ইওন দ্রিয়া
ইউরোপীয়দের কাছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ আমাদের সবচেয়ে ভয়াবহ আশঙ্কা বাস্তবে পরিণত হতে বেশি সময় নেয়নি। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে ভাইস-প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের ভাষণ স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে, ওয়াশিংটনের নতুন বাণিজ্য-নীতি ইউরোপের মূল অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের প্রতি ক্রমশ বৈরী হয়ে উঠছে। তার পরপরই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘোষণা করেন যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠনই হয়েছে “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ঠকানোর জন্য”।
এই প্রেক্ষাপটে ওয়াশিংটনের বদলানো শুল্ক-নীতি ব্রাসেলসের কাছ থেকে মিতভাষী, ধৈর্যশীল প্রতিক্রিয়া পেয়েছে। কারণ, স্বল্পমেয়াদি রাজনৈতিক উচ্চ-বাচ্য থেকে দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত লক্ষ্য আলাদা করতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের জুড়ি নেই। আর খোলামেলা বৈশ্বিক বাণিজ্য ও বহু-পক্ষীয়তায় ইউরোপের যে মৌলিক অগ্রাধিকার, বর্তমান মার্কিন নীতিই তা দুর্বল নয়, বরং শক্তিশালী করছে।
মার্কিন প্রশাসনের একতরফা ও ভুল-হিসেবি শুল্ক ইতোমধ্যে ইউরোপ ও এশিয়ার মিত্রদের সামনে বসিয়ে চীন মোকাবিলার মূল মার্কিন লক্ষ্যকে ঠুনকো করে দিয়েছে। ভবিষ্যতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান বা অন্য এশীয় অর্থনীতিগুলোর সঙ্গে ওয়াশিংটন যে চুক্তিই করুক না কেন, সংকটের সময়ে বিশ্বাসযোগ্য ও আন্তরিক অংশীদার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি তীব্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখানেই লুকিয়ে আছে একই সঙ্গে বিপদ ও সম্ভাবনা।
নীতি-বিশ্লেষক ওরেন ক্যাসের কথায়, মার্কিন কৌশল নির্ভর করে এই ধারণার ওপর যে, তার সবচেয়ে মূল্যবান মিত্রেরা সংশোধিত ব্যবস্থাতেও চীনের তুলনায় মার্কিন অংশীদারিত্বকে বেশি গুরুত্ব দেবে। কিন্তু ওয়াশিংটন ক্রমবর্ধমান অসন্তুষ্ট মিত্রদের কাছ থেকে শিগগিরই আরো সূক্ষ্ম রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সমঝোতা দেখতে পাবে। বিশ্লেষক ইভান ক্রাস্তেভের ভাষায়, যুক্তরাষ্ট্র শক্তি দেখাতে চাইছে “বিরোধীদের মোকাবিলা করে নয়, বরং মিত্রদের বশে এনে।” দীর্ঘমেয়াদি অংশীদারিত্বের জন্য এটি কোনো কৌশল নয়—এ কথা বেইজিং ভালোই বুঝে, আর সে-কারণেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তারা এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগাতে মরিয়া।
আমেরিকার প্রধান বাণিজ্য ও নিরাপত্তা অংশীদার—ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া— ওয়াশিংটনের নীতি-অনিশ্চয়তার মুখে তাদের বৈশ্বিক বাণিজ্য-সম্পর্ক সূক্ষ্মভাবে পুনর্বিন্যাস করছে। যুক্তরাষ্ট্র তাদের অর্থনীতি ও নিরাপত্তার প্রধান অগ্রাধিকার হয়েই থাকবে, কিন্তু তা অন্য অংশীদারদের সঙ্গে ঘনীভূত সম্পর্ক গড়তে বাধা নয়। আর এখানেই গভীরতর ইউরোপ-এশিয়া অংশীদারত্বের বিপুল সম্ভাবনা।
এই পথে দু’টি বড় সুবিধা রয়েছে। প্রথমত, বিস্তৃত বাণিজ্য-সম্পর্ক বৈশ্বিক অস্থিরতার ঝুঁকি থেকে রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে—বিশেষত মার্কিন শুল্ক-নীতির অস্থিরতা ও চীনের সম্প্রসারণবাদী প্রবণতার যুগে। এই প্রেক্ষাপটে ইউরোপ, টোকিও, সিউল ও অন্যান্য এশীয় গণতন্ত্রের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা মুক্ত ও ন্যায্য বাণিজ্যের বহু-পক্ষীয় মডেলকে প্রসারিত করবে।
এই অংশীদারত্বগুলো গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের প্রতি যৌথ প্রতিশ্রুতির ওপর দাঁড়ানো। এখান থেকে ২০১১-এর ইইউ-দক্ষিণ কোরিয়া মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি ও ২০১৯-এর ইইউ-জাপান অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তির ভিত্তি আরও মজবুত করা যায়। ইতিমধ্যেই ট্রাম্পের শুল্ক-রাজনীতি ইইউ-ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের সঙ্গে আলোচনায় নতুন গতি এনেছে। পাশাপাশি, পরিবেশ-শর্তযুক্ত ব্যাপক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির বদলে বিভিন্ন খাতে সীমিত-পরিসরের চুক্তি করার দিকে ব্রাসেলস এখন বাস্তবমুখী নীতি নিচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, এই অংশীদারিত্বগুলো চীনের সঙ্গে ঝুঁকি কমানোর বিষয়ে ওয়াশিংটনের বিভিন্ন দাবি সামলাতে একটি যৌথ মঞ্চ গড়তে পারে। রাজনৈতিকভাবে জটিল হলেও ইউরোপ, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও অন্যদের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য-ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি অন্তর্ভুক্ত করার সম্ভাবনা পুরোপুরি ফেলে দেওয়া যায় না। এ-ধরনের চেষ্টা অতীতে হয়েছে—ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে ইইউ-মার্কিন-জাপান ত্রিপক্ষীয় বাণিজ্য-মন্ত্রী পর্যায়ে একাধিক সভা হয়েছে। তবে এ প্রক্রিয়ার পুনরুজ্জীবনের জন্য ওয়াশিংটনের নতুন করে রাজনৈতিক প্রত্যয় ও শর্তাবলির হালনাগাদ প্রয়োজন। ২০২৩-এ প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আয়োজিত যুক্তরাষ্ট্র-জাপান-দক্ষিণ কোরিয়া প্রথম ত্রিপক্ষীয় শীর্ষ-সম্মেলনও দেখিয়েছে, বদলে যাওয়া রাজনৈতিক বাস্তবতাতেও যৌথ আলোচনা সম্ভব।
বস্তুত, ইউরোপ-এশিয়া সম্পর্ক আরও গভীর করা ট্রাম্পের শুল্ক-নীতির সবচেয়ে যৌক্তিক প্রতিক্রিয়া। রাশিয়ার আগ্রাসন ঠেকাতে পূর্ব ইউরোপে দক্ষিণ কোরিয়া বড় অস্ত্র-সরবরাহকারী হয়ে উঠেছে। জাপান যুক্তরাজ্য ও ইতালির সঙ্গে নতুন-প্রজন্মের যুদ্ধবিমান প্রকল্পে যুক্ত। একই সঙ্গে বৈদ্যুতিক গাড়ির যুগে চীনের প্রতিযোগিতা ও মার্কিন শুল্ক মোকাবিলায় ইউরোপের জাপানি-কোরীয় প্রযুক্তি-দক্ষতা জরুরি। তিন পক্ষই দ্রুত বয়স-বৃদ্ধি জনসংখ্যা সমস্যার মুখোমুখি।
স্বভাবতই এখন ব্রাসেলসসহ সব ঐতিহ্যগত মার্কিন মিত্রের প্রথম কাজ—ওয়াশিংটনের প্রস্তাবিত শুল্ক থেকে অর্থনৈতিক ক্ষতি সীমিত করা। চলমান ৯০ দিনের ‘বিরতি’ কালের অধিকাংশ জুড়েই বিভিন্ন দেশ যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ সুবিধা বাঁচিয়ে রাখতে প্রতিযোগিতা করবে; জাপান ইতোমধ্যেই শীর্ষে রয়েছে।
তবু এই স্বল্পমেয়াদি জোরাজুরিই দীর্ঘমেয়াদি, সুচিন্তিত কৌশলগত পরিকল্পনাকে থামিয়ে রাখতে পারে না। বিশ্বরাজনীতি বদলে গেছে; স্নায়ুযুদ্ধকালের মিত্রতা আর এতটা নিশ্চিত নয়। কিংবদন্তি ব্রিটিশ-আমেরিকান বিনিয়োগকারী স্যার জন টেম্পলটনের বিখ্যাত উক্তি মনে রাখা দরকার— “যারা শতভাগ সময়ই সঠিক, কেবল তারাই বিনিয়োগ বহুমুখীকরণ থেকে বিরত থাকতে পারে।”
ইউরোপ ও এশিয়ার উচিত এই পাঠ ভালোভাবে ছাত্রের মতো গ্রহণ করা।
Leave a Reply