এজাজ হায়দার
যুদ্ধের স্ক্রিপ্ট ও বারবারের সংঘাতের আশঙ্কা
ভারত ও পাকিস্তান বারবার যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে কেন ফিরে আসে? ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পাহালগামে হামলার পর ভারতের গণমাধ্যমে যুদ্ধের আহ্বান জোরদার হয়। প্রতিবারের মতোই পাকিস্তানকে দায়ী করা, ‘শাস্তি’ দেওয়ার ঘোষণা, সীমিত কিংবা পূর্ণমাত্রার সামরিক হামলার সম্ভাবনার কথা তোলা হয়। অথচ এই হিস্টিরিয়া যতটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, ততটাই বাস্তবতা বিবর্জিত।
ভারতের বর্তমান হিন্দুত্ববাদী শাসনব্যবস্থায় কাশ্মীর প্রসঙ্গ ও পাকিস্তানবিরোধী বক্তব্য যেন রাজনৈতিক অস্ত্র হয়ে উঠেছে। যুদ্ধের সম্ভাবনা কতটা বাস্তবসম্মত এবং এ ধরনের ভুল হিসাবের পরিণতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।
যুদ্ধের অর্থ ও রাজনৈতিক লক্ষ্য: ক্লজভিট্জের দৃষ্টিভঙ্গি
জার্মান সামরিক চিন্তাবিদ কার্ল ফন ক্লজভিট্জ ‘Zweck und Ziel’ তত্ত্বে যুদ্ধকে রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যম হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। যুদ্ধের ‘উদ্দেশ্য’ (Zweck) হচ্ছে রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন এবং ‘লক্ষ্য’ (Ziel) হচ্ছে সেই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের কৌশল। শুধুমাত্র যুদ্ধ জেতা নয়, আসল প্রশ্ন হলো—তা রাজনৈতিকভাবে কাঙ্ক্ষিত ফল দিয়েছে কি না।
ভারত যদি পাকিস্তানকে সীমিতভাবে ‘শাস্তি’ দেয়, কিন্তু ভবিষ্যতে পাকিস্তান তার স্বার্থবিরোধী কাজ চালিয়ে যায়, তাহলে ভারতের মূল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অর্জিত হবে না।
পরমাণু অস্ত্রের ছায়া: সীমিত যুদ্ধ আসলেই সীমিত থাকবে?
পরমাণু অস্ত্র যুদ্ধের হিসাবকে জটিল করে তোলে। পাকিস্তানের ‘অনির্দিষ্ট সীমা’ ও হুমকি বাস্তবতা ভারতের যেকোনো আক্রমণকে অনিশ্চিত করে তোলে। হেনরি কিসিঞ্জার যেমন বলেছিলেন, “আমরা জানতাম না আসল লক্ষ্য কী, তাই বিজয়কেও চিনতে পারতাম না।”
এই প্রেক্ষিতে ভারতের ‘সীমিত যুদ্ধ’ পরিকল্পনা আসলে আত্মঘাতী হতে পারে, যেমনটা প্রমাণিত হয়েছিল মার্কিন যুদ্ধ গেম ‘Proud Prophet’-এ, যেখানে ‘সীমিত’ যুদ্ধ গড়ায় পরমাণু যুদ্ধের দিকে, এবং প্রাণ হারায় কোটি কোটি মানুষ।
সীমিত যুদ্ধ ও ‘এস্কালেশন ডমিন্যান্স’ তত্ত্ব
ভারতের কিছু নীতিনির্ধারক মনে করেন, তারা সীমিত সামরিক অভিযান চালিয়ে পাকিস্তানকে শাস্তি দিতে পারবে, এবং সেই যুদ্ধকে তারা নিজেরাই নিয়ন্ত্রণে রাখবে। এটি একটি ভ্রান্তি। ২০১৯ সালের পুলওয়ামা হামলার পর ভারত এমন এক ‘সীমিত প্রতিক্রিয়া’ দেখাতে গিয়ে নিজের কৌশলগত ভুলের শিকার হয়েছিল।
ভারতের এই কৌশল নির্ভর করে একটি অনুমানের ওপর—প্রথম আঘাতে ভারত সফল হবে এবং পাকিস্তান প্রতিশোধ নেবে না। কিন্তু পাকিস্তান যদি সেই শুরুতেই পাল্টা জবাব দিতে সক্ষম হয়, তাহলে ভারতের এই কল্পিত কৌশল ভেঙে পড়ে।
কাশ্মীর: দক্ষিণ এশিয়ার জটিলতম ফাঁদ
ভারতের কাশ্মীর দমননীতি এবং পাকিস্তানকে দায়ী করার কৌশল—এই দুইটি একসাথে চলতে থাকা কৌশল। এই প্রসঙ্গে ২০১০ সালে আজিত ডোভালের বক্তব্য স্মরণযোগ্য, যেখানে তিনি বলেন, কাশ্মীরের সমাধান পাকিস্তানের মানসিকতা পরিবর্তনের মাধ্যমে করতে হবে।
কাশ্মীরি দলগুলো যেমন ন্যাশনাল কনফারেন্স (এনসি) ও পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (পিডিপি) অধিকতর স্বায়ত্তশাসন চায়, এবং ২০১৯ সালের পরিপ্রেক্ষিতে ৩৭০ ধারা পুনর্বহালের দাবি তোলে। হুরিয়ত ও তরুণ কাশ্মীরিদের দৃষ্টিভঙ্গি আরও ভিন্ন। স্বাধীন গণভোট হলে অধিকাংশ কাশ্মীরিই ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পক্ষে ভোট দিতেন।
ভারতের নীতি এখন এমন যে, কাশ্মীরিদের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা হচ্ছে। এটি অনেকটাই ইসরায়েলের ফিলিস্তিন নীতির অনুকরণে গঠিত।
পাকিস্তানের ভুল এবং ভারতের লাভ
পাকিস্তান তার নিজের ভুলে আন্তর্জাতিক পরিসরে কাশ্মীরকে ভারত-পাকিস্তান দ্বিপাক্ষিক সমস্যা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করেছে। কাশ্মীরিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের জায়গায় এটিকে সন্ত্রাসবাদ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। জাতিসংঘের ২৬২৫ ও ৩২৪৬ নম্বর প্রস্তাব এই অধিকারকে সমর্থন করলেও, ভারত একে জাতীয় নিরাপত্তার ইস্যু হিসেবে ব্যবহার করে থাকে।
ইতিহাস থেকে শিক্ষা: ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের কাঠামোগত বাস্তবতা
ভারত তার প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে কেবল তখনই শান্তিতে থাকে, যখন তারা ভারতের আধিপত্য মেনে নেয়। পাকিস্তানের সমস্যা তাই কেবল হুমকি নয়, বরং কাঠামোগত—একটি বড় শক্তিধর রাষ্ট্রের সঙ্গে এমন অবস্থান, যেটি সেই ছোট রাষ্ট্রকে প্রভাবাধীন করে তুলতে চায়।
এই বাস্তবতায় পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াকে বিশ্লেষণ করতে হবে দক্ষিণ এশীয় রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের কাঠামোর আলোকেই।
সমঝোতার বিকল্প নেই
ভারতের বর্তমান একতরফা ও অহংকারভিত্তিক নীতিতে পাকিস্তানের সঙ্গে অর্থবহ সংলাপ অসম্ভব। কিন্তু যুদ্ধের পথ থেকে সরে এসে শান্তিপূর্ণ সংলাপ ছাড়া উপায় নেই। ভারত যদি সত্যিই স্থিতিশীলতা চায়, তাহলে তাকে মানসিকতা বদলাতে হবে। তবে বর্তমানে তার সম্ভাবনা ক্ষীণ বলেই মনে হয়।
সূত্র: ডন, ৪ মে ২০২৫ ( এজাজ হায়দারের লেখার সারাংশ বাংলায় উপস্থাপন করা হয়েছে)