তুরস্কের প্রভাব হ্রাস করাই তাদের মূল লক্ষ্য।
ইয়েমেনে কৌশলগত বিচ্ছিন্নতা
২০১৫ সালে ইয়েমেনে ইরানঘনিষ্ঠ হুথি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটে যুক্ত হয় ইউএই। তবে তাদের সমর্থন ছিল পৃথক—তারা সৌদি-ঘনিষ্ঠ ‘ইসলাহ পার্টির’ পরিবর্তে দক্ষিণের পুরনো সমাজতান্ত্রিক বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পাশে দাঁড়ায়। এ পদক্ষেপ ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক লাভ এনে দিতে পারে—উদাহরণস্বরূপ, আদেন বন্দরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা চলছে।
পুরোনো বন্ধুত্বের দায়?
সুদানের ইসলামপন্থী শাসক ওমর আল-বশিরকে ২০১৯ সালে উৎখাত করার পরও সেনাবাহিনীতে ইসলামপন্থীদের প্রভাব রয়েছে। এ কারণেই হয়তো প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ RSF নেতা হেমেদতির প্রতি আনুগত্যবোধ করেছেন—কারণ তিনিই ইয়েমেনে ইউএইকে হাজার হাজার যোদ্ধা পাঠিয়েছিলেন।
বাস্তববাদী দাবি, ব্যর্থ ফলাফল
ইউএই দাবি করে তারা বাস্তববাদী নীতি গ্রহণ করছে এবং মিত্রদের সামরিক কার্যকারিতা বেশি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, যেসব গোষ্ঠীকে তারা সমর্থন দিয়েছে, তারা ব্যর্থ হয়েছে। হাফতার ত্রিপলি দখলে ব্যর্থ হন, RSF সম্প্রতি খার্তুম থেকে পিছু হটেছে।
পরিণতি: ক্ষতিগ্রস্ত সুনাম
সিরিয়ার স্বৈরশাসক বাশার আল-আসাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চাইলেও সফল হয়নি ইউএই। একইভাবে সুদানে এবং লিবিয়ায় তাদের ভূমিকাও বিতর্কিত হয়েছে। তুরস্ক এখন এই অঞ্চলে আরও দৃঢ়ভাবে নিজের অবস্থান তৈরি করছে। ওয়াশিংটনে সাম্প্রতিক কয়েকটি বৈঠকে আমেরিকান কংগ্রেসের স্টাফরা ইউএইর ওপর সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞার প্রস্তাব তুলেছে—যদিও তা এখনও কেবল আলোচনার পর্যায়ে।
উপসংহার: ভুল না, বিপর্যয়
RSF কিংবা হাফতারের মতো গোষ্ঠীকে সমর্থন দেওয়া শুধুই অপরাধ নয়—এটি একটি কৌশলগত ভুল। ইউএই-এর বৈদেশিক নীতি এখন কার্যত তার নিজস্ব অঞ্চলগত প্রভাব তৈরির প্রচেষ্টায় বিভক্ত, যা শেষপর্যন্ত হয়তো নিজেই তার সুনাম ও স্থিতিশীলতাকে হুমকিতে ফেলছে।
Leave a Reply