Dhaka 11:39 pm, Tuesday, 20 May 2025

ভারত ও পাকিস্তান অচেনা ভবিষ্যতের দিকে এগুচ্ছে

Update Time : 03:21:08 pm, Tuesday, 29 April 2025

মালীহা লোধী

ভারত ও পাকিস্তান আবারও একটি ঝুঁকিপূর্ণ সংঘর্ষের সীমানায় অবস্থান করছে। উত্তেজনা বাড়ার ফলে উপমহাদেশ অজানা ভবিষ্যতে প্রবেশ করেছেদ্বিপাক্ষিক ব্যবস্থাগুলো বর্জিত এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও নিম্নমুখী হওয়ায় পূর্ণাঙ্গ সংকটের আশঙ্কা তীব্র হয়ে উঠেছে।

অধিকৃত কাশ্মীরের পাহালগামে সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন বেসামরিক প্রাণ হারানোর পর ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একাধিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে রয়েছে দুই প্রতিবেশীর সীমান্তবর্তী নদীসমূহের পানি ভাগাভাগি ও ব্যবস্থাপনা নির্ধারণকারী সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত রাখা। অন্যান্য পদক্ষেপ ছিল আটারি সীমান্ত পারাপথ বন্ধপাকিস্তানি ভিসা বাতিল এবং নিউ দিল্লিতে পাকিস্তান হাই কমিশনের আকার সংকুচিত করা।

এই তথাকথিত পাল্টা পদক্ষেপগুলো কোনো তদন্ত ছাড়াই নেওয়া হয়েছে এবং পাকিস্তানের সম্পৃক্ততা প্রমাণের কোনো তথ্য নেই। ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিবের ঘোষণায় শুধু সীমান্ত পেরিয়ে সন্ত্রাসী হামলার সংযোগ’ উল্লেখ করা হয়েছিল। তবে ভারতীয় মিডিয়ায় পরিকল্পিত প্রচারণায় আঙুল পাকিস্তানের দিকে তোলা হয়েছে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণপ্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি হামলাকারী ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের জন্য অচিন্ত্যনীয় শাস্তি’ দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। এতে ভারতের মধ্যেই এই ধারণা শক্তিশালী হয়েছে যে নিহতদের প্রতিশোধ নিতে সরকার কোনও সক্রিয় সামরিক পদক্ষেপ নিতে পারে। এটি ২০১৯ সালের বালাকোট সংকটের স্মৃতি জাগিয়ে তোলেযখন ভারতীয় বিমান সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তান অধিকৃত ভূখণ্ডে প্রবেশ করে জঙ্গি আস্তানার উপর হামলা চালায়। পাকিস্তান জম্মুতে পাল্টা বিমান হামলা চালায়। বন্ধু দেশগুলোর মধ্যস্থতায় এবং পাকিস্তানের হাতে বন্দি থাকা এক ভারতীয় পাইলটকে দেশে ফেরত দেয়ার পর সংকট প্রশমিত হয়।

২৩ এপ্রিল ভারতের ঘোষণার পর ইসলামাবাদের প্রতিক্রিয়া ছিল সাবলীলভাবে ভারতের পদক্ষেপের সমান। জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির বৈঠকের পর প্রকাশিত এক বিবৃতিতে একের পর এক পাল্টা পদক্ষেপের কথা জানানো হয়। সেখানে ভারতের ব্যবস্থাকে একতরফাঅন্যায় ও অবিবেচনাপূর্ণ’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত করার ভারতীয় সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে হুঁশিয়ারি দেয়া হয় যে, ‘পাকিস্তানের পানি প্রবাহ বন্ধ বা বিভ্রান্ত করার যে কোনো চেষ্টা’ ‘যুদ্ধঘোষণার মাপকাঠি’ পাবে এবং পূর্ণ বল প্রয়োগ করে প্রতিক্রিয়া জানানো হবে। পাকিস্তানবিবৃতিতে বলা হয়শিমলা চুক্তিসহ ভারতের সঙ্গে সমস্ত দ্বিপাক্ষিক চুক্তি’ ‘স্থগিত’ রাখার অধিকার সংরক্ষণ করেছেতবে কোনো চুক্তি স্থগিত করেনি। পাকিস্তান ওয়াঘা সীমান্ত পারাপথ বন্ধ করে দেয়ভারতীয় বিমানের উড়ানসীমা বিচ্ছিন্ন করে এবং সমস্ত বাণিজ্য স্থগিত করে। এসব পদক্ষেপ মূলত ভারতীয় পদক্ষেপের প্রতিফলন ছিল।

উত্তেজনা তীব্র হওয়ার ফলে অঞ্চল অচেনা পরিস্থিতিতে ঠেলে পড়েছে এবং পূর্ণাঙ্গ সংকটের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

ভারত যে সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত’ রাখার ঘোষণা দিয়েছেতা কোনো শূন্যস্থান থেকে আসে নি। গত কয়েক বছর ধরে নতুন দিল্লি ১৯৬০ সালের সেই চুক্তির ভবিষ্যত নিয়ে সন্দেহ উত্থাপন করেছেযা ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে যুদ্ধসংঘাত ও উত্তেজনার মধ্যেও পানি ভাগাভাগির একটি কাঠামো হিসেবে টিকে আছে।

সম্প্রতি বছরগুলোতে দুই দেশই চুক্তির বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থাপনা নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে। উদাহরণস্বরূপভারত ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে হেগে অনুষ্ঠিত এক মধ্যস্থতা আদালতের শুনানিতে অংশগ্রহণ করেনিযেখানে পাকিস্তান দাবি করেছিল চেনাব ও ঝেলাম নদীতে ভারতের জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বিষয়ক বিরোধ নিষ্পত্তির কথা। ভারত সে শুনানি বাতিল করে বরং নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ’ চান। একই বছরে জানুয়ারিতে ভারত পাকিস্তানকে চুক্তির বিরোধ নিষ্পত্তি বিধি সংশোধনের ইচ্ছা জানিয়েছিল। ইসলামাবাদ তখন যৌথ সিন্ধু জল কমিশনের অধীনে যে কোনো উদ্বেগ নিয়ে আলোচনা করতে ইচ্ছ প্রকাশ করে এবং চুক্তি মেনে চলার আহ্বান জানায়।\

আগস্ট ২০২৪ সালে নতুন দিল্লি সরকার ইসলামাবাদকে আনুষ্ঠানিকভাবে সিন্ধু জল চুক্তি পুনর্বিবেচনা ও পুনঃআলোচনার জন্য অনুরোধ করে। চুক্তি সংশোধনের পেছনে তারা মৌলিক ও অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন’ এবং নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগের কথা উল্লেখ করে। চিঠিতে জনসংখ্যাগত পরিবর্তনপরিবেশগত চ্যালেঞ্জ এবং পরিচ্ছন্ন শক্তি উন্নয়নের জন্য ত্বরান্বিত উদ্যোগের প্রয়োজন’ হিসেবে বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়। ভারতের ২৪ এপ্রিলের চিঠিটিও একই বিষয়গুলো উল্লেখ করলেও বিশেষ যোগ করেছিল পাকিস্তানের ধারাবাহিক সীমানাপার সন্ত্রাসবাদকে চুক্তি স্থগিতের যৌক্তিকতা হিসেবে দেখানোর জন্য।

চুক্তি স্থগিত করার ভারতীয় সিদ্ধান্ত চুক্তির নিজস্ব বিধি বা আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। চুক্তি অনুযায়ী কোনো পক্ষই একমাত্র নিজ ইচ্ছায় এটি স্থগিত বা বাতিল করতে পারে নাকোনো সংশোধন বা বাতিল করতে উভয়পক্ষের সম্মতি আবশ্যক। ভারতের ঘোষণায় বলা হয়েছে, ‘… যতক্ষণ না পাকিস্তান বিশ্বাসযোগ্যভাবে এবং অনিবার্যভাবে সীমানাপার সন্ত্রাসে সমর্থন পরিত্যাগ করেততক্ষণ চুক্তি স্থগিত থাকবে।

বর্তমানে স্থগিত’ থাকার মানে হলো ভারত পানি প্রবাহ সংক্রান্ত তথ্য ভাগাভাগি ও প্রকল্প নকশা সম্পর্কিত তথ্য বিনিময় বন্ধ করবেযদিও প্রকৃতপক্ষে এটি অনেক বছর আগে থেকেই বন্ধ করে রেখেছে। চাপ সৃষ্টি করার জন্য আরও পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারেতবে বর্তমানে সম্পূর্ণ পানি প্রবাহ বন্ধ বা উল্লেখযোগ্যভাবে পানি প্রত্যাহারের মতো অবকাঠামো ভারতীয় পক্ষের নেই। তাই স্বল্পমেয়াদে এই পদক্ষেপের প্রভাব সীমিত থাকলেও দীর্ঘমেয়াদে এর গুরুতর প্রভাব থাকবে।

নজর কাড়ারমত বিপদ হলো যে কোনো সামরিক পদক্ষেপযা নতুন দিল্লিকে তাদের দেখা কার্যকরী’ জোরদার কূটনীতিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে আরও শক্তিশালী করার প্রলুব্ধি দিচ্ছে। মোদির ২৪ এপ্রিল বিহারে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেনসন্ত্রাসী ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের পৃথিবীর প্রান্ত পর্যন্ত’ তাড়া করা হবেএই বক্তব্য ব্যাপকভাবে সেই সম্ভাবনার দৃঢ় ইঙ্গিত হিসেবে দেখা হচ্ছে। আলোচনায় বলা হচ্ছে প্রচলিত সক্রিয় সামরিক হামলা সাইবার আক্রমণ এবং অসমমিত পদক্ষেপের সঙ্গে মিলিত হতে পারে।

ইতিমধ্যে নিয়ন্ত্রণরেখা ও আন্তর্জাতিক সীমান্তের ঘনিষ্ঠ এলাকায় ভারী অস্ত্র মোতায়েনের খবর আসছে। প্রধানমন্ত্রী মোদি হয়তো ইসরায়েলের কৌশল অনুসরণ করে পাকিস্তানকে শাস্তি’ দিতে চাইবেনতবে যে কোনো ভারতীয় সক্রিয় সামরিক পদক্ষেপ পাকিস্তানের কঠোর প্রতিক্রিয়া উস্কে দেবেযার পরিণাম নতুন দিল্লির জন্য অনিশ্চিত এবং পূর্বানুমেয় নয়। এটি সম্ভাব্যভাবে উত্তেজনার একটি চক্র শুরু করবে এবং ২০১৯ সালের চেয়ে বৃহত্তর এক সর্বাত্মক সংকটের জন্ম দিতে পারে।

২০১৯ সালে সংকট প্রশমন করতে তৃতীয় পক্ষ সহযোগিতা করেছিল। এটি কি আবার ঘটবেযদি যথাসময়ে এরূপ কোনো সহযোগিতা না আসেতাহলে দুই পারমাণবিক প্রতিবেশীর মধ্যের পরিস্থিতি অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বিপজ্জনক হয়ে উঠবে।

পারমাণবিক সীমার নিচে সীমিত যুদ্ধের ধারণা অগণিত অনির্দেশ্য ঝুঁকিতে পরিপূর্ণ। এমন পরিস্থিতি সর্বাত্মকভাবে প্রতিহত করা উচিত। যদিও ভারতীয় পক্ষের মধ্যে এর জন্য খুব বেশি আগ্রহ নেইতবুও ভুল হিসাব এড়াতেসংকট পরিচালনা করতে এবং তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে বাধা দিতে দ্রুত একটি বিশ্বাসভিত্তিক অন্তর্বর্তী যোগাযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা আবশ্যক। অন্যথায় পরিস্থিতি পরিণত হবে ভয়াবহযা কল্পনাতীত।

লেখক যুক্তরাষ্ট্রযুক্তরাজ্য ও জাতিসংঘে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত।

লেখাটি ইংরেজিতে প্রকাশিত হয় ডন২৮ এপ্রিল ২০২৫, ( বিষয় ও ভাষার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অনূদিত)